শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

অরুচিকে আয়ুর্বেদ সংহিতাগুলি ব্যাধি রূপে কিছু কিছু জায়গায় বর্ণনা করলেও এটি মুখ্যত ব্যাধি নয়, বরং এই অরুচি অনেক অনেক রোগের লক্ষণ বা উপদ্রব মাত্র। মহর্ষি চরক ও আচার্য্য সুশ্রুত এই অরুচি রোগের নিদান বা কারণ, সম্প্রাপ্তি অর্থাৎ রোগের উৎপত্তির ক্রম এবং লক্ষণ স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনা করেছেন। আবার আচার্য্য ভোজ, এই রোগের বিভিন্ন প্রকারভেদকে স্পষ্ট পরিভাষায় ব্যক্ত করেছেন।

আসলে অরুচি হল এমন একটি অবস্থা যেখানে অন্নের প্রতি বা খাদ্য খাবারের প্রতি রুচি না থাকা বা অনিহা। খাদ্য খেলেও সেই খাবারের আস্বাদ উপভোগ না করা। অরুচির পর্য্যায় শব্দগুলি হল—অরোচক, ভক্তোদ্বেষ, ভক্তোপঘাত, অভক্তোচ্ছন্দ, অনন্যাভিলাসা ইত্যাদি যা বিভিন্ন রকমের ভাবকে সূচিত করে। যেমন—
● অরোচক: খিদে কম লাগাকে ব্যক্ত করে।
● অরুচি: ভোজনের প্রতি রুচি না থাকাকে বোঝায়।
● ভক্তোদ্বেষ: ভোজন করতে গিয়ে খাবার দেখেই গলাধঃকরণের ইচ্ছে চলে যাওয়া বোঝায়।
● অনন্যাভিলাসা: খাবার ইচ্ছা একদমই লুপ্ত হয়ে যাওয়াকে ব্যক্ত করে।
● অভক্তোচ্ছন্দ: খাদ্য খাবারের প্রতি অশ্রদ্ধা উৎপন্ন হওয়াকে বোঝায়, এই সমস্ত ভাবগুলিকে একত্র সমাহার করলে বোঝা যায় যে, খাদ্য খাবার গ্রহণের প্রতি যে ব্যাঘাত তাই-ই হল ভক্তোপঘাত।
 

রোগের নিদান বা কারণ

এই অরুচিকে মূলত কারণ অনুসারে দু’ ভাগে ভাগ করা যায়, শারীরিক ও মানসিক।
● শারীরিক নিদান: বায়ু, পিত্ত ও কফের প্রকোপ যখন অনুচিতআহার বিহার থেকে ঘটে।
● মানসিক নিদান: শোক, ভয়, ক্রোধ, অভিলোভ মনের মতো খাবার না পাওয়া, মনোমতো গন্ধ বা রুপ খাবারে না থাকা ইত্যাদি।

রোগ উৎপত্তির ক্রম বিচার করে বলা যায় যে,যখন মিথ্যা আহার বা বিহার ইত্যাদি নিদান থেকে বায়ু, পিত্ত ও কফ এই তিনটি দোষ প্রকুপিত হয়ে পাচকাগ্নিকে বিকৃত করে অগ্নিমান্দ্য ঘটায় তখন অন্নবহ স্রোত বা ডাইজেস্টিভ সিস্টেম পূর্ণ দূষিত হয়ে অরুচি আনে, অন্যভাবে শোক, ভয়, রাগ ইত্যাদি কারণে যখন চেতনা স্থানে (মস্তিষ্ক বা হৃদয়ে) দোষ সঞ্চিত হয়, তখন তা শরীর ও মন উভয় স্থানকে ক্ষোভিত করে ও তারপর পাচকাগ্নিকে বিকৃত করে অন্নের প্রতি রুচিকে বিনষ্ট করে এবং অরুচি বা অরোচক রোগ উৎপন্ন করে।

আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: অর্শে কষ্ট পাচ্ছেন? আয়ুর্বেদে রেহাই পেতে কী কী করবেন জেনে নিন

বিচিত্রের বৈচিত্র: তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম…

 

রোগের প্রকারভেদ

আচার্য্য চরক ও সুশ্রুত পাঁচ প্রকার অরুচির কথা বলেছেন।
বাতজ অরুচি
পিত্তজ অরুচি
কফজ অরুচি
সান্নিপাতজ অরুচি
মনোভিঘাত বা আগন্তুজ অরুচি

এই প্রকারভেদ থেকে এটা স্পষ্টত প্রতিয়মান হয় যে, প্রথম চার প্রকার অরুচি হল শারীরিক অরুচি। আর শেষ প্রকার অর্থাৎ পঞ্চম প্রকার অরুচি হলো মানসিক অরুচি।

আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩৭: মহানায়কের সেই ভুবন ভুলানো হাসি আর সস্নেহ চাহনির কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৯: ডায়াবেটিসে কি আলু একদম বন্ধ?

 

অরুচি রোগের লক্ষণ

 

বাতজ অরুচি

দন্তহর্ষ বা দাঁত শিরশির করা, মুখে তেতো ভাব, বুকে ব্যথা, মুখে সবসময় বিস্বাদ বোধ।
 

পিত্তজ অরুচি

মুখে বিস্বাদ বা কটু ভাব, স্বাদ না থাকা, মুখ টক টক ভাব, বুকে জ্বালা বোধ, মূর্ছা, তৃষ্ণা।
 

কফজ অরুচি

মুখ মিষ্টি হয়ে থাকা, কখনও লবণাক্ত ভাব, মুখে লালা ঝরা, শরীর ভারী বোধ হওয়া, শীত শীত বোধ।
 

সান্নিপাতজ অরুচি

মুখে বিভিন্ন ধরনের স্বাদ ঘন ঘন পাল্টে যাওয়া, মুখে বিভিন্ন ধরনের অস্বস্তির উদ্ভব সঙ্গে খাদ্যের অনিহা।
 

মনোভিঘাত বা আগন্তুজ অরুচি

নিদ্রানাশ, মুখে স্বাদ থাকে কিন্তু খেতে রুচি না থাকা, ব্যাকুলতা, মূর্ছা, অপ্রিয় গন্ধ নাকে আসা।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২১: পঞ্চমের সুরের মাদকতায় বুঁদ হয়ে আশা গাইলেন সেই তোলপাড় করা গান ‘পিয়া তু আব তো আজা…’

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৬: মজল আঁখি মজেছে মন, ইমোজি তোদের ডাকল যখন

● প্রথমত নিদান বা রোগ উৎপত্তির কারণগুলিকে বর্জন করতে হবে। যে সকল রোগের উপদ্রব বা জটিলতা হিসাবে অরুচি উৎপন্ন হয়েছে সেই রোগগুলোকে চিকিৎসা করে সারিয়ে নিতে হয়।
● দ্বিতীয়ত: শোক, দুঃখ, ভয় ইত্যাদি কারণে উৎপন্ন রোগের ক্ষেত্রে সত্ত্বাবজায় চিকিৎসা যথা আশ্বাস, সহানুভূতি জ্ঞাপন ও মনের জোর বাড়ানোর জন্য পুজো পাঠ ইত্যাদি করে চিকিৎসা সম্পন্ন করতে হবে। মনের অনুকূল খাদ্যাদি দিয়ে মন প্রসন্ন করতে হবে।
● তৃতীয়ত: মুখশুদ্ধি করার জন্য কুলকুচি, মুখ ধৌতি, ধূমপান ইত্যাদির প্রয়োগ।
● চতুর্থত দোষের আধিক্য অনুসারে বাতজ অরুচিতে বস্তি অর্থাৎ মলদ্বার দিয়ে ঔষধি প্রয়োগ,
 

পিত্তজ অরুচিতে

বিরেচন অর্থাৎ শাস্ত্রসম্মতভাবে পায়খানা করিয়ে শরীর শুদ্ধিকরণ।
 

কফজ অরুচিতে

বমন অর্থাৎ শাস্ত্রসম্মত বমি করিয়ে শরীরের দোষকে বের করা হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩: আত্মারামে কুটো বাঁধা আছে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত

 

অরুচির বিশেষ চিকিৎসা

 

মুখ ধৌতি

মুখ ধৌতির জন্য বিভিন্ন দোষের আধিক্য অনুযায়ী বিভিন্ন দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, যা চিকিৎসকের নির্দেশ অনুযায়ী করা উচিত। যেমন, কুড়, সৈন্ধব লবণ, জিরা, চিনি, গোলমরিচ, পিপুল, বিট লবণ, আমলকি, এলাচ, তেজপাতা ইত্যাদি দ্রব্য দোষ অনুযায়ী প্রয়োগ করা হয়।
 

চূর্ণ ঔষধি

লবণ ভাস্কর চূর্ণ, হিঙ্গাষ্টক চূর্ণ, এলাদি চূর্ণ, সমশর্কর চূর্ণ, রোচক চূর্ণ ইত্যাদি যেকোনও একটি ৩ থেকে ৬ গ্রাম মাত্রায় দিনে একবার বা দু’ বার হালকা গরম জল-সহ খেলে আহারে রুচি ফিরে আসে।
 

বটি ঔষধি

চিত্রকাদি বটি, গন্ধক বটি, শঙ্খবটি, হিংগাদি বটি অরুচিতে দেওয়া হয়, ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় এক থেকে দু’ বার হালকা গরম জল-সহ।
 

রসৌষধি

সুধানিধি রস, বড়বানল রস ইত্যাদি ১২৫ মিলিগ্রাম থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার মধু বা গরম জল-সহ খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
 

স্বরস ঔষধ

আদ্রক স্বরস, আমলা স্বরস, লেবুর রস, কমলালেবুর রস ইত্যাদি খেলেও ভালো ফল পাওয়া যায়।
 

অবলেহ

দ্রাক্ষা অবলেহ, আদ্রক অবলেহ, আমলকাবলেহ ইত্যাদি ৫ থেকে ১০ গ্রাম দিনে দু’ বার চেটে খেলে রুচি ফেরে।
 

ভস্ম

শঙ্খ ভস্ম, শুক্তি ভস্ম, লৌহ ভস্ম ইত্যাদিও মধু-সহ ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-২: রাজাদের স্থাপত্য-কীর্তি ও রাজধানী

 

পথ্য

পুরনো ঢেঁকি ছাটা চাল, গম, সবুজ শাক, কলা, বেদানা, গো দুগ্ধ, ঘৃত, রসুন, ঘোল, দই, আদা, মিষ্টি ও তেতো জাতীয় খাবার, মাংসের স্যুপ,নিয়মিত দাঁত মাজা, পরিচ্ছন্ন থাকা, সুগন্ধি দ্রব্য, স্নান, কুলকুচি করা।
 

অপথ্য

ভারী খাবার, মশলাদার খাবার, পিষ্টক, দুর্গন্ধ স্থানে বাস, মলমূত্র ত্যাগের জায়গায় থাকা, মলমূত্রের স্বাভাবিক বেগ ধারন, দ্রুতগামী যানবাহন ব্যবহার ইত্যাদি।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content