বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি সংগৃহীত।

এদিকে রৈভ্যমুনি পুত্রবধূর অসম্মানে ক্রুদ্ধ হয়ে একটি জটা ছিঁড়ে যজ্ঞীয় অগ্নিতে ফেললেন। সেই আগুন থেকে এক কৃষ্ণবর্ণের নারী উত্পন্ন হল। তারপর তিনি আরও একটি জটা ছিঁড়ে আগুনে ফেললেন। তাতেও এক ভয়ঙ্করদর্শন রাক্ষস উত্পন্ন হল। তারা উত্পন্ন হয়েই রৈভ্যমুনিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘হে মুনিবর! আমাদের কার্য নির্দিষ্ট করে দিন।’ যবক্রীতের বিনাশের ইচ্ছাতেই তাদের সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রুদ্ধ মুনি তাদের সেই কাজেই নিযুক্ত করলেন। রৈভ্যমুনির কামনায় উত্পন্ন সেই নারী যবক্রীতকে মোহগ্রস্ত করে তাঁর কাছ থেকে কমণ্ডলু হরণ করল। যবক্রীত সেইসময় সদ্য ভোজন সমাপ্ত করেছিলেন। উচ্ছিষ্ট মুখ প্রক্ষালনের আগেই তাঁর কাছ থেকে কমণ্ডলু নিয়ে নিল সেই মোহময়ী নারী।

ঠিক সেই মুহূর্তে রাক্ষসটি তাঁকে শূল নিয়ে তাড়া করল। রাক্ষসকে ছুটে আসতে দেখে যবক্রীত যেদিকে সরোবর ছিল সেদিক ছুটে পালাতে গেলেন। কিন্তু সরোবরটি তখন জলশূন্য ছিল। যবক্রীত নদীর দিকে ছুটে গেলেন। নদীগুলিও শুষ্ক ছিল। শূলধারী রাক্ষস তখনো তাড়া করে আসছিল। এবার যবক্রীত ভয় পেলেন। তাঁর মনে হল পিতার যজ্ঞশালাই আশ্রয় নেওয়ার উপযুক্ত স্থান। কিন্তু সেখানে প্রবেশের মুখে দ্বাররক্ষী এক অন্ধ এক শূদ্র যবক্রীতকে সবলে ধরে ফেলল এবং ভিতরে প্রবেশ করতে দিল না। নিরূপায় যবক্রীতকে রাক্ষস এসে তত্ক্ষরনাৎ শূল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করল।
এদিকে ভরদ্বাজমুনি যজ্ঞীয় সমিত সংগ্রহ করে আশ্রমে প্রবেশ করেই তপোদৃষ্টিতে অনুভব করলেন, কিছু একটা অনর্থ হয়েছে। তিনি তখন দ্বাররক্ষী অন্ধ শূদ্রকে উদ্দেশ্য করে বারংবার পুত্রের কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। সেই শূদ্র তখন তাঁকে সমস্ত ঘটনা জানাল। আরও বলল, নিশ্চয়ই আপনার অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন পুত্র স্বভাবকোপন রৈভ্যমুনির গিয়েছিলেন। হয়তো সেখানে ঘটে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রবল রাক্ষসের হাতে এমন অপঘাতে মৃত্যু হল তাঁর।’

ভরদ্বাজ পুত্রের এমন করুণ মৃত্যুসংবাদ শুনে অত্যন্ত শোকগ্রস্ত হলেন। নানাভাবে বিলাপ করতে করতে তিনি বলে উঠলেন, ‘হে পুত্র! না পড়েও ব্রাহ্মণদের হৃদয়ে বেদের ঠাঁই হোক, এমনটাই প্রয়াস ছিল তোমার।’ পুত্রশোকে অন্ধ পিতা বিলাপ করতে লাগলেন, ‘এমন মঙ্গলজনক কাজে তুমি নিরত থাকা সত্ত্বেও মহাতেজা দুর্মতি রৈভ্যের কোপের মুখে পড়লে।’ বন্ধুর কারণে পুত্রের মৃত্যু মেনে নিতে পারলেন না ভরদ্বাজমুনি। পুত্রশোক এবং বন্ধুর ব্যবহার দুইই তাঁকে দগ্ধ করতে লাগল। পুত্রশোকে আকুল হয়ে তিনি প্রাণত্যাগ করবেন বলে মনস্থির করলেন। পুত্রের দাহকার্য সমাধা করে নিজেও জ্বলন্ত আগুনে প্রাণত্যাগ করলেন। তার আগে নিজের প্রিয়সখা রৈভ্যমুনির উদ্দেশ্যে অভিশাপবাণী উচ্চারণ করে গেলেন, ‘আমি যেমন পুত্রশোকে মৃত্যুবরণ করছি, তেমনি রৈভ্যমুনিও নিজের কনিষ্ঠপুত্র পরাবসুকর্তৃক বিনা অপরাধে মৃত্যুবরণ করবেন।’ অভিশাপবাণী উচ্চারণ করে গ্নানিতে তাঁর মন ছেয়ে গেল। অতি মনোকষ্টে তিনি দেহত্যাগ করলেন।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৭: তপোলব্ধ বেদজ্ঞান দর্পী যবক্রীতের বিনাশ ডেকে আনল

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৯: ঋষির আশীর্বাদে যাত্রা এবার গভীর অরণ্যপথে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২: রামকথার পটভূমি এবং মহাভারতে কথকের কথাসূত্র

ঠিক এই সময়েই রৈভ্যমুনির যাজ্য বৃহদ্যুম্ন নামক রাজা এক মস্ত যজ্ঞের আয়োজন করলেন। রাজার ইচ্ছামতো সেই যজ্ঞে পৌরোহিত্য করবার জন্য উপস্থিত হলেন রৈভ্যমুনির দুই পুত্র অর্ব্বাবসু আর পরাবসু। আশ্রমে সেইসময় কেবল রৈভ্যমুনি আর পরাবসুর ভার্যা ছিলেন। তারপর কোনও এক রাতে পরাবসু আশ্রমে প্রবেশ করে মৃগচর্ম্মপরিহিত নিজের পিতাকে দেখতে পেলেন। রাতও যথেষ্ট হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩: ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছিল পঞ্চমের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৭: আপন হতে আপন জন ‘রাইকমল’

এদিকে পরাবসুও যজ্ঞের আয়োজনে ক্লান্ত থাকার ফলে নিদ্রা তাঁর দুই চোখকে আচ্ছন্ন করেছিল। সেহেতু অনিচ্ছাসত্ত্বেও মৃগ ভেবে পিতাকেই হত্যা করে বসলেন। সম্বিত ফিরতে তাঁকে শোক গ্রাস করল। পিতার পারলৌকিক কার্য সমাধা করে তিনি ফিরে এলেন বৃহদ্যুম্ন রাজার যজ্ঞস্থলে। ভ্রাতা অর্ব্বাবসুকে বললেন, ‘হে ভ্রাতঃ! এই মস্ত যজ্ঞের ভার নির্বাহ করা একলা আপনার পক্ষে অসম্ভব। অথচ আমি পিতৃহত্যা করেছি। সুতরাং সে কাজের প্রায়শ্চিত্ত না করলে যজ্ঞকার্যে আমার অধিকার নেই। এমতাবস্থায় আমার কী করণীয় তা আপনি স্থির করে দিন।’
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১১: বন থেকে বনান্তরে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬: দুয়ারে অপচ্ছায়া

হেলদি ডায়েট: বেশি কলা খাওয়ার অভ্যাস কি স্বাস্থ্যকর? মারাত্মক কোনও রোগের কারণ হয়ে উঠবে না তো?

জ্যেষ্ঠ অর্ব্বাবসু ব্রাতাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘হে ভ্রাতঃ! তোমার হয়ে আমিই ব্রহ্মহত্যা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব। তুমি আমার ফিরে আসা অবধি যজ্ঞকার্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখো।’ অর্ব্বাবসু একথা বলে ভ্রাতার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চলে গেলেন। তারপর সবশেষে যখন আবার ফিরে এলেন যজ্ঞক্ষেত্রে, তখনই সেই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল। দৈববশে পরাবসু নিজের দোষের ভার চাপিয়ে দিলেন বড়ভাইয়ের ওপর। রাজার সামনে অপদস্থ হয়েও নিজস্থানে অটল রইলেন মহাতপা অর্ব্বাবসু। ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে তিনি যজ্ঞসভা ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তারপর সূর্য্যদেবের উদ্দেশ্যে কঠোর তপস্যায় ব্রতী হলেন। তাঁর তপস্যায় সূর্য্যদেব সন্তুষ্ট হলেন।

স্বয়ং বেদ প্রকট হলেন অর্ব্বাবসুর হৃদয়ে। সমস্ত দেবতারা অর্ব্বাবসুর প্রতি তুষ্ট হলেন। দেবতারা তাঁকে বর দিতে চাইলে অর্ব্বাবসু একে একে নিজের পিতা রৈভ্যমুনি, ভরদ্বাজ এবং যবক্রীতের জীবন প্রার্থনা করলেন। দেবতাদের উদ্দেশ্যে তিনি আরও বললেন, ‘হে দেবগণ! আমি বিশেষভাবে প্রার্থনা করছি, আমার ভ্রাতা দৈবের অধীন হয়ে যে অন্যায় কাজ করেছে, তার সে দোষ খণ্ডিত হোক। এসকল ঘটনা আর কারও স্মরণে না থাকুক।’ মহাপ্রাণ অর্ব্বাবসুর এ হেন প্রার্থনা দেবতারা ফিরিয়ে দিলেন না। দেবতাদের আশীর্বাদে যবক্রীত যথার্থ বেদজ্ঞানের অধিকারী হলেন।—চলবে
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content