বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


 

রামকথার পটভূমি

মহর্ষি নারদের কাছ থেকে গুণের আধার রামচন্দ্রের যশোগাথা শ্রবণ করে বাল্মীকি অবগাহন স্নানে পরিশুদ্ধ হতে চললেন গঙ্গার নিকটবর্তী তমসা নদীর তীরে। স্বচ্ছতোয়া, তমসার জলটি যে সাধুব্যক্তির মনের মতো অবিলতাহীন নির্মল। নির্মল জলেই যে মন ও শরীর কালিমামুক্ত হয়। ধুয়ে যায় শারীরিক মানসিক ক্লেদ, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, অবসাদ সবকিছু। স্বচ্ছতায় প্রতিবিম্বিত হয় মনের আবেগক্ষরিত আনন্দ, বিষাদ, করুণা, দয়া, আবেগ — সৃজনশীলতার নানান অভিব্যক্তি। সাধুব্যক্তির স্বচ্ছ হৃদয়ের মতো নির্মল তীর্থক্ষেত্রের সন্নিহিত বনস্থলী। সেই শ্যামল, শোভন, সুন্দর পরিবেশে নিষ্ঠুর ব্যাধের শাণিত তীর বিদ্ধ করলো ক্রৌঞ্চকে। লুটিয়ে পরল শরবিদ্ধ দয়িত। ক্রৌঞ্চীর আকুল আর্তিতে করুণায় বিগলিত চিত্ত মহর্ষি বাল্মীকি আবেগ কম্পিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন প্রথম শ্লোক।

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যদি ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকামবধীঃ কামমোহগতম্।।

মিলনে আত্মহারা মিথুনের একটিকে বধ করে নিষাদ যে অন্যায় করেছেন তা বিষাদে আচ্ছন্ন করে তুলল মহান মহাকাব্যকারকে।

মহর্ষি এক অমোঘ অভিশাপ বাণী উচ্চারণ করলেন, হে ব্যাধ, তুমি জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে না।

স্বচ্ছ, নির্মল পরিবেশ দূষিত কলঙ্কিত হল নিষ্ঠুর ব্যাধের আচরণে। পরিবেশ বিনষ্ট হলে তার ফল জনজীবনের প্রতিষ্ঠা, ভারসাম্য বিপর্যয় — সেই বার্তাই কী ধ্বনিত হল না ঋষিকবির সরোষ অভিশাপবার্তায়? প্রশ্ন উঠতে পারে নিষাদের জীবিকা প্রাণীশিকার, তবে? পরিবেশ, পরিস্থিতি নস্যাৎ করে যে রুজিরোজগারের আয়োজন তা কী কোনওমতেই সমর্থনযোগ্য? সঙ্গমরত ক্রৌঞ্চমিথুন গার্হস্থ্য জীবনের পূর্ণতার প্রতীক। অহরহ নৃশংসতার শরসন্ধান বিঘ্নিত করছে, দূষণ ছড়িয়ে দিচ্ছে শান্ত জীবনের স্থিরতায়— এটাই মনে হয় শাশ্বত রামায়ণের চিরন্তন শিক্ষা যা হয়তো এখনও প্রাসঙ্গিক।

ক্রৌঞ্চীর বিষাদ সমগ্র রামায়ণ জুড়ে এক ঘোর বিরহের আবর্ত সৃষ্টি করেছে বার বার। রাম যখনই নিশ্চিন্তে দাম্পত্যজীবন যাপনে মগ্ন হয়েছেন তখনই সীতার বিচ্ছেদবেদনা তাকে দগ্ধ করেছে। রাবণ তাঁকে দীর্ঘ সীতাবিচ্ছেদের অতলান্ত সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছেন, প্রজানুরঞ্জক রাজা সুদূরপ্রসারী লোকনিন্দার প্রভাব মুক্ত হতে চেয়েছিলেন বলেই হয়তো বিশ্বস্ত, অনুরক্ত, দয়িতের ভূমিকায় থাকতে পারেননি। হয়তো ইচ্ছের বিরুদ্ধেই সীতার অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন করেছেন। আবারও স্ত্রীকে লোকনিন্দার ছায়া থেকে মুক্ত করতেই হয়তো সীতানির্বাসনের নির্মম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। বিচ্ছেদের শাণিত তীরে বার বার ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, গার্হস্থ্যজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে তাঁর। অপরিণামদর্শিতার ফল তছনছ করে তোলে জনজীবন। দুঃখ, দুঃখের থমথমে আবহ — পুত্রবিচ্ছেদদুঃখ, অযাচিত পিতৃবিয়োগদুঃখ, নিরন্তর পত্নীবিচ্ছেদবেদনা, পত্নীসান্নিধ্যহীনতার বিধুরতা — দুঃখের এক প্রগাঢ় প্রলেপে আচ্ছন্ন রয়েছে রামায়ণের প্রেক্ষিত। তারই সূচনা কী প্রতীকী ক্রৌঞ্চবধ? আদিকবির কোন শোচনীয় নির্মম অতীত কী তাঁকে দুঃখবোধে আক্রান্ত করে? জানা নেই। যেমন জানা নেই কেন প্রতিমুহূর্তে দুর্ভাগ্যের শিকার হতে চলেছেন গুণনিধি, কর্তব্যপরায়ণ রামচন্দ্র? নিয়তির হাতের পুতুলের মতো বিষাদাচ্ছন্ন, ভারাক্রান্ত, দ্বন্দ্বাতুর মন নিয়ে কেন তাঁকে পারিপার্শ্বিকের প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে বার বার?
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১: আর্ষ মহাকাব্যের স্রষ্টাদ্বয়ের কথা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৮: ভরত কি ফিরবে শূন্য হাতে?

বাল্মীকি রচিত ছন্দোবদ্ধ বাণীটিকে মান্যতা দিলেন ব্রহ্মা। বেদনানিঃসৃত বাণীটি ‘শ্লোক’ নামে অভিহিত হল। ব্রহ্মা জানালেন, তার মানসরসসঞ্জাত এই কবিতা। এ যেন নাদব্রহ্মের অনুমোদন। এই রামায়ণকথায় বিধৃত হবে বাল্মীকির জ্ঞাত অজ্ঞাত সব কিছুর কাব্যিক রূপ যা কখনও অসত্যে পর্যবসিত হবে না।

তচ্চাপ্যবিদিতং সর্বং বিদিতং তে ভবিষ্যতি।
ন তে বাগনৃতা কাব্যে কাচিদত্র ভবিষ্যতি।।


কালান্তরে যুগান্তরে আজও প্রমাণিত সত্য এই যে, নাদব্রহ্মের মতোই শাশ্বত চিরন্তন রামায়ণী কথা, সূর্যপুত্র বৈবস্বত মনুর উত্তরসূরীদের মনে বিবস্বান সূর্যের মতোই কৃষ্টির আলো ছড়িয়ে চলেছে আজও মনে ও মননে।
 

মহাভারতে কথকের কথাসূত্র

মহাভারতের আদিপর্বের পটভূমি নৈমিষারণ্য। নিমেষ যেখানে থমকে দাঁড়ায় কথাস্রোতে। সেখানে ছিলেন গৌরমুখ মুনি। তাঁর কাছে ছিল এক কল্পতরুসদৃশ মণি। এই সুন্দর মণিটির নাম চিন্তামণি। সেই চিন্তামণিকে গায়ের জোরে, পেশীশক্তি দেখিয়ে ছিনিয়ে নিতে এসেছিল ‘দুর্জয়’ দানব। অপাত্রে ন্যস্ত হলে এই মণি তার মাহাত্ম্য হারিয়ে ফেলে বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে, এই সম্ভাবনায় এক নিমেষে দানবকে ভস্মে পরিণত করলেন গৌরমুখ ঋষি। চিন্তাসূত্র বলপূর্বক ছিনিয়ে নেওয়া যায় না। চিন্তার আকর যে মণি সে শুধু গভীর মনের আশ্রয়। অসির থেকেও মননের হাতিয়ার মসী বড় — কে না জানে?

আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৬: প্রাণী জগতের অন্যতম দায়িত্বশীল বাবা হল ড্রাগন ফিশ

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১০: স্থাপত্য ছাড়িয়ে অভয়ারণ্য

স্বাদে-আহ্লাদে: বিকেল হলেই জমিয়ে প্রেম বা আড্ডা, সঙ্গে যদি থাকে ভেজিটেবিল চপ

নৈমিষারণ্যে বক্তা রোমহর্ষণ ঋষির পুত্র সৌতি উগ্রশ্রবা। তিনি এসেছেন ঋষি শৌনকের দ্বাদশবর্ষব্যাপী সত্রে। সত্র বহুজনসম্পাদ্য যাগ। মহান ঋষি শৌনক একজন কুলপতি, দশ হাজার শিষ্যকে ভরণপোষণে, শিক্ষায়, অধ্যাপনায়, সমৃদ্ধ করেন যিনি। বক্তা একজন, তিনি গল্প বলছেন বিশিষ্ট মুনি ঋষিদের অনুরোধে। হয়তো আনুমানিক শ্রোতা, দশ হাজার শৌনক শিষ্য, সমাগত ঋষিমুখ্য, অধ্বর্যু, ঋত্বিক, নাম না জানা প্রখ্যাত মুনি, তপস্বী সকলেই। গল্প শোনার অধিকার যে সকলের।

এ কথকতার আসর গ্রামের চন্ডীমণ্ডপ বা শহুরে দেবস্থানে পৌরাণিক বৃত্তান্তের অবতারণা নয়। মহাভারতকার বলেছেন—

“তস্মিন্ বিস্তীর্ণে সদসি”
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২: ‘আও টুইস্ট করে’ গানের জন্য পঞ্চমের সঙ্গে শচীনকর্তার বাক্যালাপও বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৭: আপন হতে আপন জন ‘রাইকমল’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১০: পেটের গ্যাস সারা দেহেই ঘুরে বেড়ায়!

সেই বিস্তীর্ণ সভায় থুরি কথকতার আসরে পেশাদার কথক ঠাকুর শ্রুতিধর সৌতি উগ্রশ্রবা। তাঁর জাতিগত বৃত্তি যে সারথ্য এবং পৌরাণিক কাহিনীকথন। শুদ্ধচিত্ত মুনিদের এবং রাজর্ষিদের বিচিত্র কাহিনীর উপস্থাপনা থাকবে তার গল্পে, রোমাঞ্চিত হবে শ্রোতৃকুল। সৌতি উগ্রশ্রবা, তিনি যে ‘লোমহর্ষণি’ তাঁর গল্পের ধর্মই যে তাই। পিতা লোমহর্ষণের গল্পে রোমাঞ্চ জাগত যে শ্রোতাদের।

সৌতি, ব্রাহ্মণী মাতা ও ক্ষত্রিয় পিতার সন্তান। সুতবংশীয় তাই সৌতি। উগ্রশ্রবা কেন? উগ্র অতীব শ্রবণ ক্ষমতা তাঁর। তিনি অসামান্য শ্রুতিধর, একবার শুনেই ইতিহাস পুরাণাখ্যায় ভূষিত, মহত্ত্বহেতু এবং গভীরতায় ভারিক্কি যে মহাভারত নামে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ তাকে আদ্যোপান্ত স্মৃতিতে ধরে রাখতে সমর্থ।

মহত্ত্বে গুরুত্বে ত ধ্রিয়মাণং যতোঽধিকম্।
মহত্ত্বাদ্ভারবত্ত্বাচ্চ মহাভারতমুচ্যতে।।
অসামান্য ভারতকথা স্মৃতিতে ধরে রেখে শোনাবেন কী করে? সে যে একটা রত্নাবলি অমূল্য কথামালিকা, তাতে আছে বিচিত্র উপাখ্যান গুঢ়তত্ত্বকথা, ইতিহাস, পুরাণকথার অনন্য রত্নসমূহ।
যে ভারতকথায় চিন্তার প্রাবল্যে মুহূর্তরা স্তব্ধ আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে, ঘটনার পারম্পর্যের অভিঘাতে পলকে প্রেক্ষিত বদলে যায়, কথার গভীরে মূল্যবোধের গাঢ় প্রলেপ পরে, তাত্ত্বিকেরা কথার গহনে মগ্ন হন, গূঢ রহস্যময়তার ঘোরে ভারতমনীষার মননশীল ব্যক্তিত্বরা দার্শনিকতায় আচ্ছন্ন হন, কথাপ্লাবনে ভেসে যায় যুগ যুগান্তরের জনমানস, মুগ্ধ বিষয়ে ভারতসংহিতার রসের সাগরে ডুব দেন ভরতবংশীয়দের উত্তরসূরীরা, আজও।—চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content