বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

দৃশ্যটা এক বিয়েবাড়ির। শেষ পাতে দই পড়েছে। আমার পাশে বসা এক প্রৌঢ় বেশ চেটেপুটে দই খাচ্ছেন। আর মাঝে মাঝে খাচ্ছেন তাঁর পাশে বসা সহধর্মিনীর কনুই-এর গুঁতো। গুঁতোর চোটে মাঝে মাঝে আমার দিকে হেলে পড়ছেন। কিন্তু তৃপ্তি সহকারে দই খাওয়ার কোনও বিরাম নেই। অবশেষে রহস্য ভেদ হল প্রৌঢ়ার চাপা কণ্ঠের শাসানি শুনে। ‘দুকাল গিয়ে তিন কালে ঠেকল, এখনও লোভ কমে না। বলি দই খেয়ে কি গলা ভাঙবে, ঠান্ডা লেগে নিমোনি হলে সামলাবে কে!’ বলাবাহুল্য তারপর আর দই খাওয়ার সাহস হয়নি ওই প্রৌঢ়ের।
শুধু ওই প্রৌঢ়র নয়, আমাদের অনেকেরই ধারণা, যে কোনও টক জিনিস খেলেই নাকি গলা ভাঙবে কিংবা ঠান্ডা লাগবে! এই তালিকায় আছে দই, নানা ধরনের লেবু, কলা ইত্যাদি। কিন্তু সত্যিই কি তাই ঘটে!

কোনও খাদ্যবস্তু টক লাগে তার মধ্যে অ্যাসিডের উপস্থিতির জন্য। দুধ থেকে দই হয়। দুধের ল্যাকটোজ দইয়ে ল্যাকটিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়। কমলালেবু কিংবা পাতি লেবুতে থাকে সাইট্রিক অ্যাসিড। এছাড়া অন্যান্য ফল যেমন আপেল, ন্যাসপাতিতে থাকে ম্যালিক অ্যাসিড।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২: ন্যাড়া মাথায় ভালো চুল গজায়?

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-২৫: বাঘা আমায় এঁকে দিয়েছিলেন ছবি, গুপি ঠেলেছিলেন আমার গাড়ি

এই সব নানা ধরনের অ্যাসিড পাকস্থলীর সোডিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদির সঙ্গে মিলে নানা যৌগ তৈরি করে। পাকস্থলীতে উপস্থিত হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের অ্যাসিডিটি বা অম্লত্ব এইসব যৌগের ফলে অনেকটাই কমে যায়। এই সব অ্যাসিডের সঙ্গে গলাভাঙা বা ঠান্ডা লাগা কিংবা অ্যাসিড বেড়ে যাবার কোনও সম্পর্কই নেই।

ফ্রিজের যে কোনও ঠান্ডা জিনিস খেলেই গলা ভাঙতে পারে, ঠান্ডা লাগতে পারে। এ জন্য শুধু দইকে দোষ দিয়ে লাভ কি? ভাত, ডাল, দুধ, জল; যে কোনও খাদ্যবস্তু থেকেই তো এমনটা হতে পারে। দায়ী তো খাদ্যবস্তু নয়, দায়ী তার অত্যধিক কম তাপমাত্রা। কাজেই ফ্রিজ ঠান্ডা নয়, এমন দই খেলে গলা ভাঙবে কেন!
আরও পড়ুন:

স্বাদে-গন্ধে: মুরগির ঝোল কিংবা ঝাল নয়, এবার বানিয়ে ফেলুন দই মুরগি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৮: খোকা নয়, খুকি নয়

কলা খুব পুষ্টিকর অথচ সস্তা খাদ্য। এতে প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বহাইড্রেট, লোহা, বিভিন্ন ভিটামিন ছাড়াও পেকটিন এবং ফাইভ এইচ টি নামে দুটো রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যারা দেহের পক্ষে খুবই উপকারি। বিভিন্ন লেবুতেও প্রচুর পুষ্টিকর উপাদান আছে। ভিটামিন-সি তো আছেই। কাজেই ঠান্ডা লাগার ভয়ে এদের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া রীতিমতো মুর্খামি।

অনেকে আবার দিনের বেলায় খাওয়া নিরাপদ মনে করলেও, রাতে টক জাতীয় জিনিস খেতে ভয় পান। এটিও নিতান্তই ভুল ধারণা। বিয়ে বাড়িতে ভুরিভোজের শেষে অনেকেই এক গ্লাস জলে একটা পাতিলেবু চটকে পান করেন। এর ফলে অম্বল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। মনে হতে পারে, লেবুও তো অ্যাসিড, অ্যাসিড খেলাম অথচ অ্যাসিডিটি বেড়ে না গিয়ে কমে গেল, এ কেমন রহস্য! লেখার শুরুতেই এই রহস্য ভেদ করেছি, কাজেই পুনরাবৃত্তি নিরর্থক।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২: এই প্রথম বার মনে হল জীবন কঠিন হতে চলেছে, তাই মনে মনে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম

বিচিত্রের বৈচিত্র্য: নাম রেখেছি বনলতা…/১

এত সব জানার পর নিশ্চয়ই সেই প্রৌঢ়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে, রাগ হচ্ছে সেই প্রৌঢ়র উপরে। আসলে আমাদের অজ্ঞানতাই তো নানা ভুল ধারণাকে সযত্নে লালন করে থাকে। সেজন্য দেখি কোনও তরুণ শিল্পী গলায় সর্বদা মাফলার জড়িয়ে থাকেন। দই, কলা বা লেবু অর্থাৎ কোনও পুষ্টিকর খাবারই ভুলেও স্পর্শ করেন না। অথচ পুড়ুক পুড়ুক করে দিনে খান কুড়ি সিগারেট টানেন। এর গলার বারোটা বাজবে না তো কার বাঁচবে!
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক।

Skip to content