বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক শিশু একাডেমি পরিদর্শন।

‘নিখিল ভারত শিশুসাহিত্য সংসদ’-এর আমন্ত্রণে ১৮ সেপ্টেম্বর’ ২০২২ কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘সারা বাংলা ছড়া উৎসব’-এ যোগ দিয়েছিলাম। উৎসবে পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় ও আলাপে বাংলাদেশের ‘মাসিক শিশু’ পত্রিকায় তাঁদের লেখা যত্ন সহকারে ছাপানোর বিষয়টি খুশির সঙ্গে জানিয়েছেন। তাঁরা জানেন, সুন্দর ঝকঝকে ছাপা, সম্পূর্ণ রঙিন শিশুতোষ ম্যাগাজিনটি ‘বাংলাদেশের শিশু একাডেমি’র মাসিক মুখপত্র, যা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। কিন্তু জানেন না যে, ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি’ বাংলাদেশের শিশুদের এক বিশাল আনন্দ ভূবনের নাম।

এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে শুনে তাঁরা সকলেই অবাক মেনেছেন। তাঁরা মনে করতেন, পশ্চিমবঙ্গের ‘শিশু কিশোর একাডেমির’ মতো হবে হয়তো। পশ্চিমবঙ্গের শিশু কিশোর একাডেমিও দ্বিমাসিক পত্রিকা ‘চির সবুজ লেখা’ প্রকাশ করে এবং তাদের নিজস্ব অনেক কার্যক্রম রয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশে শিশু একাডেমির কার্যক্রম অনেক ব্যাপক ও তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত। বাংলাদেশের শিশুদের প্রতিভা বিকাশ ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে এই প্রতিষ্ঠান ব্যাপক কাজ করে চলেছে। শুরুতে একাডেমির কার্যক্রম রাজধানী কেন্দ্রীক হলেও পরবর্তীতে এর শাখা দেশের প্রতিটি জেলায় স্থাপন করা হয়েছে।

শিশু একাডেমির অনুষ্ঠানে শিশু শিল্পীদের সঙ্গে সন্মানিত অতিথিবৃন্দ।

সারা দেশে একাডেমির কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তায় ইতিমধ্যে ৬টি উপজেলা সদরেও এর শাখা স্থাপন করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে সব উপজেলায় শাখা হতে পারে। ঢাকার প্রধান কার্যালয়-সহ প্রতিটি শাখা প্রাঙ্গন শিশুর স্বপ্নের মতো করে সাজানো গোছানো সুন্দর। এখানে প্রবেশ মাত্র যেকোনও শিশু তার আনন্দ উপকরণ খুঁজে নিতে পারে। মোবাইল আসক্ত শিশুও মোবাইল ছুঁড়ে ফেলে অন্যরকম আনন্দে মেতে ওঠে। এখানে শিশুদের আঁকা স্বপ্নের সব ছবি, ছোট বড় খেলনা, পড়ার জন্য মনোরম পাঠাগার রয়েছে। সবকিছু সুসজ্জিত পরিকল্পিত।
শিশুর মানসিক বিকাশের সবদিক মাথায় রেখে সরকার ধীরে ধীরে এই একাডেমিকে পূর্ণাঙ্গ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছে। রাজধানী ঢাকার দোয়েল চত্বর সংলগ্ন শিশু একাডেমির মূল ভবনে প্রশাসন, প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক ভবনের সঙ্গে রয়েছে অসাধারণ সুন্দর শেখ রাসেল শিশু জাদুঘর। যেখানে শিশুরা বাংলাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সামাজিক সংস্কৃতি সম্পর্কে সহজে জানতে পারে, জ্ঞান লাভ করতে পারে। শিশুদের পছন্দের বইয়ে ঠাসা দারুণ এক লাইব্রেরি ‘জোবেদা খানম শিশু গ্রন্থাগার’। আছে গ্রন্থাগার ভিত্তিক বিভিন্ন শিক্ষামূলক কার্যক্রমের আয়োজন। যার মাধ্যমে ছোটরা লাইব্রেরিকে জীবনের এক আনন্দ উপকরণ হিসেবে মনে করতে পারে এবং সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায়। আছে অত্যাধুনিক বিশাল মিলনায়তন। জাতীয় সব আয়োজনে ছোটরা খুশি মনে এখানে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারে। নানান ফুলের সমারোহে দৃষ্টিনন্দন এক বাগান। এখানে শিশুরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারে। বিভিন্ন প্রকার ফুলের নাম জানতে পারে এবং চিনতে পারে। আছে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের কিশোর শহীদ মতিউরের নামে মুক্ত মঞ্চ। এখানে দেশের শিশু সংগঠনগুলো নাম মাত্র খরচে তাদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারে।
আরও পড়ুন:

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-২: তরুণ প্রজন্মের পছন্দের পর্যটন স্পট কক্সবাজার

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব-২০: ষষ্ঠী থেকে দশমী লক্ষাধিক মানুষ ভিড় জমান ঢাকেশ্বরী মন্দিরে, পুজো হয় ভক্তদের দানেই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৮: মেয়ের জন্য হেমন্তবালা কবির পরা জোব্বা নিয়েছিলেন

দেশের শিশু কিশোররা বাংলাদেশ শিশু একাডেমির কার্যক্রম সম্পর্কে জানে, জানে তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকেরাও। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি বছরব্যাপী যে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য হল— জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে চারস্তরে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতা প্রতি বছর কম করে হলেও প্রায় চার লাখ শিশু অংশগ্রহণ করে তাদের প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগ পায়। বিজয়ীদের জন্য থাকে আকর্ষণীয় মূল্যবান সব পুরস্কার। প্রায় প্রতিটি শিশু কিশোর অধির আগ্রহে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেয়। তারা অপেক্ষা করে কখন কাঙ্খিত প্রতিযোগিতার সময় হবে, ডাক আসবে। প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিজয়ী হবে, সারা দেশে নাম ছড়িয়ে পড়বে। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!

বাংলাদেশ শিশু একাডেমি।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমি জন্মলগ্ন থেকে শিশুদের জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করেছে। এই সবের মধ্যে চিত্রাংকন, সংগীত, নৃত্য, নাট্যকলা, আবৃত্তি, উচ্চারণ ও সরব পাঠ, তবলা, গিটার, স্পোকেন ইংলিশ এবং কম্পিউটার বিষয়ে শিশুরা আনন্দের সঙ্গে শিখতে পারে। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, দরিদ্র ও সুবিধাঞ্চিত শিশুরা বিনামূল্যে এখানে প্রশিক্ষণ নিতে পারে। দেশের সব জেলা সদরের কার্যালয়ে এই সুবিধার পাশাপাশি উপজেলা সদরেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে বিভিন্ন কার্যক্রম চালু আছে। আছে সুদৃঢ় নেটওয়ার্ক। সারাদেশের মেধাবী ও প্রতিভাবান শিশুদের খুঁজে নিতে এই একাডেমির তুলনা হয় না। সারা বছর বিভিন্ন রকমের প্রতিযোগিতা ও নানান আনন্দ আয়োজন করে শিশুদের প্রাণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এই শিশু একাডেমি।

লাইব্রেরিতে শিশুদের আনন্দ পাঠ।

১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। একাডেমি পরিচালনার জন্য আছে একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ। মহাপরিচালক হচ্ছেন নির্বাহী প্রধান। একাডেমির মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে দেশের শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করা। আজকের শিশু আগামী দিনের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেই শিশু। এই শিশুদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি বিভিন্ন বিষয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছে। শিশুদের উপযোগী বিভিন্ন বই, পত্রিকা, গ্রন্থকোষ প্রকাশ করা, শিশুদের পাঠের সুবিধা সৃষ্টি এবং পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা। বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মসূচির মধ্যে যেমন— কুইজ, বির্তক, আবৃত্তি, চিত্রাংকন, হস্ত ও কারুশিল্প ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা; শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন করা; বিভিন্ন দেশে শিশু সাংস্কৃতিক দল প্রেরণ করা; জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ দিবসসহ বিভিন্ন সামাজিক ও ঐতিহ্যগত আচার অনুষ্ঠান উদযাপন করা; বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করা। পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি ও বৃক্ষরোপণে উৎসাহ সৃষ্টি করা; মেয়ে শিশুদের জন্য বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী সবাইকে সচেতন করা ইত্যাদি।
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: বাজির আগুন থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন খুদেদের, কী কী নিয়ম মানতেই হবে জেনে নিন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

ত্বকের পরিচর্যায়: শীতে কি আপনার ত্বক শুকিয়ে যায়? মেনে চলুন ত্বক বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৭: হারিয়ে যাওয়ার আগে এ এক বিফল মৃত—‘সঞ্জিবনী’ [০৮/০২/১৯৫২]

বাংলাদেশ শিশু একাডেমি বাংলা শিশুসাহিত্য বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। দেশের প্রতিভাবান মেধাবী শিশুসাহিত্যিকদের রচিত গ্রন্থ প্রকাশ এবং ‘মাসিক শিশু’ পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করছে। এখানে দেশে বিদেশের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের পাশাপাশি নবীন লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়। নবীনেরা প্রতিভা বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ পায়, উৎসাহিত হয়। দেশের বিশিষ্ট লেখকদের মানসম্মত শিশুসাহিত্য রচনায় আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রবর্তন করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, চট্টগ্রাম।

একজন লেখককে তার সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। এছাড়া একাডেমি ‘অগ্রণী ব্যাংক’-এর অর্থানুকুল্যে প্রতি বছর ‘অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করে। ১৯৮১ সাল থেকে প্রতি বছর বইয়ের ইলেস্টেশন-সহ ৭টি বিভাগে বছরের সেরা বইয়ের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রতি বছর নতুন নতুন বই প্রকাশের মাধ্যমে শিশুসাহিত্যিকদের মধ্যে একটা আনন্দ উদ্দীপনা প্রেরণা সৃষ্টি করে। পশ্চিম বঙ্গসহ বাংলা ভাষাভাষি সব লেখকের শিশু উপযোগি লেখা ‘মাসিক শিশু’ পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করে থাকে।
একজন খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক জনাব আনজীর লিটনকে সম্প্রতি শিশু একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি ইতিপূর্বেও একাডেমির পরিচালক ছিলেন। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন বিশিষ্ট নাট্যবক্তিত্ব শিশুদরদী লাকি ইনাম। শিশু একাডেমি পরিচালনায় শিশুসাহিত্যিকদের যুক্ত করার ফলে প্রতক্ষ্য ভাবে শিশুসাহিত্য উপকৃত ও বিকশিত হচ্ছে। শিশুর প্রতিভা বিকাশ ও আগামীর টেঁকসই বাংলাদেশ বিনির্মানে শিশু একাডেমির ভূমিকা অনন্য। শিশুদের জন্য অপার আনন্দ আয়োজন করে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি দেশে বিদেশে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছে।

* সোনার বাংলার চিঠি (Letter from Sonar Bangla, Sonar Banglar Chithi, Bangladesh) : অরুণ শীল (Arun Shil) কবি ও সাহিত্যিক। তিনি প্রধানত শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক। শুরুতে গণমুখী ছড়া লিখে তুখোড় ছড়াকার হিসেবে পরিচিতি পেলেও মায়াবী, কোমল এবং স্বপ্নময় কিশোর কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ, ফিচার লিখেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কার।

Skip to content