মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


রিসিপশন ও ক্যাশ কাউন্টার।

চট্টগ্রামে শিশুসাহিত্য উৎসবে অতিথি হয়ে এসেছিলেন শিশুসাহিত্যিক ড. পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও রতনতনু ঘাটী। তাদের নিয়ে গেলাম বইয়ের জাহাজ বাতিঘর-এ। প্রবেশমাত্র তারা বিস্ময়ে হতবাক। এমন বই বিপনীও হয়? দু’জনের ঘোর কাটতে না কাটতেই নিজেদের বই খুঁজতে লেগে গেলেন। বইয়ের এই বিশাল সম্রাজ্যে নিজের বই খুঁজে পেয়ে দু’জন খুশিতে আটখানা। পশ্চিমবঙ্গে কত রকমের বইয়ের দোকান আছে। কিন্তু এত বিশাল, এত সুন্দর, এত পরিকল্পিত পরিপাটি বইয়ের জাহাজ ভারতে আছে কিনা সন্দেহ।

পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে লেখক অরুণ শীল, কবি ওমর কায়সার ও শিশুসাহিত্যিক রতনতনু ঘাটী।

জাহাজের মতো কাঠের পাঠাতন, জাহাজের মতো জানালা, ঝুলন্ত দড়ি, বই বোঝাই কন্টেনার লোহার মোটা তারে শক্ত করে বাঁধা, জাহাজের মতো ঝুলানো লণ্ঠনের হলুদ আলোয় মনে হচ্ছে বিশাল বইয়ের বহর নিয়ে জাহাজ বঙ্গোপসাগরে ভেসে চলেছে। ভেতরে কুতুবদিয়া দ্বীপের বাতিঘরের আদলে বাতিঘর স্তম্ভ। জাহাজের মতো করে তৈরি রিসিপশন ক্যাশ কাউন্টার, কপি কর্ণার, পাঠকের বসার ব্যবস্থাও বন্দরে জাহাজ বাঁধার ক্যাপস্টেনের মতো। প্রবেশ মুখ নোঙর করা জাহাজের মতো করে অ্যাংকর হোল্ডারে মোটা মোটা দড়িতে জড়ানো। ড. পার্থজিৎ বললেন, ‘যেন মনে হচ্ছে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে এই বইয়ের জাহাজ নোঙর করেছে’।

শিশুসাহিত্যিক রতনতনু যেন শিশু হয়ে গেলেন। তিনি জাহাজের পেছন দিকের ইঞ্জিনরুমের উপরের ডেকের মতো করে তৈরি শিশু-কিশোর কর্ণারে সস্ত্রীক বই খুজতে ব্যস্ত। সেখানে ছোটদের বইয়ের বিশাল ভান্ডার। মৃদুস্বরে বললেন, ‘এত পাঠক দাঁড়িয়ে, বসে, কপির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বই দেখছেন, বই পড়ছেন, বই নিয়ে মেতে আছেন! প্রতিদিন কি এমন ভীড় হয়?’ উত্তরে বললাম, না। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার। তাই লোক সমাগম একটু বেশি। বিশেষ করে আজ ছোটরা বেশি ভির করেছে।

ঢাকার বাতিঘরের ভিতর।

দেশী-বিদেশী ইংরেজী ভাষার বইয়ের সমাহার দেখে ড. পার্থজিৎ খুবই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলেন। বইয়ের চমৎকার সব বিন্যাস। বিষয় ভিত্তিক কন্টেনার, যেমন— অন্য ভাষার সাহিত্য, অঙ্ক, বিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, পুরাণ, কল্পবিজ্ঞান, চারুকলা, আবৃত্তি, সঙ্গীত নৃত্যকলা, অর্থনীতি, ব্যাংক, আত্মউন্নয়ন, বঙ্গবন্ধু বিষয়ক…। লেখক ভিত্তিক বিন্যাস— রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, নজরুল, সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, হুমায়ুন আহমেদ জাফর ইকবাল…। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক — অবসর, কথাপ্রকাশ, বাংলাপ্রকাশ ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও জানার কৌতূহলে বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে আলাপে মেতে উঠলেন। বিক্রয়কর্মীদের অমায়িক ব্যবহার সৌজন্যবোধে তিনি মুগ্ধ। প্রশ্ন করলেন, কার মাথায় এমন চিন্তা এলো? এমন করে জাহাজের আদলে গ্রন্থবিপনী হবে!
বঙ্গোপসাগরের তীরে চট্টগ্রাম বন্দরে সেই জাহাজ নোঙর করে থাকবে, ভাবুন তো একবার! একবার ডাকুন না তাঁকে। এই বই সম্রাজ্যের রাজার সঙ্গে পরিচিত হই, একটু আলাপ করি। তিনি কী করে এমন স্বপ্ন দেখলেন?
বাতিঘর স্বত্ত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশকে খুঁজলাম। বিক্রয়কর্মী রুবেল দেব জানালেন, তিনি দেশের বাইরে আছেন। এখানে প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, লেখক, গবেষক, বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত থাকেন। থাকেন সাহিত্য সংস্কৃতির উঠতি তরুণ কর্মীরাও। ছোটদের সমাগম উচ্ছ্বাসিত ঢেউয়ের মতো। কিন্তু সবাই এখানে এমন যে, নিজের উচ্ছ্বাসে যেন অন্যের পাঠে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে। প্রশিক্ষিত বিক্রয়কর্মীদের সতর্ক পদাচারণায় তাৎক্ষণিক যে কোনও উচ্চস্বর নিমিষেই শান্ত মধুর কলতানে পরিণত হয়ে যায়।

কুতুবদিয়া দ্বীপের আদলে বাতিঘরের রেপ্লিকা।

বাতিঘরের স্বত্ত্বাধিকারী দীপঙ্কর ছিলেন তরুণ ছড়াকার, কবি এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নিবেদিত প্রাণ কর্মী। ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগানের নিয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যখন ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চালুর পরিকল্পনা করেন, সেই থেকে দীপঙ্কর ভ্রাম্যমান লাইব্রেরির বিশাল গাড়ি নিয়ে ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে পরে চট্টগ্রামে পাঠকদের দরজায় দরজায় হাজির হয়েছিলেন। বই পড়ুয়াদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বই পড়ুয়ারা কী চাইছেন তা ভালো করে বোঝার চেষ্টা করেছেন। পাঠকের পছন্দের একটা গ্রন্থবিপণী করার স্বপ্নে সে বিভোর ছিল। সেই স্বপ্নে উত্তাপ দিয়েছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্বপ্নদ্রষ্টা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার।
আরও পড়ুন:

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৩: বাংলাদেশ শিশু একাডেমি— শিশুদের আনন্দ ভুবন

শনিবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম দিন কলকাতায় সকাল থেকেই ঝড়ো ‘হাওয়া’, নন্দনে লম্বা লাইন

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-২: তরুণ প্রজন্মের পছন্দের পর্যটন স্পট কক্সবাজার

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৮: মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্বে ‘বসু পরিবার’ [১১/০৪/১৯৫২]

কন্টেনার বোঝাই বই।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চাকরি ছেড়ে ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম চেরাগি মোড়ে একশ বর্গফুটের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়ালো বাতিঘর। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদী’র সম্মুখস্থল চেরাগির মোড় সবসময় সংবাদকর্মী, কবি সাহিত্যিক, নাট্যজন সংস্কৃতি সেবীদের আড্ডায় মুখরিত থাকে। এখানে দীপঙ্কর দাঁড় করলেন বাতিঘর। পাঠকের চাহিদা মাথায় রেখে বাতিঘর তার আলো জ্বাললেন। সেই আলোর ইশারায় বই প্রেমিক পাঠকেরা উদ্বেলিত। তাদের পছন্দের বই সহজে পাওয়া যায় বাতিঘরে।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান লাইব্রেরির সুবাদে প্রায় প্রতিজন পাঠক তার পরিচিত বন্ধু আত্মীয়ের মতো। সবার মন মেজাজ চাহিদা দীপঙ্করের নখ দর্পণে। অল্প দিনের মধ্যেই বাতিঘরের ছোট্ট পরিসর ও সম্মুখস্থ রাস্তা পাঠকের আড্ডায় ভরে ওঠে। স্বল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বাতিঘর ও দীপঙ্কর। পাঠকের এই ভালোবাসা পেয়ে বড় পরিসর খুঁজতে লাগলেন। পেয়েও যান। চেরাগির অদূরে জামালখানে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের নীচতলা সবেমাত্র খালি হয়েছে। ২০১২ সালে প্রেসক্লাবের নিচ তলায় প্রায় ৩০০০ বর্গফুটে চলে আসে এই বাতিঘর।

সিলেট শাখা।

জাহাজের এই আদল, সমুদ্র, বাতিঘর বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ঐতিহ্যকে ধারণ করেছে। শিল্পী শাহীনূর রহমান বই পাগল মানুষ এবং দীপঙ্করের বন্ধু। তিনি জাহাজের সবকিছু দিয়ে সাজালেন বাতিঘরকে। জাহাজ তৈরির সরঞ্জাম চট্টগ্রামে সুলভ্য। জাহাজের আদলে মনোমুগ্ধকর নকশায় সজ্জিত সুরম্য সুন্দর এক বইয়ের সম্রাজ্যে পরিণত হল বাতিঘর। বাতিঘর গ্রন্থবিপনী শুধু চট্টগ্রামের নয়, বাংলাদেশের গর্বের সম্পদ হিসেবে পরিচিতি পায়। দেশের শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবিদের পদচারণায় নিত্য মুখরিত বাতিঘর। বাতিঘর তরুণদের মধ্যে অন্যরকম প্রভাব বিস্তার করে। দেশব্যাপী বই পড়ুয়াদের কাছে তীর্থ স্থান দর্শনের মতো হল এই লাইব্রেরি। দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসতে থাকে বই প্রমিক, বই ব্যবসায়ী-সহ পরাক্রমশালী মানুষেরা। দেশের প্রাজ্ঞজন থেকে শুরু করে সবার প্রশংসায় ভেসে দীপঙ্কর দাশ একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন এবং সম্মানিত হলেন।
আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব ৩৭: বরিশাল শহরে জাগ্রত কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চারণকবি মুকুন্দ দাস

জিলিপি খেতে ভালোবাসেন? তাহলে আর দেরি কেন? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন গরম গরম আনারসের জিলিপি

পর্ব-৩৯: ঠাকুরবাড়ির বিয়েতে এমন জাঁকজমক আর হয়নি

অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টাল দুনিয়া— সোয়ার্ভস্কি

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অনুপ্রেরণায় ২০১৭ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনের আটতলায় মোগল সম্রাজ্যের স্থাপত্যরীতির আদলে ঢাকায় বাতিঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সালে সিলেটে চা বাগানের সতেজতা আর সুরমা নদীর উপরের কিন ব্রীজ-সহ সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে মনোমুগ্ধকর নকশায় উদ্বোধন হয় বাতিঘর সিলেট শাখা। এ বছর রাজশাহীতে আলো জ্বালবে বাতিঘর।

ঢাকা শাখার ভেতরের দৃশ্য।

পাঠকের চাহিদা ও সম্ভাবনা মাথায় রেখে ২০১৬ সালে প্রকাশক হিসেবে বাতিঘর আত্মপ্রকাশ করে। সম সাময়িক কবি-সাহিত্যিকদের বই, অন্যভাষা থেকে অনুদিত বইয়ের পাশাপাশি দ্রুপদী ও দুষ্পাপ্য মানসম্মত সংস্করণ প্রকাশ করে বাতিঘর, যা পাঠক সমাজে বিপুল সাড়া পায়। বাতিঘরের সব শাখাতেই আছে বাংলা, ইংরেজি, দুই ভাষার বইয়ের বিপুল সমাহার। কথাসাহিত্য, গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, শিল্প দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি মনোবিজ্ঞান, নাট্যতত্ত্ব, স্থাপত্য, শিল্প-সহ বিবিধ বিষয়ের বইয়ের সম্ভার আছে ছোট্ট বড় সবার জন্য। ছোটদের জন্য আছে আলাদা শিশু-কিশোর কর্ণার। গল্প, রহস্য বিজ্ঞান, ছবির বই, ভুতের বই, গোয়েন্দা বই, কমিকস নিয়ে খুদে পাঠকদের উচ্ছ্বাসের কলরব শোনা যায় শিশু-কিশোর কর্ণারে। ভবিষ্যতের পাঠক এরা, বাতিঘরের আশা ভরসা।

বাতিঘরের কর্ণধার দীপংকরের সঙ্গে।

দীপঙ্করের ইচ্ছা আছে দেশের সব বিভাগে পর্যায়ক্রমে পর্যায়ে এই গ্রন্থ বিপননীটির শাখা প্রতিষ্ঠা করার। সবরকমের অত্যাধুনিক সুবিধাসহ বহুতল বিশিষ্ট একটা বাতিঘর প্রতিষ্টার স্বপ্নও বুকে পুষে রেখেছেন। পাঠক লেখক শুভাকাক্ষীদের অনুপ্রেরণায় সারা দেশে পৌঁছে যাচ্ছে বাতিঘর নামের বইয়ের সম্রাজ্যের দীপ্তি। একদিন সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর গর্বের ধনে পরিণত হবে আমাদের এই বাতিঘর।
* সোনার বাংলার চিঠি (Letter from Sonar Bangla, Sonar Banglar Chithi, Bangladesh) : অরুণ শীল (Arun Shil) কবি ও সাহিত্যিক। তিনি প্রধানত শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক। শুরুতে গণমুখী ছড়া লিখে তুখোড় ছড়াকার হিসেবে পরিচিতি পেলেও মায়াবী, কোমল এবং স্বপ্নময় কিশোর কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ, ফিচার লিখেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কার।

Skip to content