বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


এম. পিপ্রোডাকশনসের ‘বসু পরিবার’ সাড়া জাগানো সাফল্য পাওয়ার পর সকলেই ভেবেছিলেন যে পরিচালক নির্মল দে নিয়মিত ছবি করবেন। কারণ তিনি বেশ কিছুদিন নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। শান্তিনিকেতনে ছিলেন। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন ‘বসু পরিবার’ হিট হওয়ার পর তিনি আবারও বেশ কিছু ছবি করবেন। কিন্তু দেখা গেল তিনি সেই ব্যাপারটা একেবারেই করলেন না। অনেক অফার আসা সত্ত্বেও পরিচালক নির্মল দে নিজেকে সহজ করতে পারছিলেন না। একটা অফারও তিনি গ্রহণ করছিলেন না। ঠিক করেছিলেন আর তিনি ছবি করবেন না। কিন্তু মূরলীধর চট্টোপাধ্যায় তাঁকে অনুরোধ করায় সে অনুরোধ তিনি ফেলতে পারেননি আবার তিনি ছবি করতে এগিয়ে এলেন।
একটা হাসির ছবি তৈরি করার ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে গেল। ছবির নামকরণ করা হল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। গল্পকার বিজন ভট্টাচার্য। উত্তম কুমার আগের মতনই প্রতীক্ষায় রইলেন যদি নায়ক হিসেবে নির্মল দে উত্তমকুমারকে নির্বাচন করেন। এই ভাবেই তিনি প্রতীক্ষায় ছিলেন। তিনি স্থির সিদ্ধান্তে এসে গিয়েছিলেন যে নির্মলবাবু তাঁকেই নেবেন। ঠিক সময় নির্মলবাবু উত্তমকুমারকে ডেকে পাঠালেন। যথাসময়ে সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে নির্বাচন করা হল উত্তমকুমারকে নায়ক হিসাবে।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৫: বসু পরিবার-এ উত্তমকুমার দিনভর একটি শব্দই রিহার্সাল করেছিলেন, কোনটি?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

এ বারে ঠিক হল নায়িকা কাকে করা হবে সেই ব্যাপারটি। নামটি উঠল মালা সিনহার। একদিন নির্মলবাবু উত্তমকুমারকে নিয়ে হাজির হলেন মালা সিনহার বাড়িতে। কলকাতার ভবানীপুরের জগুবাবুর বাজারের কাছে তখন মালা সিনহা থাকতেন। তখন তিনি বাংলা ছবির ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত নাম। হিন্দিতেও কাজ করতে শুরু করেছেন। সম্মত হলেন না। অনেকগুলি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার জন্যই তিনি এই ছবিতে কাজ করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেন।

এ বার নির্মল দে’র সামনে আবার নায়িকা বিভ্রাট। সকলের তখন এক চিন্তা কাকে দিয়ে কাজ করানো যাবে। নায়িকা চিন্তায় সবাই যেন বিব্রত। হঠাৎ মলিনা দেবী নির্মল দেকে বলেছিলেন রমাকে একবার দেখে নেয়ার জন্য। রমা মানে সুচিত্রা সেন। সুচিত্রা সেন তখন টুকটাক কাজ করলেও দর্শকমহলে তখন তিনি ধরতে গেলে নবাগতা। সেই সুচিত্রা সেনকে এই ছবিতে নায়িকা নির্বাচন করা হল। উত্তমকুমার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: প্রাক-কথন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

যথা সময়ে ছবির কাজ শুরু হল। নিয়মিত শুটিং আরম্ভ হয়ে গেল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির। বিরাট কাস্টিং সে ছবি জুড়ে। যথাসময়ে ১৯৫৩ সালে প্যারাডাইস সিনেমায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ মুক্তি পেল। প্যারাডাইস তখন ছিল অন্যতম প্রথম শ্রেণির চিত্রগৃহ। বাংলা ছবির এই হাউসে মুক্তি পাওয়া বিরাট কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে। এমপির কর্তৃপক্ষ যেন সেই কৃতিত্বই অর্জন করলেন। ফলাও করে এমপি কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপন দিলেন ।বিজ্ঞাপনের মুখ্য বিষয়বস্তু হল প্যারাডাইস। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির বিজ্ঞাপনের প্রথম যে কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল তা ছিল এই রকম ‘প্যারাডাইস চিত্রগৃহে বাংলা ছবি’।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

বিজ্ঞাপনে তারপরে দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিল ‘তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত একটি ছবি’। নায়ক হিসেবে কোথাও উত্তমকুমারের কোনও হদিস রইল না বিজ্ঞাপনের কোথাও। ফলে উত্তমকুমারের মনটা ভীষণ দমে গিয়েছিল। কিছুতেই এমপি’র প্রচার বিভাগ উত্তম কুমারের নামটা বিজ্ঞাপনে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। অবশেষে সে ব্যাপারে উত্তম কুমারের উৎসাহ সীমিত হয়ে গেল। অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ উত্তমকুমারের নামের ব্যাপারে এতটুকু আমল দিলেন না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

তখন উত্তম কুমার অপেক্ষা করতে লাগলেন সাংবাদিকরা কি তাঁর সম্পর্কে বলেন সেই বিষয়ে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সর্বাধিক বিক্রি হওয়া পত্রিকায় লেখা হল, “রাম প্রীতির ভূমিকায় উত্তমকুমারকে বেশ স্মার্ট দেখা গেল, অভিনয়ও স্বচ্ছন্দ।” এমন একটা সার্টিফিকেট পেয়ে সত্যি উত্তম কুমারের মনটা ভরে গিয়েছিল।
পরবর্তীকালে অবশ্য সর্বদাই উত্তম সুচিত্রার নামটাই উঠে এসেছে তুলসী চক্রবর্তী ও মলিনা দেবীর আগেই সাড়ে চুয়াত্তর ছবির বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে। উত্তম কুমার প্রতিষ্ঠিত ‘শিল্পী সংসদের’ আগামী ২৪ জুলাই উত্তমকুমারের প্রয়াণের দিনে নন্দন (এক) প্রেক্ষাগৃহে যে ছবিটি দিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করা হবে সেই ছবিটির নামই হল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’।—চলবে।
* পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content