শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


বিশ্ববন্দিত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকের দ্বিতীয়বার অনুবাদ করেছিলেন গিরিশচন্দ্র। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের ‘রুদ্রপাল’ নাটক অভিনয় প্রসঙ্গে হাইকোর্টের ভূত-পূর্ব বিচারপতি গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় গিরিশচন্দ্রকে বলেছিলেন ”ম্যাকবেথ নাটকের ডাকিনীদের ভাষা বঙ্গানুবাদ বড়ই কঠিন।
গিরিশচন্দ্র উৎসাহী হয়ে সেই নাটকের অনুবাদে প্রবৃত্ত হলেন এবং সে অনুবাদ শেষ করে আনলেন। কিন্তু অ্যাটকিনসেন্স কোম্পানি অফিস ফেল পড়ার জন্য পান্ডুলিপি এখানে খোয়া যায়। তখন তিনি পুনরায় সেই কাজ শুরু করলেন। ম্যাকবেথ অনুবাদে ডাকিনীর উক্তির মূল ও অনুবাদ তুলে ধরলাম।” ওয়েন স্যাল উই থ্রি মিট এগেইন/ইন থান্ডার, লাইটনিং, অর ইন রেইন? গিরিশচন্দ্র ডাকিনীর ভাষার বিশেষত্ব রক্ষার জন্য কী রকম করেছিলেন সেটা দেখা যাক— ”দিদি লো বল না আবার মিলন কবে তিন বোনে /যখন ঝরবে মেঘা ঝুপুর ঝুপুর/চক চকাচক হানবে চিকুর/ কড় কড়াকড় কড়াৎ কড়াৎ ডাকবে যখন ঝনঝনে/”

প্রায় সাত মাস ধরে ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের রিহার্সাল চলতে থাকলেও পাশাপাশি গিরিশচন্দ্রের ‘মুকুল মঞ্জুরা’র নাটকেরও রিহার্সাল হয়েছিল। নবনির্মিত রঙ্গালয়ের নামকরণের জন্য প্রথমে তিনটি নাম প্রস্তাবিত হয়— ক্লাসিক, মিনার্ভা ও আনন্দময়ী থিয়েটার। অবশেষে সর্বসম্মতিক্রমে ‘মিনার্ভা থিয়েটার’ নামটি গৃহীত হয়।

অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি ও শেক্সপিয়ার

১৮৯৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ‘ম্যাকবেথ’ নাটক নিয়ে মিনার্ভার থিয়েটার প্রথম খোলা হয়। প্রথম অভিনয় রজনীতে যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁরা হলেন ডানকানের ভূমিকায় হরিভূষণ ভট্টাচার্য। ম্যাকমের চরিত্রে সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (দানিবাবু)। ম্যাকবেথের চরিত্রে গিরিশচন্দ্র ঘোষ। দ্বারপাল, প্রথম ডাকিনি, বৃদ্ধ, প্রথম হত্যাকারী এবং ডাক্তার এই পাঁচটি চরিত্রে অভিনয় করলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। ফ্লিয়েন্সের চরিত্রে অভিনয় করলেন কুসুমকুমারী। লেডি ম্যাকবেথের চরিত্রে তিনকড়ি দাসী এবং লেডি ম্যাকডফ-এর চরিত্রে প্রমদাসুন্দরী অভিনয় করলেন। এই নাটকের সংগীত শিক্ষক হলেন দেবকণ্ঠ বাগচী।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব -২২: প্রথম ঐতিহাসিক নাটক ‘চন্ড’-এর মাধ্যমে নিজের প্রতিভা তুলে ধরেছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ

যোগা-প্রাণায়াম: শরীর-মনকে সুস্থ রাখতে করুন সুদর্শন ক্রিয়া, বিশ্রাম নিন যোগনিদ্রায়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৪: কবি যখন শিক্ষক

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৩: খালেবিলে, ধানখেতে, পুকুরে, নদীতে ঘুরে বেড়ানো ‘ম্যাজিশিয়ান’ জেব্রা ফিশ ভবিষ্যতে রোগ নিরাময়ে নতুন দিশা দেখাবে

বিলিতি থিয়েটারে শেক্সপিয়ারের শ্রেষ্ঠ নাটক গুলির অভিনয় দেখে গিরিশচন্দ্র পাশ্চাত্য নাট্যকলায় বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন। সেই অভিজ্ঞতায় ও স্বভাব-প্রযুক্ত নাট্য প্রতিভায় তিনি ম্যাকবেথের শিক্ষাদান এবং স্বয়ং ম্যাকবেথ এর ভূমিকায় অভিনয় করে প্রতিপন্ন করেছিলেন বাঙালির দ্বারা বাংলা ভাষাতেও বিলাতের সুবিখ্যাত শিল্পীদের মতো রস সৃষ্টি করা যায়। অর্ধেন্দুশেখর পাঁচটি বিভিন্ন রসের ভূমিকা গ্রহণ করে অসাধারণ অভিনয় চাতুর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিনকড়ি দাসীর অভিনয়। বিলেতের বড় বড় শিক্ষিত অভিনেত্রী যে ভূমিকায় অভিনয় করতে ভয় পেতেন, সেই ভূমিকায় এক নগণনা অশিক্ষিতা বাঙালি স্ত্রীলোকের দ্বারা অভিনয় যে একেবারে অসম্ভব এটা শিক্ষিত সমাজের ধারণা ছিল। কিন্তু তিনকড়ি তাঁর অসামান্য অধ্যবসায় এবং গিরিশচন্দ্রের অদ্ভুত শিক্ষা প্রভাবে তাঁদের সেই ভ্রান্ত ধারণা দূর করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

ফিল্ম রিভিউ: ‘হাওয়া’য় ভেসে গেল বাঙালি

ইংলিশ টিংলিশ: ‘হাসি’ মানে শুধুই ‘Laugh’ বা ‘কান্না’ মানে শুধুই ‘Cry’ নয় — শিখে নাও আরও নতুন শব্দ!

জিলিপি খেতে ভালোবাসেন? তাহলে আর দেরি কেন? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন গরম গরম আনারসের জিলিপি

দশভুজা: আমার দুর্গা

মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর বলেছিলেন— ”গিরিশবাবুর অনুবাদের এই বিশেষত্ব দেখিলাম, যে যে স্থানে অনুবাদ করা অতীব দুরুহ সেই সেই স্থানে তাঁহার শক্তিমত্তা সমধিক প্রকাশ পাইয়াছে।” যেমন অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় এবং যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করে এই নাটক অভিনীত হয়েছিল, আর্থিক হিসেবে কিন্তু তেমন ফল লাভ হয়নি। শিক্ষিত সমাজে এর কতকটা আদর হলেও দর্শক সাধারনের মন ম্যাকবেথ আকৃষ্ট করতে পারেনি। তাদের চির পরিচিত পৌরাণিক বা সামাজিক নাটকের পরিবর্তে এই রুদ্রসাত্মক নাটক কেমন রুচিকর হল না ।ক্রমশ বিক্রি হ্রাস পেতে থাকায় নাটকের অভিনয় বন্ধই করে দেয়া হল। সেই সঙ্গে গিরিশচন্দ্রের একে একে শেক্সপিয়ারের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটকগুলি বঙ্গানুবাদের বাসনা মন থেকে দূর হয়ে গেল।

তিনকড়ি দাসী।

গিরিশচন্দ্র অল্প আয়াসে রচিত ‘আবু হোসেন’ কৌতুক গীতিনাট্যের অভিনয়কালীন দর্শকদের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মহা উল্লাসে হাস্যকরতালি ধ্বনিতে রঙ্গালয় কেপে কেঁপে উঠতে দেখে, ম্যাকবেথ অনুবাদক আবু হোসেনের রচয়িতা হয়েও সাধারণ দর্শকের রুচি দর্শনে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন “নাটক দেখিবার যোগ্যতালাভে ইহাদের এখনো বহু বৎসর লাগিবে, নাটক বুঝিবার সাধারন দর্শক এখনও বাংলায় তৈয়ারি হয় নাই। পেশাদার থিয়েটার প্রতিষ্ঠানে আমার যে আপত্তি ছিল — ইহা তাহার একটি কারণ।”

Skip to content