বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

জন্ডিস রোগটি অতি ভয়ংকর এক স্বাস্থ্য সমস্যা। সারা ভারতবর্ষে প্রায় প্রতি এক হাজার জন মানুষের মধ্যে তিনজন এই রোগে ভুগে থাকেন। এই রোগে শরীরে প্রবহমান রক্তে বিলিরুবিন নামক এক রঞ্জক পদার্থ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়, যা প্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে সর্বোচ্চ এক মিলিগ্রাম থাকার কথা। বিশেষ করে এই বিলিরুবিন যখন দুই থেকে তিন মিলিগ্রামের বেশী বেড়ে যায় তখন চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যায় যাকে স্ক্লেরাল ইক্টেরাস বলে যা ক্লিনিক্যাল জন্ডিসের গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষণ।

সাধারণত জন্ডিসে চোখ, চামড়া, মুখের ভিতরের অংশ হলুদ হয়ে যায়। মূত্র ও মলের রঙ ও বদলে গিয়ে গাঢ় হয়, বিশেষত মূত্র লালচে বা হলদে হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, সাধারণত চার রকমের জন্ডিস দেখা যায়। সেগুলি হল—প্রি হেপাটিক জন্ডিস, হেপাটো সেলুলার জন্ডিস, পোস্ট হেপাটিক জন্ডিস এবং নিয়োনেটাল জন্ডিস।

প্রথম দু’ ধরনের জন্ডিসের ক্ষেত্রে লিভার বা যকৃত বিশেষভাবে সম্পর্কিত থাকে। যদি রক্ত বিশেষ ভাবে ভেঙে গিয়ে অত্যধিক ‘হিমোলাইসিস’ ঘটায়, তাহলে ওই হিমলাইটিক অ্যানিমিয়ায় উৎপন্ন বিলিরুবিনকে লিভারের কোষগুলি থেকে উৎপন্ন উৎসেচক ঠিক মত ‘কনজুগেট’ করতে পারে না, ফলে রক্তে ‘আনকনজুগেট’ বিলিরুবিন বেড়ে ত্বকের বর্ণ হলুদ করে এবং অন্যান্য লক্ষণকে ও নিয়ে এসে জন্ডিস বাধায়। আবার লিভার বা যকৃতের প্রদাহের জন্য যখন লিভার যথার্থ কাজ করতে পারে না,উৎসেচক প্রয়োজন মত তৈরি হয় না তখন বিলিরুবিনের পরিমাণ রক্তে বাড়ে এবং হেপাটো সেলুলার জন্ডিস ঘটায়। কিন্তু যেখানে লিভার বা যকৃৎ ঠিক কাজ করলেও পিত্তবাহী নালীতে বা পিত্তথলিতে যদি পাথর জমে বা অন্য কোনও ভাবে যদি অবরোধ তৈরি হয় তাহলে লিভারের মধ্যে উৎপন্ন বিলিরুবিন অন্ত্রে এসে পৌঁছাতে পারে না, আবার বাইরে নিষ্কাশিত ও হতে পারে না। ফলে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে জন্ডিস হয়, সেটাই পোস্ট হেপাটিক জন্ডিস।
চতুর্থ প্রকার যে জন্ডিস তা সদ্যোজাত বা নবজাতক শিশুর ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যাকে নিয়োনেটাল জন্ডিস বলে। সারা পৃথিবীতে প্রায় পঞ্চাশ ভাগ সদ্যজাত শিশুরই এই জন্ডিস দেখা যায়, তা আবার যদি অপরিণত ভ্রুণের প্রসব বা প্রিম্যাচিওর ডেলিভারি হয় তাহলে প্রায় শতকরা ৮০ জন শিশুর এই জন্ডিস দেখা যেতে পারে। বর্তমানে জীবাণু সংক্রমণের কারণে লিভারের যে প্রদাহগুলি হয় তাতে হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি দেখা যায় যা পূর্ণ বিশ্রাম এবং উপযুক্ত চিকিৎসায় সেরে যায়। কিন্তু হেপাটাইটিস’ বি’ ভাইরাস, ‘সি’ ভাইরাস ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন যকৃৎ প্রদাহ ভীষণই মারাত্মক এবং জীবনদায়ী।
আয়ুর্বেদশাস্ত্রে কামলা নামের রোগের লক্ষণ ও নিদান জন্ডিসের সমান। তাই দেখা যাক প্রাচীন শাস্ত্র আয়ুর্বেদ কী বলছে।
 

নিদান বা রোগের হেতু

পান্ডু রোগ বা রক্ত হীনতায় ভোগা রোগী যদি বেশি করে পিত্ত প্রধান খাদ্য খাবার বা পিত্তবর্ধক আচার-আচরণ করেন, তাহলে তার শরীরের পিত্ত দোষ প্রকুপিত হয়ে রক্ত এবং মাংসকে দূষিত করে কামলা রোগ নিয়ে আসে। এই পিত্তবর্ধক খাবারগুলি হল, বেশি টক, ঝাল, মশলাদার ও কড়াপাক খাবার, বেশি লবণ, অতি উষ্ণ খাদ্য এবং পানীয়, মদ্য, শুকনো খাবার, তেলে ভাজা জাতীয় বিদাহী খাবার, পিত্তবর্ধক আচার-আচরণ যেমন রোদে ঘোরা, ক্ষোভ, দুঃখ, শোক, বেশি রাগ, আগুনের পাশে বেশি থাকা, স্নান ঠিকমতো না করা, জল কম খাওয়া ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

রক্তাল্পতায় ভুগছেন? জানুন আয়ুর্বেদ মতে প্রতিকারের উপায়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন

হাত বাড়ালেই বনৌষধি, ঋতু সংহারা ‘অশোক’

 

রোগের লক্ষণ ও প্রকারভেদ

কামলা রোগ সাধারণত দু’রকম। প্রথমটি কোষ্ঠাশ্রিত কামলা ও অপরটি শাখাশ্রিত কামলা। যেখানে উদরের অঙ্গগুলি (বিশেষ করে যকৃৎ, পিত্তথলি) ইত্যাদিকে আশ্রয় করে কামলা উৎপন্ন হয় তা কোষ্ঠাশ্রিত কামলা। আর রস-রক্ত-মাংস ইত্যাদি ধাতুকে আশ্রয় করে যে কামলা রোগ দেখা যায় তাকে শাখাশ্রিত কামলা বলা হয়।
 

সাধারণ লক্ষণ

রোগীর চোখ, ত্বক, নাক ও মুখের ভিতরের অবয়ব হলুদ বর্ণ, মল-মূত্র পিত-রক্তবর্ণ হয়। শরীর বর্ষাকালের ব্যাঙের মতো পীতবর্ণ হয়। রোগীর ইন্দ্রিয় শক্তির লোপ পায়। দাহ, বদহজম প্রচণ্ড দুর্বলতা ,অবসাদ, অরুচি, বমি ভাব, খিদে না পাওয়া ইত্যাদি । আর এক ধরনের কামলার উল্লেখ শাস্ত্রে আছে, যা হল কুম্ভ কামলা, সেখানে বলা হয়েছে, যদি ঠিক সময়ে কামলা রোগের চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে কালান্তরে খরিভূত হয়ে কুম্ভ কামলা নামে এক কঠিন দুশ্চিকিৎস্য রোগ আসতে পারে।

যদি পান্ডু রোগীর (অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত) ত্বক হরিৎ-শ্যাব বা পীতবর্ণ হয় এবং বল ও উৎসাহ হারায়, জ্বর, অরুচি, তন্দ্রা ও ফোলাভাব থাকে, তাহলে সেই অবস্থাকে হলীসক রোগ বলে যা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।

আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫০: ‘ফিশ পাস’ পুরোদমে চালু হলে ইলিশের প্রজনন বাধাহীনভাবে সম্ভবপর হবে

চলো যাই ঘুরে আসি: উটাহ: প্রাচীন জলনগরীর রূপকথা

ক্যানসারকে হারিয়ে, কেবল মনের জোরেই আজ ‘জেট সেট গো’-এর মালকিন ৩২-র কণিকা

 

চিকিৎসা

প্রথমত কামলা রোগের উৎপত্তির যে কারণ অর্থাৎ খাদ্য খাওয়ার, পানীয়, আচার ও আচরণ তা পরিবর্জন করতে হবে।

গুলঞ্চপাতা যদি বেটে ঘোলের সঙ্গে খাওয়া যায় তাহলে কামলা সারে।

উদ্ভিজ্জ দ্রব্য হিসেবে ত্রিফলা, দারু হরিদ্রা, নিমের রস মধুর সঙ্গে মেখে খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

ঘৃতকুমারী রস, কাঁকরোল মূলের রস, মধু-সহ খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

চূর্ণ হিসাবে: নবায়স চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার মধু-সহ খাওয়া যাবে।

লৌহ হিসাবে: ধাত্রী লৌহ ৫০০ মিলিগ্রাম দু’বার খাওয়া যেতে পারে।

বিড়ঙ্গাদি লৌহ ৫০০ মিলিগ্রাম দু’বার খাওয়া যেতে পারে।

নবায়স লৌহ ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার খাওয়া যেতে পারে।

অবলেহ বা চেটে খাওয়ার জন্য: আমলকাবলেহ এক চামচ করে দু’বার খাওয়া যায়।

পাচন বা ক্বাথ হিসেবে: বাসাগুড়ুচ্যাদি কষায়ম বা ফলত্রিকাদি কষায়ম ২০ মিলিগ্রাম করে দিনে দু’বার সকাল-সন্ধ্যা খালি পেটে সমপরিমাণ জল-সহ খাওয়া যায়।

ঘৃত হিসাবে: হরিদ্রাদ্য ঘৃত, দ্রাক্ষা ঘৃত, ব্যোষাদ্য ঘৃত ৫ থেকে ১০ মিলিলিটার খাওয়ানো যায়।

রসৌষধি হিসাবে: ত্রৈলোক্য সুন্দর রস, প্রাণবল্লভো রস, পান্ডুসূদনো রস ১২৫ মিলিগ্রাম থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার মধু-সহ খাওয়ানো যায়।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৪: গরম পড়েছে, যত পারুন ঠান্ডা খান! কী হচ্ছে এর ফলে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন

 

পথ্য

পুরাতন যব, গম, পুরাতন চাল, অড়হর, মুসুর-মুগ ডাল, পটল, কুমড়ো, জীবন্তিশাক, হেলেঞ্চা শাক, নটেশাক, বেগুন, তেলাকুচা, শিঙিমাছ, বাতাবি লেবু, আখের রস, অড়হর পাতা ভেজানো জল, হলুদ, রক্ত চন্দন, সংশোধন কর্ম যেমন বিবেচন ক্রিয়া।
 

অপথ্য

ধূমপান, মদ, ঘাম ঝরানো, মৈথুনক্রিয়া, মাষকলাই, দিনে ঘুম, রাত জাগা, তাম্বুল, সরষে, বেশি টক, ঝাল, গরম আহার বা পানীয়।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content