শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


জ্যোতির্লিঙ্গ বিশ্বনাথ।

একটা সময় ছিল যখন বৃদ্ধ অথবা মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তিরা কাশীবাসী হতেন শিবলোকপ্রাপ্তির আশায়। কাশীর মহিমায় আকৃষ্ট হয়েই হোক অথবা কাশীর পরিবেশের আকর্ষণে বহু বাঙালি এখানে থাকতে শুরু করেন। সেই বিখ্যাত বাঙালিটোলা আজও বাঙালিদের দ্বিতীয় বাসভূমির চিহ্ন হয়ে রয়ে গিয়েছে। তাই তো যখন বাঙলার বাইরে অন্যত্র দুর্গাপূজা মানে নবরাত্রিপূজা, হয়তো বা টিমটিম করে দু চারটে দুর্গাপূজা হয় বাঙালি মহল্লাগুলিতে, সেখানে কাশীতে নবরাত্রিপূজার পাশাপাশি ধূমধাম করে বাঙালিদের দুর্গাপূজাও হয়।
দশমীর দিন বিপুল শোভাযাত্রা আর সপরিবারে মায়ের বিসর্জন দেখবার জন্য জনসমাগম হয়, সেই ভিড়ে দাঁড়ালে হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য মনে হতেই পারে, একি পশ্চিমবঙ্গে রয়েছি নাকি অন্যত্র!

কাশীর গলি, কাশীর পুরানো মহল্লা, পুরানো মন্দিরের আনাচকানাচে ঘুরে বেড়ালে, বদলে যেতে থাকা সত্ত্বেও কাশীর অন্তঃসলিলা সুরতরঙ্গিনী আজও হৃদয়ে অনুভূত হয়, অনূভূত হয় সেই বৈরাগ্য যা বহু ভিড়েও মিলেমিশে রয়েছে। প্রশ্ন জাগে কী সেই রহস্য যার জন্য এতবার ধ্বংস হওয়া সত্ত্বেও টিকে রইল এই অদ্ভুত মন্দির। কেনই বা একে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য প্রয়াসী হয়েছেন এত মানুষ! আড়ম্বর, বৈভব ইত্যাদি তো বাইরের ছবি। সে কাশী পৃথক। সাধনজগতের এ মহাপীঠস্থানে, দেবাদিদেব মহাদেবের প্রিয় এ ভূমিতে আজও লোকচক্ষুর অন্তরালে বহু সাধকের আনাগোনা।
আরও পড়ুন:

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-২: বারাণসীকুলপতি বিশ্বনাথ

ষাট পেরিয়ে, পর্ব-২৩: শীত হোক বয়স্কদের জন্যও উপভোগ্য/১

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩১: অন্ধমুনির অভিশাপ কি ফলল তবে?

সেটা ১১৯২ সালের কথা। কাশীতে তখন রাজত্ব করতেন রাজা জয়চন্দ্র। একটি সূত্রের মতে জয়চন্দ্র আর রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান পরম বন্ধু ছিলেন। জয়চন্দ্রের একমাত্র কন্যাকে পৃথ্বীরাজ তার পিতার অমতে বিবাহ করেন। জয়চন্দ্র এটা একদমই মেনে নিতে পারেননি। ফলত উভয়ে উভয়ের চরম শত্রুতে পরিণত হন। মহম্মদ ঘোরী এই সুযোগই নেন। তিনি প্রথমে পৃথ্বীরাজকে এবং পরে জয়চন্দ্রকে পরাস্ত করেন। এরপরই কাশী মুসলমান শাসকের অধীনে চলে গেল। মহম্মদ ঘোরীর সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবক কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির আর সেইসঙ্গে কাশীর আরও অনেক প্রাচীন মন্দির ধ্বংস করলেন। বিশ্বনাথ মন্দিরের পুরোহিত সম্প্রদায় এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে সেই আঁচ পেয়ে শিবলিঙ্গকে লুকিয়ে রাখেন এক কুয়োর মধ্যে। জ্ঞানবাপীতে প্রসিদ্ধ সে কুয়ো আজও রয়েছে।
আরও পড়ুন:

ডায়েট ফটাফট: সানস্ক্রিন মাখবেন তো বটেই, এবার খেয়েও দেখুন—সিঙ্গল ইনভেস্টমেন্টে ডবল প্রফিট!

ইংলিশ টিংলিশ: মাধ্যমিকে ইংরেজিতে ভালো নম্বর পাওয়ার উপায় কি? দেখে নাও আজকের বিষয়: Seen Comprehension

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৮: মাছের ডিম বার্ধক্যের ছাপ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়! মাছের ডিমের এই অবাক করা গুণের কথা জানতেন?

এরও বারো বছর পর আবার নতুন মন্দির গড়ে তোলা হল বস্তূপাল নামে এক গুজরাতি ব্যবসায়ীর পৃষ্ঠপোষকতায়। পুনরায় সেই নতুন মন্দিরে জ্যোতির্লিঙ্গকে স্থাপন করা হল। কাশীর মাথার ওপর থেকে দুর্যোগের অশনিসংকেত এত সহজে মুছে যায়নি। ঝড় এলো আবার। এবার অন্যরকম ভাবে। ধনী এবং ধার্মিক বাবা মায়ের সন্তান ছিল কালাচাঁদ মুখোপাধ্যায়। ছেলেবেলাতেই তার পিতৃমাতৃবিয়োগ হয়। পড়শি এক মহিলার কাছে কালাচাঁদ যে রাজু নামেই পরিচিত ছিল, সে বড় হয়ে উঠতে থাকে। এদিকে তার বিপুল পৈতৃক সম্পত্তির প্রতি জ্ঞাতিদের ভীষণ লোভ ছিল। তারা নানানভাবে রাজুকে উত্যক্ত করতে থাকে। একসময় সেইসব জ্ঞাতিদের প্ররোচনায় ওই অঞ্চলের ব্রাহ্মণকুলও রাজুর ওপর নিপীড়ন শুরু করে। ধীরে ধীরে রাজুর মনে ব্রাহ্মণ সমাজের প্রতি, হিন্দুধর্মের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ তৈরি হয়।

গঙ্গাতীরে সন্ধ্যারতি দেখতে জনজোয়ার।

একদিন সে ধর্মত্যাগী হয়ে গৃহত্যাগী হয়। মনে মনে সে একটাই ইচ্ছে পোষণ করতে থাকে যে যাবতীয় হিন্দু মন্দির, দেবতার মূর্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে তছনছ করে দেবে। হিন্দুদের ধর্মনগরীকে কাশীকে লক্ষ্য করে একদিন সে কাশীতেও এসে উপস্থিত হয়। বিশ্বনাথের মন্দিরের ওপর আবার আঘাত নেমে আসে। কালাচাঁদ তখন কালাপাহাড় নামে পরিচিত। সে হিন্দু বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের কাছে ত্রাসস্বরূপ হয়ে ওঠে। কাশীর পুরোহিতেরা কালাপাহাড়ের কাশী আক্রমণে খবর আগাম জানতে পেরে তড়িঘড়ি জ্যোতির্লিঙ্গকে জ্ঞানবাপীর কুয়োতে স্থানান্তরিত করেন।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-গন্ধে: মুরগির ঝোল কিংবা ঝাল নয়, এবার বানিয়ে ফেলুন দই মুরগি

বিচিত্রের বৈচিত্র্য: নাম রেখেছি বনলতা…/১

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৮: খোকা নয়, খুকি নয়

এরপর কালাপাহাড়ের আক্রমণে কাশী শ্মশানের রূপ নেয়। সেদিন সন্ধ্যে নেমে এসেছে। কালাপাহাড়ের পাঠান সৈন্যরা তখনো ধ্বংসলীলায় মত্ত। এক প্রৌঢ়া আলুথালু বেশে এসে দাঁড়ালেন কাশীর বিশ্বনাথের মন্দিরের দুয়ারে। একদৃষ্টিতে তিনি চেয়ে রইলেন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের দিকে। তারপর চাইলেন কালাপাহাড়ের দিকে। দু’ চোখে তাঁর তীব্র ঘৃণা। না, কালাপাহাড় চিনতে ভুল করল না নিজের পালিকা মাতাকে। তাঁর এই ঘৃণার দৃষ্টি সে সহ্য করতে পারল না। মাথা নীচু করে ফেলল। আর সেই প্রৌঢ়া কালাপাহাড়ের সামনেই নিজের কাপড়ের মধ্যে থেকে ছুরি বের করে নিজের বুকে বসিয়ে দিলেন। রক্তাক্ত দেহ বিশ্বনাথের মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের সামনে ঢলে পড়ল। কালাপাহাড় এ দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। একদৃষ্টে সেই প্রৌঢ়ার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবেই কেটে গেল। সে রাতের পর থেকে কালাপাহাড়কে আর কেউ কখনও দেখতে পায়নি।

গঙ্গাতীরে বারাণসী।

এরপর কেটে গেল আরও বহু বছর। সম্রাট আকবর এই মন্দির আবার তৈরি করবার জন্য অর্থসাহায্য দিলেন। জ্ঞানবাপীর কুয়োর কছে তৈরী হল নতুন মন্দির। কিন্তু সে মন্দিরও ঔরঙ্গজেব ধ্বংস করতে উদ্যত হলেন। ঔরঙ্গজেব একে ভেঙে ফেললেন না। তবে তাঁর নির্দেশে বিশ্বনাথ মন্দিরের চুড়ো ভেঙে মসজিদ তৈরি করা হল। আজ মন্দিরটিকে যে রূপে আমরা দেখতে পাই তার রূপায়ণে মূল ভূমিকা ইন্দোরের রানি অহল্যাবাঈ এর। পরবর্তীকালে পঞ্জাবকেশরী রণজিত সিং মন্দিরের চুড়ো সোনা দিয়ে মুড়ে দেন। একটা প্রশ্ন থেকেই গেল, মন্দিরে যে লিঙ্গকে দেখতে পাই তিনিই কি আসল জ্যোতির্লিঙ্গ? নাকি আজও তিনি জ্ঞানবাপীর কূপেই রয়ে গিয়েছেন।—চলবে

ছবি: লেখক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.co

* জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে (Jyotirlinga – Travel) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content