‘যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিনী শ্যামা মাকে, মন তুই দেখ আর আমি দেখি আর যেন কেউ নাহি দেখে’—কমলাকান্তের এই গানের তাৎপর্যই বুঝিয়ে দেয়, হৃদয়ে আর সমস্ত বাসনাকে দূরে রেখে, শুধু মাতৃভাব ধারণ করে রাখতে। মনকে কড়া শাসনে রেখে যেন দুই সখি মায়ের আরাধনায় ব্রত হয়েছেন। আর কারও প্রবেশ অধিকার নেই। শ্রীরামকৃষ্ণকে একজন জিজ্ঞাসা করেছে, বিষয় বাসনা কীভাবে দূর করা যায়?
শ্রীঠাকুর বলছেন, “অনন্ত অখণ্ড সচ্চিদানন্দ কোটি কোটি সুখের জমাট বাধা, তাহাকে যাহারা সম্ভোগ করেন তাদের আর বিষয় সুখ ভালো লাগে না। এই সত্য যে, অনন্তসুখ লাভের জন্য সাধনার প্রয়োজন। আমরা প্রতি জন্ম জন্মান্তর ধরে সেজন্য সাধনা করে আসছি। হৃদয় বাসনা সকল নির্মূল হলে, মন স্থির হলে তবে তাঁর দর্শন হয়। কামনা হওয়া হৃদয়ের সরোবরের জলকে স্থির থাকতে দেয় না।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৩: নিয়মিত সাধন ভজন সাধককে ঈশ্বরের স্বরূপ চিনিয়ে দেয়
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৯: গুরুদেবের দেওয়া গুরুদায়িত্ব
শ্রী রামকৃষ্ণ বলছেন— “ছিপ ফেলে ধৈর্য ধরে বসে থাকতে হয়। রাঙা মাথা রুই মাছ ধরার জন্য সময় লাগে। সেই রকম ধৈর্য ধরে সাধনা করা চাই।” দুজনে সব সাধনা করতে গেল কিন্তু একজন ক্ষেপে গেল। অন্যজন মাকে জিজ্ঞাসা করলে, মা ও ক্ষেপে গেল কেন? মা বললেন— “তুই কতবার এমন পাগল হয়েছিলি, তারপর আমার দেখা পেলি।” সাধনা করতে হয়। সাধনায় যেকোনও এক ভাবকে আশ্রয় করতে হয়। ভেক ধরন ভাব আশ্রয়ে সাহায্য করে। ভেক অনেক ক্ষেত্রে সাধককে অনেক বিঘ্ন থেকে রক্ষা করে।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৯: মিশ্র মাছ চাষের অভিনবত্ব
দশভুজা: দু’শো বছর আগে হলে তিনি ইঞ্জিনিয়ারের বদলে সতী হতেন
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন ভেক ধারণ ভালো। গেরুয়া পড়লে ও খোল করতাল নিলে মুখে খেয়াল টপ্পা আসে না। কালো পেড়ে ধুতি পরে বাঁকা সিতে কেটে ছড়ি হাতে করে বেরোলে, নিঘুর টপ্পা গাইতে ইচ্ছে হয়। সাধনার আগুন জাগিয়ে রাখতে হয়। বেঁশো আগুন নিভে যায়, ফুঁ দিয়ে রাখতে হয়। সাধনা সেই রূপ, প্রেম, ভক্তি, বিশ্বাস মুক্তির দিকে নিয়ে যায়। পার্বতী মহাদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ঠাকুর সচ্চিদানন্দ রূপের খেই (অন্ত) কোথায়? মহাদেব বললেন, ‘বিশ্বাস।’ মতে কিছু আসে যায় না, যিনি যে মতে দীক্ষিত হয়েছেন বিশ্বাসের সঙ্গে তারই সাধনা করুন।
আরও পড়ুন:
ইংলিশ টিংলিশ: জেনে নাও Unseen Comprehension এ কীভাবে পাবে ফুল মার্কস এবং পড়বে কোন Phrasal Verbগুলো
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২: এই প্রথম বার মনে হল জীবন কঠিন হতে চলেছে, তাই মনে মনে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম
একজন শ্রীমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, কাশী মঠে থেকে সাধন ভজন করা ভালো, না নির্জনে সাধন ভজন করা ভালো? শ্রীমা বললেন— “নির্জনে ঋষিকেশ প্রভৃতি স্থানে কিছু কাল সাধন ভজন করে মন পাকলে তারপর মনকে যেখানেই রাখো, যে লোকের সঙ্গে মেলামেশা করো একই রূপে থাকবে। যখন চারা থাকে, তখন চারিদিকে বেড়া দিতে হয়। বড় হলে ছাগল গরুতেও কিছু করতে পারে না। নির্জনে সাধন করা খুব দরকার। যখন মনে কোন বিষয় বাসনা হবে তখন একাকী কেঁদে কেঁদে তার নিকট প্রার্থনা করবে তিনি সমস্ত মনের ময়লা ও কষ্ট দূর করে দেবেন, আর বুঝিয়েও দেবেন।”
আরও পড়ুন:
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন: শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়েছে? প্রাকৃতিক উপায়েই সহজে জব্দ হবে এই রোগ, কী ভাবে?
ষাট পেরিয়ে: পর্ব-২৩: শীত হোক বয়স্কদের জন্যও উপভোগ্য/১
নির্জনে সাধন আর একাকী প্রার্থনা সাধকের বিশ্বাসকে অটুট করে। ভগবান তখন না এসে আর থাকতে পারেন না। একজন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসকে জিজ্ঞাসা করছেন, হরির আগমন কী রূপে হয়? পরমহংস বলছেন, “সূর্য উঠবার আগে যেমন অরুণ উদয় হয়, যেমন রাজা কোনও চাকরের বাড়ি যাওয়ার আগে আপনার ভাড়ার হতে বাড়ির সাজসজ্জা ও তার বসবার মতো আসন, খাবার ইত্যাদি পাঠিয়ে দেন। সেই রকম হরি আসার জন্য নিজে সমস্ত জোগাড় করে ভক্তের বাড়িতে আগে সব পাঠিয়ে দেন। প্রেম, ভক্তি, বিশ্বাস আগে তার হৃদয়ে পাঠিয়ে দেন।” অর্থাৎ যেখানে অর্জিত ভক্তি, বিশ্বাস আছে, সেখানেই ভগবান আছেন।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সহ-সচিব, রামকৃষ্ণ মিশন, ন্যন্দি (Nadi), সাউথ প্যাসিফিক (South Pacific), ফিজি (Fiji)।