ছবি: সংগৃহীত।
বন্দি আর অষ্টাবক্রের পাণ্ডিত্যের সে লড়াইয়ের সাক্ষী রইলেন সভাস্থ সকলে। অবশেষে বন্দির হার হল। তীব্র ইচ্ছাশক্তির জয় হল। উপস্থিত সকলে মুগ্ধ হলেন। অষ্টাবক্রকে ঘিরে তীব্র কোলাহল শুরু হল। সকলে সম্মিলিতভাবে সম্মানিত করলেন সেই জ্ঞানবৃদ্ধকে। এরপরেই অষ্টাবক্র সোচ্চারে সমবেত সকলকে বলে উঠলেন, ‘ইতিপূর্বে যত বিদ্বান ব্রাহ্মণ এই সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিচারসভায় অংশ নিয়েছিলেন, এই বন্দিবেটাই তাদের বিচারে পরাস্ত করে জলে ডুবিয়ে মেরেছে। তাই আজ আমি চাই এই বন্দিবেটাকেও জলে ডুবিয়ে দেওয়া হোক।’ বন্দি অষ্টাবক্রের ক্রুদ্ধ বাণী শুনলেন। তারপর ধীর স্বরে জনকরাজাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ‘হে মহারাজ! আমি বরুণের পুত্র। সুতরাং জলে ডুবে মৃত্যুর ভয় নেই আমার।’ তারপর বন্দী বলে চলেন সেই অজানা আখ্যান। উপস্থিত সকলে তখন নির্বাক শ্রোতা।
রাজা জনকের যজ্ঞ যখন শুরু হয়েছিল, বরুণদেবের বারো বছরব্যাপী সত্রযাগও সেই সময়ে শুরু হয়। বরুণপুত্র বন্দি সেই যজ্ঞে উপস্থিত থাকবার জন্য ব্রাহ্মণদের সেখানে পাঠিয়েছিলেন। সুতরাং সাধারণের দৃষ্টিতে তাকে মৃত্যু বলে বোধ হলেও আসলে তা নয়। বন্দি জানালেন, খুব শীঘ্রই ব্রাহ্মণরা আবার ফিরে আসবেন। এদিকে বন্দির এদিকের কাজও ফুরিয়েছে। হয়তো অষ্টাবক্রের মতো জ্ঞানবৃদ্ধ স্পষ্টবক্তা সত্যদ্রষ্টার দর্শনলাভ বা তাঁর সাথে বিচারে অবতীর্ণ হওয়ার জন্যও বন্দির জনকসভায় থেকে থেকে যাওয়া! বিধাতা যে কোথায় কী নির্ধারণ করে রাখেন তা কেই বা জানে!
আরও পড়ুন:
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৪: জ্ঞানবৃদ্ধ অষ্টাবক্র জনকের রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি পেলেন?
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৫: রাজ সিংহাসন কি মন ভোলাল ভরতের?
বালক অষ্টাবক্র বন্দির কথায় মোটেই ভুললেন না। তিনি জনকের দিকে তাকিয়ে সখেদে বলে উঠলেন, ‘হে রাজন, এই বন্দি চতুর বুদ্ধিদীপ্ত কথায় ভুলিয়ে ব্রাহ্মণদের জলে ডুবিয়েছে, এ কথা সকলে জানে। আবার আমি যেভাবে বয়োজ্যেষ্ঠ বন্দিকে বাকচাতুর্য্যে পরাস্ত করেছি, তাও সভায় উপস্থিত পণ্ডিতেরা প্রত্যক্ষ করেছেন। আপনি এসমস্ত কিছু দেখবার পরেও কীভাবে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে পারেন? আপনার কি কিছুই করণীয় নেই?’ রাজা জনক অষ্টাবক্রকে আগেই চিনতে পেরেছিলেন। বুঝেছিলেন যে এ বড় সহজ বালক নয়। তিনি বলে উঠলেন, ‘হে বালক! বন্দিকে তোমার হাতেই সমর্পণ করলাম। তোমার ইচ্ছাতেই বন্দির ভাগ্য নির্ধারিত হবে।’
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫২: বইয়ের সব কপি কবির নির্দেশে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের সুন্দর মাছ
পিতার অন্তর্ধানের কথা শুনে বালক অষ্টাবক্রের মনে যে দুঃখমিশ্রিত ক্রোধের সঞ্চার হয়েছিল তা এত সহজে যাওয়ার নয়। বন্দিকে জলে নিমজ্জিত না করা অবধি তাঁর শান্তি নেই। বন্দি আবারো বলে উঠলেন, তিনি জলের ছেলে। জলেই বাস। তাই জলে ডোবার ভয় তাঁর নেই। শান্ত কণ্ঠে বন্দি বলে চলেন, ‘হে বালক! তুমি খুব শীঘ্রই তোমার পিতার সঙ্গে মিলিত হবে।’ বন্দির সে কথা সত্য হল। যে সমস্ত ব্রাহ্মণেরা বরুণের রাজ্যে গিয়েছিলেন তাঁরা একে একে ফিরে এলেন জনকরাজার রাজসভায়। সবাই ফিরে শোনালেন সে আশ্চর্য যজ্ঞের কথা, বরুণের আপ্যায়নের কথা।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৭: ঈশ্বরের ভালোবাসার সমুদ্রে ডুব দিলে তবেই ভক্তিরূপ মুক্তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৭: হয় বলো ভালোবাসি, নয় তো ভালোবাসি না!
অষ্টাবক্র মিলিত হলেন পিতা কহোড়ের সঙ্গে। কহোড়ের অভিশাপেই তাঁর শরীরে এই বিকৃতি। আজ পুত্রের জন্য তাঁর পৃথিবীতে আবার ফিরে আসা। আবেগে কহোড়ের চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাঁর সাময়িক অধৈর্যের ফলে যে পুত্রের এমন দৈহিক বিকৃতি, সে আজ বালক বয়সেই জ্ঞানের আধার। পিতার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সে এতটাই কাতর হয়েছে যে অসাধ্যসাধন করেছে। রাজা জনকের সভায় সকলেই বালকের বিদ্যাবত্তায় মুগ্ধ। পিতা কহোড় রাজা জনককে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন, ‘হে রাজন! এমন পুত্রের পিতা হওয়া যেমন ভাগ্যের, এমন পুত্রের জন্য আবার ফিরে আসাও আনন্দের।’
আরও পড়ুন:
স্বাদে-আহ্লাদে: সকালে জলখাবারে থাক নতুনত্ব, বানিয়ে ফেলুন সুস্বাদু পালক পনির পরোটা
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৮: দেখা-অদেখা চেনা-অচেনায় ‘মরণের পরে’
এদিকে বন্দির ফেরার সময় হয়ে এল। রাজা জনককে আশীর্বাদ করে তিনি সমুদ্রে প্রবেশ করলেন। অষ্টাবক্র পিতা কহোড়কে সঙ্গে নিয়ে মাতামহ উদ্দালকের আশ্রমে ফিরে এলেন। আবার সকলে একত্র হলেন। শোনা যায়, কহোড়ের কথায় নদীতে স্নান করবার পর অষ্টাবক্রের দেহের বক্রতা দূর হয়ে যায়। সেই থেকে সেই নদী সমঙ্গা নামে খ্যাত হয়ে আছে।
আরও পড়ুন:
ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে, সামনে পরীক্ষা? চূড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য রইল ১০টি জরুরি পরামর্শ
ছোটদের যত্নে: শিশুকে কোন ওষুধ কখন খাওয়াবেন? ওষুধ খাওয়ার সঠিক নিয়ম কী? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
লোমশমুনি আখ্যান শেষ করে যুধিষ্ঠিরের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বলেন, ‘রাজন! এই সেই সমঙ্গা নদী। এখানেই স্নান করে অষ্টাবক্র স্বাভাবিক হয়েছিলেন। পবিত্র এই নদীতে তোমরা সকলে অবগাহন করো।’ লোমশমুনির আখ্যান শুনে যুধিষ্ঠিরের প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। কর্দ্দমিল নামের ভরতরাজার অভিষেকের স্থানে অবস্থিত সমঙ্গানদীতে তীর্থস্নানের জন্য তৈরি হন তিনি।
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।