শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

শ্বাস রোগে বিশেষ করে ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা ও ব্রঙ্কাইটিস অত্যন্ত কষ্টদায়ক ক্রনিক দুরারোগ্য ব্যাধি। পৃথিবী জুড়ে অ্যাজমা একটি ভয়ংকর সমস্যা। ভারতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত। পৃথিবীর যত মানুষ অ্যাজমাতে ভোগেন, তার সাড়ে ১৭ শতাংশ মানুষ, ভারতে থাকেন। এহেন সমস্যার প্রকৃত সমাধান এখনও আধুনিক বিজ্ঞান দিতে পারেনি। ইনহেলার, স্টেরয়েড, ব্রঙ্কোডায়োলেটর, অ্যালার্জিনাশক ওষুধ ইত্যাদির মাধ্যমে আপাততঃ রোগীর শ্বাসকষ্ট লাঘব করা গেলেও এ রোগ থেকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি কেউ পাচ্ছে না। তাই দেখে নেওয়া যাক এরকম একটি গুরুতর কষ্টদায়ক স্বাস্থ্য সমস্যায় আয়ুর্বেদ কিভাবে সাহায্য করতে পারে।

আয়ুর্বেদ মতে, শ্বাসরোগ প্রাণবহ স্রোতের অর্থাৎ হৃদয় ও শ্বাসনালির (কার্ডিও রেস্পাইরেটরি সিস্টেম) এর একটি রোগ, যেখানে শ্বাস নেওয়া তথা শ্বাস ছাড়ার প্রক্রিয়ায় অতীব কষ্ট অনুভূত হয়। সাঁ সাঁ শব্দ উৎপন্ন হয় বলে একে শ্বাস রোগ বলে। এই রোগে মূলতঃ বায়ু ও কফ প্রকুপিত হয়ে থাকে। এই প্রকুপিত কফ দ্বারা বায়ু বিশেষ করে প্রশ্বাসবায়ু বা প্রাণবায়ুর যাতায়াতের রাস্তা যখন অবরুদ্ধ হয়, তখনই শ্বাসকষ্ট-সহ অন্যান্য লক্ষণ প্রকাশিত হয়।
 

শ্বাস রোগের নিদান

শ্বাসরোগ বাত প্রকোপক নিদান ও কফ প্রকোপক নিদানের মিলিত কারণ সহকারে উৎপন্ন হয়। বাত প্রকোপক নিদান যেমন: ধুলো ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসা, শীতল বাতাস নেওয়া, শীতল জায়গায় বাস করা, অত্যধিক শারীরিক শ্রম, খাদ্য খাবার ঠিক মতো না খাওয়া, অত্যধিক রতিক্রিয়া করা, শারীরিক আঘাত, মল-মূত্র, হাঁচি-কাশি, তৃষ্ণা ইত্যাদির বেগ চেপে যাওয়া, ঠিক তেমনিই কফ প্রকোপক নিদান যেমন: ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় থাকা, দুপুরে ঘুম, শীতল জলে স্নান, শীতল পানীয়, নতুন চালের ভাত, পিঠে, পায়েস, তিল ইত্যাদি তৈল বীজ বেশি খাওয়া, গুরুপাক খাবার খাওয়া, দই, জলে থাকা প্রাণীর মাংস বেশি খাওয়া, কাঁচা দুধ পান ইত্যাদি।

উপরোক্ত কারণগুলির জন্য বায়ু ও কফ উভয়ই যখন বেড়ে যায় বা প্রকুপিত হয় তখনই কফ বৃদ্ধির জন্য অগ্নিবল অর্থাৎ পাচকাগ্নি দুর্বল হয়ে আম বিষ তৈরি করে। কফকে অধিক দূষিত করে প্রকুপিত বায়ুর রাস্তায় অবরোধ উৎপন্ন করে। এই বাধা সৃষ্টির ফলে বায়ু অত্যধিক প্রকুপিত হয়ে পড়ে, যা শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসে।

আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: আমে কী কী পুষ্টিগুণ আছে? ফলের রাজা শরীরের লাভ না ক্ষতির কারণ? কী বলছে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র?

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: জিনই মানুষকে অনন্য করেছে, শতাধিক স্তন্যপায়ীর জিন বিশ্লেষণে মিলল চমকপ্রদ তথ্য

 

শ্বাস রোগের প্রকার

আয়ুর্বেদে শ্বাস রোগ মূলত ৫ প্রকার। যথা: মহাশ্বাস, ঊর্ধ্বশ্বাস, ছিন্নশ্বাস, তমকশ্বাস এবং ক্ষুদ্র শ্বাস।

মহাশ্বাসে রোগীর অত্যধিক শ্বাসকষ্টের জন্য মত্ত ষাঁড়ের মতো শব্দ করে। চেতনা লুপ্ত হয়ে যায়। যাকে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় ‘ফ্যাটাল ডিসনিয়া’ বলা হয়। এই শ্বাসে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই এটি অসাধ্য।

উর্ধ্বশ্বাসে রোগীর শ্বাস ছাড়তে অনেকক্ষণ লেগে যায়। শ্বাস নেয় অল্পক্ষণ করে। রোগী দৃষ্টি উপরের দিকে থাকে। মরণাপন্ন অবস্থা হয়। এই অবস্থাকে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় ‘গ্যাম্পিং রেস্পিরেশন’ বলা হয়। এটাও অসাধ্য।

তৃতীয় প্রকারের শ্বাসটি ছিন্ন শ্বাস। যেখানে রোগী অল্প অল্প ছেড়ে ছেড়ে শ্বাস নেয়, মাথা বুক ইত্যাদিতে প্রচণ্ড বেদনা থাকে। অত্যধিক ঘাম নির্গমন হয়, মূর্ছা যায় ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। যাকে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় ‘চেইনি স্ট্রোক ব্রিদিং’ বলে, যা সারানো যায় না।

চতুর্থ প্রকারের শ্বাসটি তমক শ্বাস নামে আখ্যায়িত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমার সমতুল্য। এই ক্ষেত্রে কফ প্রধান দোষ এবং বায়ু তার সহযোগী দোষ। এই রোগটি বেশি দেখা যায়। এটি প্রথম অবস্থায় সারানো সহজ। যতদিন যায় ততই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে রোগী শ্বাসকষ্টের সময় তমঃ বা অন্ধকার দেখে। তাই একে তমক শ্বাস বলা হয়।

পঞ্চম প্রকারের শ্বাস ক্ষুদ্র শ্বাস। এক্ষেত্রে রোগীর অত্যধিক পরিশ্রমের জন্য বা দৌড়, উঁচুতে ওঠা ইত্যাদি কারণে শ্বাসকষ্ট হয়। বিশ্রামের ফলে আপসেই সুস্থ হয়ে যায়। তাই আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘এক্সরশলান ডিসনিয়া’ বলা হয়।।

আর একপ্রকারের শ্বাস রোগের কথা উল্লেখ আছে। যাকে বলা হয় প্রতমক শ্বাস। এক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের সঙ্গে রোগীর যদি জ্বর ও মূর্ছা যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়, তবে তা প্রতমক শ্বাস। এই ক্ষেত্রে বাত ও কফ দোষের সঙ্গে পিত্ত দোষও যুক্ত হয়।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি: পর্ব-১৩: ‘ওই দেখ, রাহুল দেব বর্মণের বাবা হেঁটে যাচ্ছেন’

উত্তম কথাচিত্র: পর্ব-৩৬: যুগে যুগে যা ‘সবার উপরে’

 

চিকিৎসা

অন্যান্য রোগের চিকিৎসার মতো এই তমক শ্বাস বা ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমার চিকিৎসায় ও রোগীর নিদান বা কারণগুলিকে যেমন ধুলো, ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসা, শীতল পানীয়, গুরুপাক খাবার, দুপুরে ঘুম ইত্যাদি বায়ু ও কফ প্রকোপক যে নিদানগুলি আগে বলা হয়েছে সেগুলিকে পরিত্যাগ করা অবশ্য কর্তব্য।
 

ঔষধি হিসাবে চূর্ণ

● শীতপলাদি চূর্ণ: ৩ গ্রাম দু’ বার মধু-সহ দেওয়া যায়। সকালে ও সন্ধ্যায় খাওয়া যেতে পারে।
● শৃঙ্গাদি চূর্ণ: ৩ গ্রাম দুপুরে ও রাতে খাবার পর গরম জলসহ দেয়া যায়।
● পিপুল চুর্ণ: ১২৫ মিলিগ্রাম মাত্রায় প্রত্যহ মধু-সহ চেটে খেলে শ্বাসকষ্ট সারে। এই সমস্ত ঔষধি সংশমনীয় অর্থাৎ দোষকে সাম্যাবস্থায় আনতে সাহায্য করে।
 

রসৌসধি হিসাবে

● শ্বাসকুঠার রস: ১২৫ মিলিগ্রাম থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার মধু-সহ দেওয়া যায়।
● অন্যান্য রস: কফকেতু রস, মহালক্ষ্মী বিলাস রস, শ্বাসকাস চিন্তামণি রস, কফ কুঠার রস ইত্যাদিও একই মাত্রায় ও অনুপান সহ দেওয়া যেতে পারে।
 

ভস্ম হিসাবে

শঙ্খ ভস্ম, অভ্রক ভস্ম, টঙ্কন ভস্ম ইত্যাদি ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দেওয়া যেতে পারে।
 

ক্বাথ বা পাচন হিসাবে

দশমূল ক্বাথ, শিরিষ ক্বাথ, দেবদাব্বাদি ক্বাথ, বাসাদি ক্বাথ ২০ মিলিলিটার দিনে দু’ বার দেওয়া যেতে পারে। অত্যধিক শ্বাসকষ্টে এই ক্বাথগুলির যেকোনও একটির সঙ্গে সোমলতা চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার প্রক্ষেপ দিয়ে খাওয়া যায়।
 

অবলেহ হিসাবে

বাসাবলেহ, চ্যবনপ্রাশ, ইত্যাদি ৫ থেকে ১০ গ্রাম করে দু’ বার চেটে চেটে খেতে দেওয়া যায়।
 

আসব বা অরিষ্ট হিসাবে

দ্রাক্ষারিস্ট, দ্রাক্ষাসব, কনকাসব ইত্যাদি ২০ মিলিলিটার দিনে দু’বার সমপরিমাণ জল-সহ খাওয়ানো যায়।
 

ঘৃত হিসাবে

মনঃশিলাদি ঘৃত, দশমূলাদি ঘৃত ১০ গ্রাম দু’ বার দেওয়া যায়।
 

সর্ষের তেল সৈন্ধব লবণ

অত্যধিক শ্বাসকষ্টে বুকের উপর হালকা গরম সর্ষের তেল সৈন্ধব লবণ মিশিয়ে মালিশ করা যায়।

এছাড়াও আয়ুর্বেদের শোধন ক্রিয়া (ডিটক্সিফিকেশন থেরাপি) করে রোগীকে সহায়তা দেওয়া হয়। পাশাপাশি রসায়ন ঔষধির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে এই দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। স্নেহন প্রিয়া, বমন ক্রিয়া, বিরেচন, ধূমপান ইত্যাদি ক্রিয়ার ব্যবস্থাও আয়ুর্বেদে আছে।

আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: বিকেল হলেই জমিয়ে প্রেম বা আড্ডা, সঙ্গে যদি থাকে ভেজিটেবিল চপ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৪: কবির ভালোবাসার নজরুল

 

পথ্য

গম, পুরনো চাল, ছাগলের দুধ, পুরনো ঘৃত, মধু, পিপুল, গোলমরিচ, গোমূত্র, গরম জল, নটেশাক, লেবু ইত্যাদি।
 

অপথ্য

মহিষের দুধ, ঘি, দই, সরষে, বেসন, কন্দমূল, শীতল পানীয়, গুরুপাক খাবার খাওয়া।


Skip to content