শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

প্রতিদিন বরিশাল-ঢাকা ও ঢাকা-বরিশাল নাইট সার্ভিস স্টিমার৷ একেকটা স্টিমার যেন জাহাজের মতো৷ তিনতলা স্টিমারের কেবিন ও ডেক মিলিয়ে একসঙ্গে কয়েকশো যাত্রী হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে পারেন৷ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কেবিনও রয়েছে প্রতিটি স্টিমারে৷ ভাড়া মধ্যবিত্তদের নাগালের মধ্যে৷ যাঁরা নদীপথে ভ্রমণ ভালোবাসেন, তাঁদের কাছে এই নাইট সার্ভিস স্টিমার নিশ্চয়ই বাড়তি আনন্দদান করবে৷

সেদিন সন্ধ্যায় তিন-চারটে স্টিমারকে ভোঁ বাজিয়ে লঞ্চঘাট থেকে পরপর ঢাকার উদ্দেশে রওনা হতে দেখলাম৷ স্টিমারগুলোর উজ্জ্বল আলো কীর্তনখোলার স্রোতধারায় সোনালি-রুপোলি আঁকিবুকি কেটে একসময় আবিল অন্ধকারে হারিয়ে গেল৷

লঞ্চঘাটে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব অনেকেই ‘সি-অফ’ করতে এসেছিলেন৷ খাবার-দাবার বিক্রি হচ্ছিল অঢেল৷ লঞ্চগুলো চলে যেতে ভাঙা হাটের মতো পড়ে রইল বড় লঞ্চঘাট৷ অবশ্য আমি একটা ছোট সরকারি স্টিমারে পরদিন সন্ধ্যায় চাঁদপুরে রওনা হয়েছিলাম৷

আমার কপাল ভালো৷ ‘সেলা’ নামে ওই সরকারি স্টিমারের কেবিনের একটা টিকিট জোগাড় হল৷ কেবিনের সংখ্যা কম৷ চাহিদা বেশি৷ বাংলাদেশ সরকার স্থলপথের পাশাপাশি জলপথকেও সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছে৷ বর্ষার সময়টা ছাড়া বছরের অন্য সময়ে নাইট সার্ভিস স্টিমারের টিকিটের চাহিদা প্রচণ্ড৷ অনিমেষের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই৷ সে-ই সব কাজকর্ম ফেলে আমাকে লঞ্চঘাটে পৌঁছে দিল৷ আধঘণ্টা দেরিতে স্টিমার ছাড়ল সন্ধ্যা ৭টায়৷

নদীর ওপারে একটা-দুটো করে ইতিমধ্যে অনেক আলো জ্বলে উঠেছে৷ নদীতীর ধীরে ধীরে রাতের অবগুণ্ঠন টেনেছে৷ ওপার থেকে এপারে আসা যাত্রীবাহী নৌকাগুলো স্টিমার থেকে প্রয়োজনীয় দূরত্ব বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল৷ স্রোতের টানে একবার ধাক্কা লাগলেই সর্বনাশ! জেলে নৌকার সংখ্যাও নেহাত কম নয়৷ ছোট ছোট হ্যারিকেন জ্বলছে৷ ওদের কাছে শক্তিশালী টর্চও আছে৷ মাঝে মাঝে টর্চের তীব্র আলোয় নদীর বুকে রুপোলি ঝলক৷ কীর্তনখোলা নদীতে নাকি ভালো মাছ পাওয়া যায়৷ আর খেতেও সুস্বাদু৷ কখনো কখনো দূর নদীপাড়ে সবুজ ও লাল আলোর সংকেত৷ লাল মানে নদীর নাব্যতা সেখানে কম৷
কীর্তনখোলার পর মেঘনা বেয়ে শুনলাম, চাঁদপুরে পৌঁছতে কম করেও রাত ১টা৷ রাত ১০টার পর মেঘনার দেখা মিলবে৷ ইতিমধ্যে আমার টিকিট চেকিং হয়ে গিয়েছে৷ স্টিমারের নীচের আর ওপরের ডেকে অনেক যাত্রী৷ স্টিমারের সামনের দিকে গোটাকয়েক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ফার্স্ট ক্লাস কেবিন৷ ওদিকটায় একবার ঘুরে এলাম৷ কয়েকটা ডেক চেয়ার পাতা৷ আধশোয়া, চোখবোজা দু-তিনজন যাত্রী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের রানিং কমেন্ট্রি শুনছেন রেডিয়োতে৷ এ বছর (২০১৪) বাংলাদেশে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর বসেছিল৷ স্টিমারের সামনের দিক বলে এদিকটায় বাতাসের বেগ বেশি৷ আমার তো বেশ শীত শীত করছিল৷

নিজের কেবিনের দিকে ফিরে এলাম৷ একটা চেয়ার টেনে বসলাম৷ হঠাৎ দুই যুবক এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—স্টিমার কখন চাঁদপুরে পৌঁছবে৷ কী জানি, তাঁরা হয়তো আমাকে স্টিমারের কর্মচারী ভেবেছেন!
স্টিমারের বেয়ারা ওহাদুর আলি কর্মচঞ্চল যুবক৷ রাতে কে কী ডিনার করবে কাগজ-কলম নিয়ে চট্পট্ লিস্ট করে নিচ্ছে৷ ওহাদুর আমাকে ধূমায়িত এক কাপ চা দিয়ে গেল৷ চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললাম৷
হঠাৎ আমার ঠিক পাশের কেবিনের দরজার ছিটকিনি খোলার ‘খুট’ করে একটা আওয়াজ৷ ধীরে ধীরে দরজার পাল্লা খুলে গেল৷ স্টিমারে ওঠার সময় দরজাটা সম্ভবত ভেতর থেকে বন্ধই দেখেছিলাম৷ দেখলাম, টকটকে রক্তিম বস্ত্র পরিহিতা এক সন্ন্যাসিনী ধীর পদক্ষেপে বাইরে বেরিয়ে এলেন৷

সন্ন্যাসিনী না বলে তাঁকে ভৈরবী বলাই শ্রেয়৷ শিবসন্ন্যাসিনী৷ মাথায় সামান্য জটা৷ চুল চূড়া করে বাঁধা৷ দীর্ঘাঙ্গী৷ গায়ের রং একটু শ্যামলা হলেও মুখখানা বড্ড মায়াবী৷ টানা টানা দু-চোখ৷ ভৈরবীর গলায় ছোট-বড় অনেকগুলো রুদ্রাক্ষের মালা৷ আমার দিকে একঝলক তাকিয়েই কয়েক পা এগিয়ে শক্ত করে স্টিমারের রেলিং ধরে দাঁড়ালেন৷ দৃষ্টি তাঁর মেঘনার ঢেউয়ে নিবদ্ধ৷

এরকম এক পরিবেশে হঠাৎ এক ভৈরবীর সাক্ষাৎ পাব কল্পনাও করিনি৷ মাঝে মাঝে তাঁর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম৷ এভাবে তাকানো হয়তো ঠিক হচ্ছে না৷ তবুও৷ আমার কেবিনের সামনে যেখানে বসেছিলাম জায়গাটা স্টিমারের পিছন দিক৷ একটু নির্জনও৷ যাত্রীদের আনাগোনা নেই বললেই চলে৷ তাই ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়তো ভৈরবীর কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না৷

মেঘনা এখানে খুব চওড়া৷ দু-পারে অস্পষ্ট আলোর রেখা৷ মাঝে মাঝে পণ্যবাহী বড় বড় স্টিমার নদীর বুকে নোঙর করা৷ হঠাৎ আমাদের স্টিমারের সঙ্গে একটা জেলে নৌকার ধাক্কা লাগে আরকি! ভৈরবী সামান্য আর্তনাদ করে ওঠেন—‘ঈশ্বর তুমিই বোধহয় বাঁচাইলা!’
আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব-৩৯: মুকুন্দ দাসের কালীমন্দিরে শ্যামাপুজোয় খুব ধুমধাম করে পুজো হয়

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৫: বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র— বইয়ের জন্য ভালোবাসা

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন: ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মেনে চললে বাড়িতেই ডেঙ্গির চিকিৎসা করা সম্ভব

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১১: ভাগ্যের ফেরে হাস্যকর ‘লাখ টাকা’ [১০/০৭/১৯৫৩]

এত রাতে তিনটি কিশোর ওই নৌকায়! সম্ভবত খেপলা জালে মাছ ধরছিল ওরা, আমিও সঙ্গে সঙ্গে মুখ বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলাম গোটা ব্যাপারটা৷ ভৈরবী আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন৷ তাঁর আপাত গাম্ভীর্যের বলয় খসে পড়ল৷

হাতজোড় করে নমস্কার করলাম ভৈরবীকে৷ বললাম, ‘আপনি সন্ন্যাসিনী৷ আপনাকে জিজ্ঞাসা করা ঠিক হচ্ছে কি না জানি না৷ আপনি কি চাঁদপুরে যাচ্ছেন?’
‘হ চাঁদপুরেই যাইতাছি৷ আর আপনি?’
‘আমারও আপাতত গন্তব্য চাঁদপুর৷ আমি সাংবাদিকতা করি৷’
ভৈরবী হেসে বললেন, ‘বুঝতে পারছি৷ আপনি পত্র-পত্রিকায় লিখালিখি করেন তাই তো?’ আমিও একটু হাসলাম৷

শুনলাম, ভৈরবী যাচ্ছেন বাংলাদেশের অন্যতম তীর্থ শ্রীশ্রীমেহার কালীবাড়িতে৷ সেখানে দিনকয়েক থেকে আর এক তীর্থে৷ তখন থেকে একটা প্রশ্ণই বারবার মনে আসছিল আমার৷ এরকম আকর্ষণীয় চেহারার এক ভদ্রমহিলা, যাঁর সংসারী হওয়া উচিত ছিল, তিনি কেন এখন এক ভৈরবীর জীবনযাপন করছেন? অথচ এ ব্যাপারে তাঁকে সরাসরি প্রশ্ণ করাও যায় না৷

একবার শুধু জিজ্ঞাসা করলাম—এত রাতে চলাফেরা করেন, আপনার ভয় করে না? মুখটা সামান্য কঠিন করে বললেন, ‘বদ মতলবে কেউ সম্মুখে আইলে ত্রিশূলের এক খোঁচায় কাবু কইরা দিমু না! তাছাড়া ভৈরবীদের সক্কলেই ডরায়৷’

তাঁর কথা শুনে ভালো লেগেছিল৷ ভৈরবী তো বেশ সাহসিনী! কিন্তু এরপর যা ঘটে গেল তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না৷

কয়েক মুহূর্ত কাটল৷ ভৈরবী হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন৷ তাঁর মতো সাহসিনীর চোখে জল দেখে আমি হতবাক! এরপর ভৈরবী তাঁর ফেলে আসা জীবনের যে কাহিনি কেন জানি না আমাকে বিশ্বাস করে সেই রাতে শোনালেন, আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷ বলেছিলেন, ‘আপনারে দাদা ভাইব্যা মনের কথা কইতাছি৷ কাউরে কইবেন না এই অনুরোধ রাখি৷’
বলেছিলাম, ‘আপনার অনুরোধ রাখার চেষ্টা করব৷’

না, ভৈরবীর অনুরোধ আমি রাখতে পারিনি৷ কেন তাঁর জীবনের সেই করুণ ঘটনার কথা আপনাদের শোনাতে বসলাম? কেন কথা দিয়েও কথা না রাখার অপরাধে আজীবন অপরাধী হয়ে রইলাম তাঁর কাছে?
আমার মনে হয়েছিল, যতই কষ্টে বুক ফেটে যাক, এ কাহিনি সকলের জানা উচিত৷ কীভাবে এক গৃহবধূর জীবনে নেমে এল এক ভয়ংকর কালরাত্রি? তাঁর সোনার সংসার হল ছারখার!
আরও পড়ুন:

খাই খাই: একঘেয়েমি কাটাতে পোলাও-এর স্বাদ বদল চাই? বানিয়ে ফেলুন সনাতনী ঝাল পোলাও

দশভুজা: রুমা দেবী—তিরিশ হাজার মহিলার ভাগ্য পরিবর্তনের কান্ডারি তিনি

দ্রোণস্থলীর দেবতা টপকেশ্বর মহাদেব

গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাধা, ‘চলমান পাঠাগার’ তাঁর পরিচয়!

মাত্র কয়েক বছর আগের কথা৷ ইচ্ছা করেই ভৈরবীর পূর্বাশ্রমের নাম গোপন রাখলাম৷ তাঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল দিনাজপুরের এক গ্রামে৷ সেবার সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার দাউদাউ আগুন তাঁদের গ্রামেও লেগেছিল৷ এক রাতেরই তো ঘটনা! গ্রামের আর কয়েক ঘর হিন্দু বাড়ির মতো ওঁদের বাড়িতেও জ্বলন্ত মশাল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মানুষের শত্রু একদল বর্বর অমানুষ৷ তারপর অবাধে লুটপাট৷

রক্তগঙ্গা বইল৷ গণধর্ষণের শিকার হলেন গৃহবধূ৷ স্বামীকে স্ত্রীর চোখের সামনেই হত্যা করল ওই বর্বরের দল৷ ছোট্ট একটা ছেলেও ছিল ওঁদের৷ তাকেও বাঁচতে দিল না ওই নরখাদকরা৷ চোখের সামনে এই বিভীষিকা দেখে শাশুড়িমা হার্টফেল করে মারা গেলেন৷ আর প্রায় অর্ধমৃত এই গৃহবধূকে ওরা ফেলে রেখে চলে গেল৷
এবার ভৈরবী চোখের জল মুছে বললেন, ‘সেইদিন ভোরে পুলিশ আর এক সন্ন্যাসিনীর কৃপায় বাঁইচা গেলাম ঠিকই, তবে মইরা গেলেই বোধহয় ভালা হইত৷ এরপর বাঁইচা থাকার মানেটা কী কইতে পারেন দাদা? আমার নিষ্পাপ পোলাডারেও যে ওরা শেষ কইরা দিল৷ পোলাডার মুখখানা মনে পড়ে৷’

বললাম, ‘এরপর আপনি সন্ন্যাস নিলেন৷ একাকিনী এক ভৈরবীর জীবন৷ তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ আচ্ছা, আপনার মনে কখনো প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে না?’

ভৈরবী বললেন, ‘দাদা, এবার হাসাইলেন আমারে৷ কার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিমু? সরকারই যাদের ঢিট করতে পারে না তাদের আমার মতো এক অবলা নারী কী করব৷’
জিজ্ঞাসা করলাম—ওই বর্বরগুলোকে কি চিনতে পেরেছিলেন?
ভৈরবী বললেন, ‘ওরা আইছিল ভিন এলাকা হইতে৷’
বললাম, ‘জীবনকে ক্ষমা করতে পেরেছেন কি?’

এবারে একেবারে চুপ ভৈরবী৷ কয়েক মুহূর্ত কাটল৷ মেঘনার ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ৷ দু-চারবার স্টিমারের ভোঁ৷ গভীর রাত৷ ইতিমধ্যে যাত্রীদের কোলাহলও কমে এসেছিল৷ প্রায় নিঃস্তব্ধ চারপাশ৷ আমিও ভাষাহীন৷

ভৈরবী বিষাদমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘মরণের মুখ হইতে যখন একবার ফিরা আইছি, মরতে যখন পারুম না, এক সন্ন্যাসিনীর ভিন্ন পথে বাঁচার চেষ্টায় আছি৷ মনের ভিতর মাঝে মাঝে ঝড় ওঠে বটে, সব ভুইলা থাকি৷’
কথা বলতে বলতে দু-হাতে স্টিমারের রেলিং আরও শক্ত করে চেপে ধরেন৷ সেই মুহূর্তে তাঁর দু-চোখ ছলছল করে উঠেছিল৷

চাঁদপুর স্টিমারঘাটে নামার সময় ভৈরবীর নাম জানতে পারলাম—শ্যামা ভৈরবী৷ এখন এ নামেই পরিচয় তাঁর৷ এখন এভাবেই বড় একা হয়ে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বড়ানো! সেদিন রাতে তিনি চাঁদপুরের এক আশ্রমে থাকবেন৷ সকালেই শ্রীশ্রীমেহার কালীবাড়ি৷

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content