শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


স্টার থিয়েটার।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে বহুদিন কাটিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র। তাঁকে কাছ থেকে দেখেছিলেন বহুদিন। সেই ভাবটিকে বজায় রেখে তিনি লিখলেন একটি নাটক ‘নসীরাম’। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভাবকে মূর্তি মন্ত্র করে নসীরাম চরিত্রটি গঠিত হয়েছিল। গিরিশচন্দ্রের লেখা ‘নসীরাম’ নাটক নিয়ে ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৫ সাল (ইংরেজি ২৫ মে, ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দ) ফুলদোলের দিন হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারের মহাসমারোহে প্রথম খোলা হয়েছিল। গিরিশচন্দ্র সেই সময়ে এমারেল্ড থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই জন্য তিনি ‘নসীরাম’ নাটকটি তাঁর নামে প্রকাশ করতে পারেননি। আইনগত জটিলতার জন্য তিনি ‘সেবক প্রণীত’ বলে বিজ্ঞাপিত করেছিলেন ‘নসীরাম’ নাটকটিকে।

গিরিশচন্দ্র ঘোষ।

গিরিশচন্দ্র পূর্বে স্টার থিয়েটারের জন্য ‘পূর্ণচন্দ্র’ নাটকটা লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু এমারেল্ড থিয়েটারের যোগদান করে দেখলেন থিয়েটারে নতুন নাটকের বিশেষ প্রয়োজন। গোপাললালবাবু নতুন নাটকের জন্য বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। গিরিশ চন্দ্র স্টার থিয়েটারের স্বত্বাধিকারীগণের কাছ থেকে পূর্ণচন্দ্র নাটকের পাণ্ডুলিপি নিয়ে এমারেল্ড থিয়েটারে দিয়ে দিলেন এবং সেই সঙ্গে তিনি প্রতিশ্রুত হলেন তাঁদের নব প্রতিষ্ঠিত স্টার থিয়েটারে জন্য একটি নতুন নাটক লিখে দেবেন। সেই সূত্রেই তিনি লিখলেন ‘নসীরাম’।
চৈতন্যলীলা অভিনয়ের অভাবনীয় সাফল্য লাভের পর স্টার থিয়েটারের স্বত্বাধিকারীগণ গিরিশচন্দ্রের কাছে হরি ভক্তিপূর্ণ একটি নাটক লিখে দেওয়ার জন্য খুব করে অনুরোধ করেন। গিরিশচন্দ্র তাঁদের অনুরোধে রামকৃষ্ণদেবের ভাব গ্রহণ করে একটি ভগবত মূলক নাটক লিখে দিয়েছিলেন। সেটিই হল ‘নসীরাম’।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-২৫: গিরিশচন্দ্র ঘোষ অভিনীত ও পরিচালিত ‘সীতারাম’ দর্শকদের বেশি আকৃষ্ট করেছিল

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২২: রাইচরণ চরিত্রটা আমি করতে চাই, আমাকে এই চরিত্রটা করার সুযোগ দিন: উত্তমকুমার

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৬: সংসার সুখের হয় ‘চাঁপাডাঙার বৌ’-র গুণে

গিরিশচন্দ্র রচিত একটি প্রস্তাবনা কবিতা স্বয়ং নাট্যাচার্য অমৃতলাল বসু পড়ে দেন। “হে সজ্জন পদে নিবেদন—নির্বাসিত মনোদুঃখে, বঞ্চিলাম অধোমুখে/ বঞ্চিত বাঞ্চিত তব চরণ বন্দন। /যুগ যুগবর্ষের ভ্রমণ-আজি পুনঃ পূর্ণ আকিঞ্চন /স্বাগত সুজন।” প্রথম অভিনয় রজনীতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নসীরামের ভূমিকায় অমৃত লাল বসু। যোগেশনাথের ভূমিকায় উপেন্দ্রনাথ মিত্র। অনাথনাথের চরিত্রে অমৃতলাল মিত্র। কাপালিকের ভূমিকায় অঘোরনাথ পাঠক। শম্ভুনাথের চরিত্রে অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়। পাহাড়িয়া বালকের চরিত্রে তারাসুন্দরী।

অমৃতলাল বসু।

প্রতিভাময়ী এই অভিনেত্রী তারা সুন্দরী পাহাড়িয়া বালকের ভূমিকায় একটিমাত্র কথা “ওরে হরিবল, নইলে কথা কি কইবে না” নিয়ে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে প্রথম অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এছাড়াও ছিলেন বিরজা চরিত্রে কাদম্বিনী। মাধুরী চরিত্রে হরিমতি। সোনার চরিত্রে গঙ্গামনি। এই নাটকে সংগীত পরিচালক হলেন রামতারণ সান্যাল। নৃত্যশিক্ষক হলেন কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়। মেকাপের দায়িত্বে ছিলেন দাসুচরণ নিয়োগী।
আরও পড়ুন:

পাহাড়ের উপর ছবির মতো সুন্দর শ্রবণবেলাগোলা— চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের এক অজানা অধ্যায়

উৎসব দিনে চট জলদি বানিয়ে ফেলুন স্বাদে ও গন্ধে ভরপুর চাইনিজ স্টাইলে গার্লিক চিকেন

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৮: অযোধ্যাবাসীরাও কি সঙ্গী বনযাত্রায়?

অভিনেতা অভিনেত্রীরা যথাসাধ্যমত অভিনয় করলেও নসীরাম প্রথম দিকে সর্বসাধারণের মনোহরণে সমর্থ হয়নি। চিন্তাশীল দর্শকেরা নিয়েছিলেন খুব নিয়েছিলেন নাটকটি। কিন্তু সাধারণ দর্শক সেই ভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভাবকে মূর্তিমন্ত করে নসীরাম চরিত্রটা এখানে তৈরি হয়েছে। সেই সময় পরমহংসদেবের বাণী সাধারণ মধ্যে ততটা প্রচারিত হয়নি। বোধহয় এই ভাব গ্রহণের অক্ষমতাই এর প্রধান কারণ। ক্রমে ক্রমে ঠাকুর পরমহংসদেবের সম্বন্ধে নানান গ্রন্থে প্রচারিত হতে লাগলো।

তারাসুন্দরী।

কয়েক বছর পরে পুনরায় স্টার থিয়েটারে নসীরাম নাটকের অভিনয় হয়েছিল। সেই সময় নাটকটি খুব জমেছিল। এই নাটকের গানগুলির বিশেষ করে সোনা চরিত্রের গানগুলোর কোন তুলনা হয় না। গিরিশচন্দ্র কি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক, কি শ্যামা বিষয়ক গান দারুণ ভাবে লিখতেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৪: কবির দরজা সাধারণজনের জন্য সারাক্ষণই খোলা থাকত

বরণীয় মানুষের স্মরণীয় সঙ্গ, পর্ব-১৪: সত্যজিৎ রায়ের চিকিৎসার দায়-দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ কান্তিভূষণ বক্সী

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৪: বাংলার শুঁটকি মাছের চাহিদা সর্বত্র, এখনকার বিশেষভাবে প্রস্তুত শুঁটকি অনেক বেশি নিরাপদ ও পুষ্টিগুণে ভরা

স্টার থিয়েটার ছাড়াও এই নাটকটি ক্লাসিক, মিনার্ভা, আর্ট থিয়েটারে অভিনীত হয়েছিল। নসীরাম ও সোনা এই দুটি চরিত্র গিরিশচন্দ্রের অপূর্ব সৃষ্টি। দর্শকরা এদের অপূর্ব ভাবে অপূর্ব আনন্দ লাভ করতেন। কামের দুর্দমনীয় বীভৎস প্রভাব এই নাটকের জীবন। এতে যে নাটকীয় সংস্থান আছে বঙ্গ নাট্যসাহিত্যে তা কিন্তু খুবই বিরল। অকৃত্রিম ভালবাসা স্বার্থের ষড়যন্ত্রে কিভাবে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এই নাটকে সেটাই অতি মর্মস্পর্শীভাবে দেখানো হয়েছে। যদিও এই নাটকের পরিণাম ভক্তির আলোকোময় চিত্রে সমুজ্জল হয়ে উঠতে পেরেছিল।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content