ছবির একটি বিশেষ দৃশ্যে।
সত্যজিৎ রায় তাঁর চলচ্চিত্র জীবনে প্রথম যে ছবিটিতে রহস্য নিয়ে এলেন, সে ছবির নাম ‘চিড়িয়াখানা’। গল্পকার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সত্যজিৎ রায় মূল গল্প থেকে বহু জায়গায় সরে গিয়েছেন। সারা ছবি জুড়েই সেটা রয়েছে। যেমন ব্যোমকেশ ছবিতে অবিবাহিত। হয়তো ব্যোমকেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা ভেবেই পরিচালক তাঁকে অবিবাহিত রেখেছেন। ফলে ব্যোমকেশ পত্নী সত্যবতীর চরিত্র এই ছবিতে নেই।
ব্যোমকেশের ঘরটাকে সাজানো হয়েছে অদ্ভুতভাবে। নিজের ঘরে দেওয়ালে ব্যোমকেশ কয়েকটি বাক্য লিখে বোর্ড ঝুলিয়েছেন। কি আছে সেই বাক্যগুলিতে? “ডু নট এন্টার উইথআউট পারমিশন”, “টু লেট”, “পকেটমার হতে সাবধান” ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫২: সোনার কেল্লা’র শুটিংয়ে খাটের মধ্যে কাঁকড়াবিছে নিয়ে সে কি হুলস্থুল কাণ্ড!
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
মূল উপন্যাসে সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ কখনও মেকআপ নিয়ে নিশানাথ সেনের গোলাপ কলোনিতে যাননি। নিজের চেহারাতেই গিয়েছিলেন। কিন্তু সত্যজিৎ রায় গোলাপ কলোনিতে ব্যোমকেশরূপী উত্তমকুমারকে প্রবেশ করালেন এক জাপানি ভদ্রলোকের ছদ্মবেশে। জাপানি মেকআপে থাকার সময় ব্যোমকেশকে একটা কথা বলতে হয়নি। তিনি তখন সবকিছু দেখছেন। শুনছেন। ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ছদ্মবেশ অবস্থায় সবার সঙ্গে আলাপ। আলাপ করায় তাঁর অনুসন্ধান খুব কার্যকরী হয়েছে।
সত্যজিৎ ও উত্তম।
মূল উপন্যাসে ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৪৬ সালের গ্রীষ্মকালে। সিনেমাতে সেই ঘটনা সত্যজিৎ রায় সাজিয়েছেন হাজার ১৯৬৬ সালে অর্থাৎ উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে প্রায় কুড়ি বছরের। ছবির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়টি হল ময়াল সাপ নিয়ে ব্যোমকেশের খেলাধুলো করা। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মূল উপন্যাসের ময়াল সাপের বাচ্চা ব্যবহার ছিল না। কিন্তু সত্যজিৎ রায় ব্যোমকেশকে দিয়ে বেশ কয়েকবার ময়াল সাপের বাচ্চা নিয়ে নাড়াচাড়া করিয়েছেন এমনটি দেখা গিয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে ব্যোমকেশ বেশ সাহসী। উত্তম কুমারকে নিয়ে অসাধারণ এক কাজ এখানে পরিচালক করিয়েছেন।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৬: সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসায় ম্যানগ্রোভ—হরগোজা ও কেয়া
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৪: সারদা মায়ের মানসিক দৃঢ়তা
মূল উপন্যাসের ডাক্তার ভুজঙ্গ দাস আর বনলক্ষ্মীর প্রেম প্রতিশ্রুতি পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই স্বামী যখন নিশনাথ সেনকে খুন করতে গেছেন তখন বনলক্ষী সেতার বাজাচ্ছিলেন। যাতে কলোনির সকলের মনে ধারণা হয় যে এই সময় ভুজঙ্গ ডাক্তার নিজের ঘরে বসেই সেতার বাজাচ্ছেন। কিন্তু ছবিতে সত্যজিৎ রায় দম্পতির এই সখ্যতাকে বজায় রাখেননি। ভুজঙ্গ যখন খুন করতে গিয়েছেন তখন নিজের ঘরে টেপ রেকর্ডারে মালকোষ রাগে সেতার বাদনের স্পুলটি চালু করে রেখেছিলেন। ফলে কলোনির লোকেরা ভাবলেন ভুজঙ্গ তাঁর ঘরেই আছেন।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
এমনকি এই দম্পতির পরিণতি উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে ভিন্ন ভিন্ন। উপন্যাসে আছে যে খুনি হিসেবে ধরা পড়ে যাওয়ার পর ভুজঙ্গ এসে দাঁড়িয়েছেন বনলক্ষ্মীর কাছে। বনলক্ষ্মী উঠে ভুজঙ্গকে জড়িয়ে ধরলেন। ভুজঙ্গ বনলক্ষ্মীকে অনেকক্ষণ ধরে চুম্বন করলেন। তারপর বললেন “চলো এবার যাওয়া যাক”। দুজনের মুখের মধ্যে কাঁচ চিবোনোর মতো একটা শব্দ হল। দু’জনে একসঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এবং সেই বিষক্রিয়ায় দু’জনের মৃত্যু হল।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩০: এই রাত তোমার আমার…
সত্যজিৎ রায় অবশ্যই এখানে এমন পরিণতি রাখেননি। ছবির বনলক্ষ্মী সেতার বাজাতে জানেন না। তবে ভালো গান করেন। স্বামীর অপরাধের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েন ফলে গান অভিনয় এসব জগত থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হয়। তাই গোলাপ কলোনিতে স্বামীর দুটি খুনের অপরাধে বনলক্ষ্মী কোনওভাবেই সাহায্য করেননি তাঁর স্বামীকে। সক্রিয়ভাবে তো নয়ই নিষ্ক্রিয় ভাবেও নয়। এসব পরিবর্তন ছবির আকর্ষণকে এতোটুকু কমাতে পারেনি বরং তৈরি করেছে টানটান উত্তেজনা।
গতকাল ছিল ২ মে। সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন উদযাপিত হল। আর এ বছরেই অর্থাৎ এই ২০২৪ সাল হল লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মের ১২৫ বছর। এই দুই প্রণম্য ব্যক্তি অর্থাৎ লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরিচালক সত্যজিৎ রায়কে এই লেখার মধ্য দিয়ে জানাচ্ছি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।—চলবে।
* পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।