রবিবার ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

অযোধ্যাপুরী আঁধার করে সেখান থেকে বনের পথে চলে গিয়েছেন সকলের প্রিয় রাজকুমার রাম, তাঁর সঙ্গ নিয়েছেন পত্নী সীতা, অনুজ লক্ষ্মণ। গঙ্গাতটে তাঁদের রেখে রথ নিয়ে ফিরে এসেছেন সুমন্ত্র। সুমন্ত্রকে দেখে পুত্রবিরহে কৌশল্যার শোক, তাপ, অভিমান আছড়ে পড়ল রাজা দশরথের উপর। দশরথ শোকে অনুতাপে লজ্জায় ক্ষমা চাইলেন পুত্রব্যথায় অস্থির অসহায় পত্নীর কাছে—“দেবী, আমি খুব কাতর হয়ে তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, তুমি আমার এ অনুচিত কাজ ক্ষমা করে দাও। পুত্রশোকে আমিও অস্থির। তোমার কাছে হাতজোড় করে অনুনয় করছি, আমার বুকের গভীর ক্ষতে তুমি আর ক্ষার লেপন কোরও না।”

রাজার অনুনয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হলেন কৌশল্যা। ক্ষমা চাইলেন তিনিও রাজার কাছে—“মহারাজ, পুত্রশোকে কত অন্যায় কথাই যে বলে ফেলেছি আপনাকে। শোক আসলে সব কিছু নষ্ট করে দেয়। শোক প্রজ্ঞা নষ্ট করে, শাস্ত্রজ্ঞান নষ্ট করে, ধৈর্য নষ্ট করে। শোকের মতো আর শত্রু নেই মহারাজ! আমার ছেলে চলে গিয়েছে আজ পাঁচ দিন হল। আমার মনে হচ্ছে যেন একশ বছর পার হয়ে গিয়েছে। এ শোকের যে পার দেখি না।” কথায়, ব্যথায় প্রশমিত হল যেন শোকের আগুন। ক্লান্ত, স্তিমিত হৃদয়ে অবসন্ন রাজা তলিয়ে গেলেন নিদ্রার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। কিন্তু নিদ্রা তো চিরস্থায়ী আশ্রয় নয়! তাই শোক থেকে সাময়িক শান্তিটুকু মেলে হয়তো। কিন্তু তারপর আবার জাগরণ, আবার অনন্ত বেদনা শোকতপ্ত রাজার হৃদয় ছিঁড়ে টুকরো করে। আকাশে রাহুগ্রস্ত সূর্যকে যেমন অন্ধকার গ্রাস করে, তেমনই রাম লক্ষ্মণ সীতার নির্বাসনের অসহ্য শোক ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমী দশরথকেও অভিভূত করতে থাকে।
নির্বাসনের ষষ্ঠ দিন। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল রাজা দশরথের। রাতের আকাশে বিদ্যুতের ঝলকের মতো জেগে উঠল বহুদিন আগের এক শোকচিত্র। অস্থির হয়ে কৌশল্যাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন রাজা। “কৌশল্যা, জেগে আছ? শুনতে পাচ্ছ? মন দিয়ে শোনো আমার কথা। মানুষ নিজে যেমন ভাল-মন্দ কাজ করে, তেমনই ফল পায়। আমারও সেই দশা রানি। আমি তো আমার কৃতকর্মেরই ফল পাচ্ছি আজ। দুর্মতি হয়ে আমের বন ছেড়ে পলাশবনে জল সেচন করেছি। পরিণামের কথা ভাবিনি। কৈকেয়ীর কথায় রামকে নির্বাসনে পাঠিয়ে এখন সে শোক আর সহ্য করতে পারছি না। কিন্তু এ বুঝি আমার প্রাপ্যই ছিল।

সে এক ঘটনা। বহুকাল আগের। তুমি তখনও রানি হয়ে আসনি। অল্প বয়স আমার, সদ্য যুবরাজ হয়েছি। পিতা তখন বেঁচে ছিলেন। ধনুর্ধর আর শব্দবেধী বলে আমার ভারি খ্যাতি তখন। নিজেও এ নিয়ে গর্বিত ছিলাম যথেষ্ট। সেই তরুণ বয়সে শিকারের উন্মাদনায় ছুটে যেতাম প্রায়ই অরণ্যে। একবার বর্ষা এল। দিগন্ত ঢেকে গেল কাজলকালো সজল মেঘে। গ্রীষ্মের দাবদাহ স্নিগ্ধ হল অঝোর বৃষ্টিধারায়। নদীতে বান ডাকল। কূলহারা স্রোতে ভরে উঠল নদীর বুক। চারপাশে জলে ভরা সবুজ শস্যক্ষেত। ময়ূরের কেকারবে যেন খুশি ঝরে পড়ছে। বৃষ্টির জল পেয়ে বক, চাতক, আরও কত পশুপাখির কলকোলাহলে পরিপূর্ণ জগৎসংসার। এমন বৃষ্টির দিনে আমার মনও খুশিতে নেচে উঠল। শব্দ শুনে লক্ষ্যভেদ করার অভ্যাস করতে ভালোবাসতাম তখন। রাতের অন্ধকারে শিকারে চললাম পিঠে তূণীর বেঁধে, হাতে নিয়ে ধনুর্বাণ। বর্ষার জলে ভরা সরযূ ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে। গেলাম তার নির্জন তীরে। রাতের বেলায় নদীতে জল খেতে আসে হাতিরা, বুনো মহিষের দল, হরিণের দল। নদীখাতের একপাশে আড়ালে অপেক্ষা করতে লাগলাম তাদের শিকারের জন্য।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩০: শেষ পর্যন্ত ভগ্নদূত সুমন্ত্র কী বার্তা এনে দিলেন?

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৯: চ্যবনমুনির প্রভাবে দেবরাজ হার মানলেন, সোমের ভাগ পেলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয়

চারপাশে ঘনঘোর অন্ধকার। এর মধ্যে তারা জল খেতে নামলেই শব্দ শুনে তীর ছুঁড়বো— এমন আশায় বুক বেঁধে বসে আছি। হঠাৎ কানে এল হাতির বৃংহণধ্বনি। তৈরি হয়েই ছিলাম। তীক্ষ্ণ তীর ধনুকে সংযোজন করে শব্দের উৎসস্থান লক্ষ্য করে অন্ধকারেই নিক্ষেপ করলাম। আর তারপরেই কানে ভেসে এল মানুষের গলায় তীব্র করুণ আর্তনাদ —“আমাদের মতো নির্দোষ তপস্বীদেরও লোকে অস্ত্র ছোঁড়ে? কোন নৃশংস লোকের কাজ এটা? রাতের বেলা জনশূন্য নদীতে জল নিতে এসেছি, আমি তো কারো ক্ষতি করিনি!” চমকে উঠে ছুটে গেলাম।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি এক মুনিকুমার জলের মধ্যে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। বুকে তাঁর বিঁধে আছে আমারই ধনুক থেকে ছুটে যাওয়া বাণ! তাঁর বিলাপ যেন বুকে এসে বিঁধল আমার—“অন্ধ পিতামাতার পুত্র আমি। বনের মধ্যে বাস তাঁদের। বনের ফলমূল, নদীর জলে জীবন রক্ষা হয় তাঁদের। আজ থেকে কে তাঁদের কাছে পৌঁছে দেবে এসব? আমার প্রাণ চলে যাবে তার জন্য দুঃখ নয়, আমার বৃদ্ধ, অসহায় পিতামাতার কি গতি হবে এ ভেবে অস্থির হয়ে যাচ্ছি আমি। আমাকে বধ করে সেই দুরাত্মা তো তাঁদেরই প্রাণ কেড়ে নিল।”
আরও পড়ুন:

স্বাদে-গন্ধে: একঘেয়ে কাতলা? স্বাদবদল করুন ‘কমলা কাতলা’ রেসিপিতে! রইল সহজ রেসিপি

ইংলিশ টিংলিশ: মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা সহজে শিখে নাও Transformation of Sentences by changing the DEGREES of Adjectives

হায়! হায়! এ কী করলাম আমি! লজ্জায়, অনুতাপে, অধর্মের ভয়ে আমার হাত থেকে অজান্তেই খসে পড়ল ধনুক। আমি তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম। তীরের আঘাতে বুকের মাঝখানে গভীর ক্ষত হয়েছে। তাঁর ওঠার শক্তি নেই আর। কিন্তু দুই চোখে আমাকে যেন দগ্ধ করে দিতে চাইলেন— “নীচ, পাপিষ্ঠ আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি যে তুমি আমাকে এভাবে হত্যা করলে? আর তুমি তো আসলে একসঙ্গে তিনজনকে হত্যা করলে। তোমাকে যাতে আমার ক্রুদ্ধ পিতা শাপ না দেন, তার জন্য তাড়াতাড়ি করে পিতার কাছে গিয়ে তুমি সব ঘটনা খুলে বল। আর আমাকে তুমি এই তীক্ষ্ণ শরের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও। বুকের মধ্যে মনে হচ্ছে যেন বজ্রের আগুনের মতো দহন। শরমুক্ত করে আমার প্রাণবায়ুকে বেরোতে দাও। চিন্তা করোনা, তোমার ব্রহ্মহত্যার পাপ হবে না। আমি বৈশ্য পিতা ও শূদ্রা মায়ের সন্তান।” কোনওক্রমে আশ্রমের পথটি দেখিয়ে দিয়ে তিনি আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। আমি তাঁর আদেশ মতো বুকের ক্ষত থেকে জোর দিয়ে বাণটি তুলে নিলাম। সেই মুহুর্তেই একবার প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে ছটফট করতে করতে মুনিকুমার প্রাণত্যাগ করলেন। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নদীর তীরে কিছুক্ষণ বিষণ্ণ হয়ে বসে রইলাম। আমার সব যশ, গর্ব, অহংকার যেন মুনিকুমার নিজের প্রাণের সঙ্গেই নিয়ে চলে গেলেন। সেই তারুণ্যে ভরা জীবনে সেদিন প্রথম এত বিষাদ গ্রাস করল আমাকে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১: পৃথিবী খ্যাত ডালটন হাইওয়ে এই শহরকে ছুঁয়েছে আর্কটিক বৃত্ত তথা উত্তরমেরুর সঙ্গে

পছন্দের ফেস প্যাক কয়েক মাসেই নষ্ট হয়ে গেল? কী ভাবে রাখলে তার আয়ু বাড়বে?

কিছু সময় পরে ধীরে ধীরে আত্মস্থ হলাম। নিজের কর্তব্য বোধ জেগে উঠল। মুনির নির্দেশ দেওয়া পথ ধরে জলের কলসটি নিয়ে তাঁর পিতামাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। গিয়ে দেখলাম পুত্রের জল নিয়ে আসার পথ চেয়ে দুই অসহায় অন্ধ পিতামাতা বসে রয়েছেন। পায়ের শব্দ হতেই মুনি বললেন— “বৎস যজ্ঞদত্ত, জল আনতে তোমার এত দেরি কেন আজ? অনেকক্ষণ জলে খেলা করেছ, আর দেরি করো না। চলে এসো। তোমার মা আর আমি চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। তুমি কোনো কথা বলছ না কেন পুত্র?” পুত্রের পথ চেয়ে বসে থাকা অন্ধ মুনিদম্পতিকে কি বলে সান্ত্বনা দেব, তা আর স্থির করতে পারছিলাম না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ধীরে ধীরে নিজের পরিচয় দিলাম। হাতজোড় করে, মাথা নিচু করে সব ঘটনা খুলে বললাম তাঁদের। আকস্মিক পুত্রশোকের আঘাতে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন তাঁরা। তারপর জ্ঞান ফিরলে মুনিবর আমাকে বললেন— তুমি জ্ঞানত যদি আমার পুত্রকে হত্যা করতে তাহলে এতক্ষণে তোমার রঘুবংশের আর অস্তিত্ব থাকত না। কিন্তু তুমি অজ্ঞানতাবশত এ অন্যায় কাজ করেছ। তাই তোমার কুল ধ্বংস হবে না।”

তাঁদের অনুরোধে নিয়ে গেলাম সরযূর তীরে, পুত্রের মৃতদেহের কাছে। তাঁদের সে বিলাপ, আর্তনাদ আজ আবার আমার কানে যেন ভেসে আসছে রানি, পুত্রশোকাতুর অন্ধ মা ছেলের মুখখানি শেষ চুম্বনে ভরিয়ে দিচ্ছেন— এ দৃশ্য আমাকে বিদ্ধ করছে আজ আবার। পুত্রের তর্পণাদি ক্রিয়া শেষ করে সেই বৃদ্ধ মুনি আমাকে বললেন—“নরাধম, দুর্বিনীত, তুমি কীভাবে এই বিখ্যাত ইক্ষ্বাকুকুলে জন্ম নিলে জানিনা। তোমার সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতাই নেই। তাও যে কেন তুমি আমাদের তিনজনকে একবাণে হত্যা করলে কে জানে! যেহেতু তুমি অজ্ঞানবশে এ কাজ করেছ, তাই আমি তোমাকে ভস্ম করব না। কিন্তু তোমারও আমার মতো বৃদ্ধ বয়সে পুত্রশোকে মৃত্যু হবে। এই বলে সেই মুনিদম্পতি চিতায় উঠে দেহত্যাগ করলেন। অভিশাপের বোঝা মাথায় নিয়ে আমিও রাজপুরীতে ফিরে এলাম।
তারপর বহু দিন কেটে গিয়েছে। কৌশল্যা, আজ বুঝি সেই দিন এসেছে। আমি যে আর দুচোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। স্মৃতি যেন লোপ পাচ্ছে। মনে হচ্ছে রামের কাছে একবার যদি যেতে পারতাম, বড় শান্তি পেতাম। রানি, আমি কি রামের মুখ না দেখেই চলে যাবো?” কথায় কথায় রাতভোর হয়ে এল। কথা থেমে এল ক্রমে। কৌশল্যার চোখে ঘুম নেমে এল। আর পৃথিবীপতি দশরথ পৃথিবীর কোল ছেড়ে, পার্থিব রাজ্য ছেড়ে যাত্রা করলেন অস্তাচলের দেশে।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content