শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

এনজাইনা, এটি একটি পরিচিত শব্দ। প্রায়শঃই শোনা যায়। যার পোশাকি নাম এনজাইমা প্যাকটরিস, যা সাধারণত হার্টের মাংসপেশিতে রক্ত সরবরাহের ঘাটতির কারণে কম অক্সিজেন পরিবাহিত হওয়া এবং যার ফলে এক ধরনের বেদনা বা ব্যথা বোধ হওয়া। সাধারণতঃ হার্টের রক্তবাহী ধমনী বা কার্ডিয়াক আটারির ব্লক বা অবরোধ থেকে তা উৎপন্ন হয়। সারা পৃথিবীতে প্রায় ১০ কোটি মানুষ এই কষ্টে ভোগেন।

২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে প্রায় ৪৭ লক্ষ মানুষ এই রোগে ভুগতেন। আধুনিক বিজ্ঞান বয়স বৃদ্ধি, মানসিক চাপ, উত্তেজনা, রক্তে স্নেহজাতীয় পদার্থ কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড ইত্যাদি বেড়ে যাওয়া, করোনারি আটারিতে থ্রম্বাস তৈরি হওয়া, পেট ফাঁপা, বিপাকীয় সমস্যা জনিত রোগ যেমন ডায়াবেটিস ইত্যাদিকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

দেখা যাক আয়ুর্বেদ কীভাবে একে ভেবেছে। যেহেতু হৃদয় প্রদেশে ব্যাথার অনুভূতি হয়, তাই একে হৃদশূল বা হৃচ্ছূল বলে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে অভিহিত করা হয়েছে। মহর্ষি সুশ্রুত, মাধব কর এবং ভাব মিশ্র তাদের গ্রন্থে এই বিশেষ সমস্যাকে বিশদে উল্লেখ করেছেন।
 

হৃচ্ছূলের নিদান বা কারণ

মলমূত্রের বেগ চেপে রাখা, পেট ভর্তি করে খাওয়া, আগের খাবার জীর্ণ না হওয়া সত্বেও পুনরায় খেয়ে নেওয়া, স্বভাববিরুদ্ধ খাবার যেমন: দই বা পায়েসের সঙ্গে মাংস-মাছ ইত্যাদি খাওয়া, অত্যধিক বেশি জলপান করে নেওয়া, গুরুপাক খাবার যেমন: পিঠে, কড়াপাক সন্দেশ, ক্ষীর ইত্যাদি খাওয়া, কড়াপাক তেল-ঝাল মশলাদার খাবার, বড় মাছ, চর্বিযুক্ত খাসির মাংস, বড় মুরগির মাংস, অঙ্কুরিত ধানের চাল খাওয়া ইত্যাদি খাদ্য খাবারের অনিয়ম এবং রাত জাগা, অত্যধিক পরিশ্রম, বেশি সফর করা, মানসিক উদ্বেগ, চিন্তা, শোক ইত্যাদি কারণে প্রথমে কফ ও পিত্ত প্রকুপিত হয়, ফলে বায়ুকে সঠিকভাবে তার পথে চলতে দেয় না। অর্থাৎ পথকে অবরুদ্ধ করে। সে কারণে রস ধাতু দূষিত হয় এবং ঐ রস ধাতু যেহেতু হৃদয়ে অবস্থান করে তাই ঐ প্রদেশ শূল বা বেদনার সৃষ্টি করে। এই শূল বা বেদনার জন্য যেহেতু রোগীর উচ্ছ্বাস স্থিমিত হয়ে যায়, তাই এই অবস্থাকে হৃদশূল বলে।
 

রোগের লক্ষণ

বুকের মাঝ বরাবর বাঁদিক ঘেঁষে চিনচিনে ব্যাথা বা চাপ ধরা ব্যাথা বা কামড়ানোর মতো হালকা ব্যাথা বোধ করা, কখনও কখনও ঘাড়ে পিঠে বা হনুপ্রদেশে ব্যথা, ঘাম দেওয়া, হাই তোলা, মাথা ঘোরা, অবসন্নতা, কথা বলার উৎসাহ হানি ইত্যাদি কষ্ট দেখা যায়।

এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে, মায়োকার্ডিয়াল ইন ফারক্শন বা হার্টের স্ট্রোকের ফলে যে সমস্ত লক্ষন দেখা যায়, সেই রকম কিছু কিছু লক্ষণের সাদৃশ্য এই এনজাইনাতে ও থাকে। তাই যথোপযুক্ত রক্ত পরীক্ষা, ইসিজি, ইকো কার্ডিওগ্রাম, ইত্যাদি করিয়ে নেওয়া এবং ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া সবসময়ই বাঞ্ছনীয়।

আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: কাশিতে জেরবার? আয়ুর্বেদে রয়েছে কাশি থেকে বাঁচার সহজ উপায়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

 

চিকিৎসা

অন্যান্য রোগের মতো আয়ুর্বেদ এক্ষেত্রে ও নিদান বা কারণকে পরিত্যাগ করার কথা সবার আগে বিবেচনা করতে উপদেশ দিয়েছে। যেমন: বেশি গুরুপাক বা কড়াপাক খাবার, মানসিক উত্তেজনা ইত্যাদি যে কারণগুলির উল্লেখ আগে করা হয়েছে, সেগুলিকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে।

তারপর সংশোধন চিকিৎসা বা বায়োপিউরিফিকেশন অত্যন্ত জরুরি। এই প্রক্রিয়াতে রোগীকে বাহ্য স্নেহন বা তেল মাখানো, তারপর ঘাম ঝরানো বা স্বেদনক্রিয়া করা, বমন করিয়ে শরীরের ঊর্ধ্ব ভাগের দোষকে বাইরে বার করানো বা বিরেচনের মাধ্যমে অধঃভাগ দিয়ে বার করানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এই প্রক্রিয়া গুলি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে ও উপস্থিতিতে করানো উচিত।
 

সংশমনীয় চিকিৎসা

সাধারণত ঔষধ গ্রহণের মাধ্যমে রোগীর রোগ উপশমকে বোঝায়।
চূর্ণ ঔষধি যেমন অর্জুনছাল চূর্ণ ৩ গ্রাম দিনে দুবার দেওয়া যায়। পিপুল চূর্ণ এক গ্রাম দিনে দু’ বার মধু বা গরম জল-সহ। পুষ্করমূল চূর্ণ বা হরিতক্যাদি চূর্ণ তিন গ্রাম করে দিনে দু’বার দেওয়া যায়।
 

ক্বাথ বা পাচন হিসেবে

পথ্যাদি ক্বাথ ১৫ মিলি লিটার দিনে দু’ বার সকাল ও সন্ধ্যায় সমপরিমাণ হালকা গরম জল মিশিয়ে শ্বেত পর্পটী ২৫০ মিলিগ্রাম সহযোগে দেওয়া যায়।
 

আসব বা অরিষ্ট হিসেবে

অর্জুনারিষ্ট ২০ মিলিগ্রাম করে দিনে দু’ বার সমপরিমাণে জল-সহ দেওয়া যায়।
 

রস ঔষধি হিসেবে

নাগার্জুনাভ্র রস, কস্তুরী ভৈরব রস, চিন্তামণি রস, বিশ্বেশ্বর রস ইত্যাদি ১২৫ গ্রাম থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম মধু-সহ দিনে দু’বার দিলে খুবই উপকারী।

আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৩: বায়োপসি মানেই ক্যানসার?

হেলদি ডায়েট: তীব্র গরমে সুস্থ থাকতে ভরসা রাখুন ফলে-জলে-শরবতে

 

বটি হিসাবে

প্রভাকর বটি, শঙ্কর বটি ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার গরম জল বা মধু-সহ দেওয়া যেতে পারে।
 

ঘৃত হিসাবে

অর্জুন ঘৃত, বলাদ্য ঘৃত ১০ মিলিলিটার থেকে ২০ মিলিলিটার দিনে একবার বা প্রয়োজনে দু’বার দেওয়া যেতে পারে।
 

তৈল হিসাবে

পুনর্নবাদি তৈল, লাক্ষাদি তৈল ১০ মিলি লিটার দু’ বার দেওয়া যায়।
 

ভস্ম হিসাবে

মুক্তাভস্ম, প্রবাল ভস্ম, শঙ্খ ভস্ম ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার দেওয়া যায়।
 

পিষ্টি হিসাবে

প্রবাল পিষ্টি, মুক্তা পিষ্টি ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার মধু-সহ খাওয়ানো যায়।
 

বিশেষ সর্তকতা

অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীকে নিশ্চিত হতে হবে, তার কোনও বড় সমস্যা রয়েছে কিনা। জীবনশৈলীর পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। সেই সঙ্গে রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার।

আরও পড়ুন:

দশভুজা: তিনি ‘অরণ্যের বিশ্বকোষ’, ৭৯ বছর বয়সেও পরিবেশ সংরক্ষণে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন তুলসী

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৫: পঞ্চমের অনবদ্য সৃষ্টির মধ্যে একটি কিশোরের গাওয়া জনপ্রিয় ‘নদিয়া সে দরিয়া’ গানটি

 

পথ্য

পুরানো চালের ভাত, মুগ ডাল বা কুলথি কলাইয়ের ভেজানো জল, মরশুমি ফলের রস, শুষনি শাক, কাঁটা নটে শাক, শুকনো আদার গুঁড়ো, মধু, শ্বেত চন্দন, তেঁতুলের টক, অর্জুনছালের চূর্ণ গরম জলে মিশিয়ে ছেঁকে চায়ের মত পান করা।
 

অপথ্য

বেশি সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা, ভারী জিনিস তোলা, দৌড়ঝাঁপ করা, অত্যধিক রাগ, ক্ষোভ, মলমূত্রের স্বাভাবিক বেগ ধারণ, বেশি সফর করা, রাতজাগা, বেশি চর্বি জাতীয় খাদ্য, মদ্যপান, দিনে ঘুম, অত্যধিক পরিশ্রম।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content