রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


সুদীর্ঘ এই জীবনের চলার পথের আঁকে বাঁকে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, তার স্থায়ীত্ব হয়তো খুব অল্প সময়ের জন্য, কিন্তু স্মৃতিতে তা অমলিন থাকে আজীবন। এমনটা ঘটে সবার জীবনেই। কয়েক দশক আগে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা কিংবা কোনও মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মৃতি কেউ চমৎকার মনে রেখে গড়গড় করে বলে যেতে পারেন, অথচ সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বহু ঘটনা, বহুবার দেখা হওয়া মুখ অনেকেরই মনে থাকে না। আমার জীবনের এমন কয়েকটি ঘটনার কথাই বলি।
 

নজরুলকে দেখেছি আমি


একবার নয়, তিন তিনবার। বয়স তখন কম, খুব বেশি হলে ১৫। পাঠ্য বইয়ে রবীন্দ্রনাথ টুকটাক পড়েছি, পড়েছি নজরুলও। কিন্তু কাজি সব্যসাচীর কণ্ঠে নজরুল কবিতার আবৃত্তি শুনে টানটা সেদিকেই বেশি জন্মেছিল। সেই নজরুলকে দেখার অফার! ব্যাপারটা খুলেই বলি। আমার এক পিসতুতো ভাইয়ের পিসতুতো দাদার বিয়েতে সিআইটি ফুলবাগানে গিয়েছিলাম। ক্রিস্টোফার রোডের এক আবাসনের মাঠে সেই বিয়ে হচ্ছিল। আমার ভাই হঠাৎ বলে উঠলো, ‘নজরুলকে দেখতে যাবি?’ আমি বললাম, ‘এত রাতে! কোথায়!’ ও বলল, ‘এই তো পাশের আবাসনের একতলার ফ্ল্যাটে।’ আমি বললাম, ‘আমাদের ঢুকতে দেবে!’ ও বলল, ‘চল না, একবার চেষ্টা করে দেখি।’

গিয়ে হাজির হলাম দু’জনে। ও ফ্ল্যাটটা আগেই চিনতো। দেখলাম দরজা খোলা কিন্তু ভেজানো। বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করলাম। সাড়া শব্দ না পেয়ে ঢুকে পড়তেই কাজের লোকের মুখোমুখি। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমরাই আগেভাগে আমাদের উদ্দেশ্য সবিস্তারে নিবেদন করলাম। আমাদের একটু ভালো করে দেখলেন ভদ্র মহিলা, একেবারেই দুটো বাচ্চা চ্যাংড়া ছেলে। দয়া হল। বললেন, ‘বাড়িতে তো কেউ নেই, এমন অসময়ে কেউ আসে! আচ্ছা তোমরা যখন এসেছ, আমার সঙ্গে চলো। দেখেই চলে আসবে। এখন ওঁকে খাওয়ানোর সময়।’ আমরা ওঁর পিছু পিছু দুটো ঘর পার হয়ে বাঁদিকে তৃতীয় ঘরে ঢুকলাম। মেঝেতে মোটা গদি পাতা রয়েছে। তার উপর ধবধবে সাদা চাদর। সেখানে রাজার মতো বসে আছেন আমাদের সবার প্রিয় সেই বিপ্লবী কবি, আমাদের প্রাণের কবি নজরুল ইসলাম। পরনে ভাঁজ করা সাদা কাপড় (সাউথ ইন্ডিয়ানরা যেভাবে পরেন), গায়ে রঙিন ফতুয়া। উদাস ভাবে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমাদের উপস্থিতি টেরও পেলেন না। মাথায় অবিন্যস্ত কিছু সাদা চুল, চোখ দুটো ভীষণ উজ্জ্বল। আমরা ওঁকে প্রণাম করলাম। কোনও ভাবান্তর হল না।

পরিচারিকা খাবারের থালা নিয়ে ঢুকতেই অস্ফুট স্বরে কিছু যেন বললেন, আমরা যার অর্থ কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওঁর বিছানায় দু’ তিনটে ছেঁড়া সাদা পৃষ্ঠার খাতা পড়েছিল, আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল সদ্য ছেঁড়া কিছু টুকরো কাগজ। আমাদের কৌতূহলী চোখ দেখে ভদ্রমহিলা জানালেন, এগুলো কবির-ই কাজ। ওঁর থেকে জানলাম, কবি কথা বলতে পারেন না। তবে মাঝে মাঝে আকার ইঙ্গিতে কিছু বলার চেষ্টা করেন। এই যেমন এখন খাবার দেখে বুঝলেন যে ওঁকে খেতে হবে। তাছাড়া ওঁর খিদেও পেয়ে গিয়েছে। এইসব বলে উনি এবার আমাদের বিদায় নিতে বললেন। মিনিট দশেকের কবি দর্শন সেরে খুব বিষন্নভাবে আবার বিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। কারার এই লৌহ কপাটের স্রষ্টা, এমন সুন্দর শ্যামা সঙ্গীত এবং প্রেমের গান যার সৃষ্টি, সেই মানুষটি আজ নির্বাক এবং সৃষ্টিহীন। খুব কষ্ট হল। অল্প বয়সে বুকের মধ্যে সেই দলা পাকানো কষ্টটা আজও আমি মাঝে মাঝে অনুভব করি।
এর বছর দুয়েক পরে আমার ফুল কাকার হাত ধরে আরেকবার গিয়েছিলাম নজরুল দর্শনে। কবির জন্মদিন নিয়ে পেপারে একটি ভুল তারিখ ঘোষণা হয়েছিল। আমরা গিয়ে দেখি আবাসনের চারপাশ সুনশান, জন্মদিন পালনের কোথাও কোনও উদ্যোগই নেই। এত দূর থেকে এসেছি, ফিরে যাব! তাই একবার ফ্ল্যাটে ঢোকার চেষ্টা করলাম। ঢুকতেই দেখা কবিপুত্র প্রখ্যাত আবৃত্তিকার কাজী সব্যসাচীর সঙ্গে। উনি তখন বাইরে কোনও অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। আমাদের নিবৃত্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন। অবশেষে আমার কাকার বারংবার অনুরোধে এবং আমার করুণ মুখ দেখে দয়াপরবশ হয়ে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। ঢুকে দেখলাম একই ভাবে কবি বসে আছেন, কোলের উপর একটা খাতা, সেখান থেকে কাগজ ছিঁড়ে টুকরো করে এপাশ ওপাশে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। কেয়ারটেকার মহিলা সেগুলো আবার সংগ্রহ করে ওয়েস্টবক্সে ফেলছেন।

এরপর যেবার কলকাতা পৌরসভার পক্ষ থেকে নজরুলকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, সেই অনুষ্ঠানেও আমি উপস্থিত ছিলাম। সেই সময় আমি টুকটাক আবৃত্তি করতাম এবং প্রথম পছন্দ ছিল নজরুলের কবিতা। বাংলাদেশ সরকার নজরুলকে প্রায় হাইজ্যাক করে তাদের দেশে নিয়ে যাওয়াতে অনেক নজরুল প্রেমীর মতো আমিও খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। কাঁচা হাতে এক প্রতিবাদী কবিতাও লিখেছিলাম। শেষ দুটো লাইন এখনও মনে আছে। ‘হিন্দু না মোরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন/ মানতে চায় না মন/ নজরুল নেই, প্রতিবাদ আছে, প্রতিবাদ করি তাই/ আমরা বিচার চাই।
 

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর সঙ্গে আড্ডা


একদিন নয়, পরপর দুদিন। ওঁর সঙ্গে আড্ডা মানে তো ইতিহাসের সঙ্গে আড্ডা! আমি এই শিরোনামে ১৯৭৮-এ একটি ছোট লেখা লিখেছিলাম, যেটি আমার সম্পাদনায় প্রথম ও শেষ লিটিল ম্যাগাজিন ‘বিতর্ক’তে প্রকাশিত হয়েছিল। অনেক খুঁজেও সেই বইয়ের কোনও কপি আমি উদ্ধার করতে পারলাম না। ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের প্রথম দিনটির কথা বলি। তখন আমি আর জি কর মেডিকেল কলেজে ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। শ্যামবাজারের বাসুদেব মঞ্চে ‘চে গুয়েভারা’ নাটকে অভিনয় করছি। সপ্তাহে একদিন, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছটায়, একটি করে শো। প্রতি সপ্তাহেই দু-একজন বিখ্যাত ব্যক্তিকে এনে নাটক দেখিয়ে তাদের মতামত সংগ্রহ করছি। সময়টা ছিল ১৯৭৮ সালের মাঝামাঝি। দলের একজন প্রস্তাব দিল, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তো কাছাকাছি থাকেন, ওঁকে একবার চেষ্টা করে দেখলে হয়। এক দুপুর বেলা আর জি কর থেকে সরাসরি গিয়ে হাজির হলাম শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের খুব কাছে রামধন মিত্র লেনে।
আরও পড়ুন:

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-৩৮: ঠিকই শুনেছেন! আমি একটি নাটকের দলও চালাই

অমরনাথের পথে, পর্ব-৬: এবার বালতাল হয়ে ফেরার পালা

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৯: রাজ্যাভিষেকের অপেক্ষায় অধীর অযোধ্যাবাসী

শারদীয়ার গল্প-৬: পর্‌সতার

সদর দরজা খোলাই ছিল। বেল না বাজিয়ে ঢুকে গেলাম। প্রশস্ত উঠোন, তিনদিকে বেশ চওড়া উঁচু বারান্দা। সম্ভবত বাড়িটি দোতলা ছিল। ঢুকেই দেখি, খালি গায়ে লুঙি পরা বীরেনবাবু আমার কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে। শুদ্ধ বাংলায় ‘তপ্ত কাঞ্চন’ বলে একটা শব্দ আছে না, ওঁর গায়ের রং ছিল সত্যিই তাই। গলায় পইতেও ছিল। আমায় দেখে চোখ কুঁচকে তার সেই বিখ্যাত আনুনাসিক সুরে বলে উঠলেন, ক্যা আপনি, কাকে চাই? আমি স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে অতি বিনয়ী হয়ে নিজের পরিচয় দিলাম এবং ওঁর সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলার অভিপ্রায় জানালাম। উনি ডান দিকের বারান্দায় একটি চেয়ার দেখিয়ে ওখানে আমাকে বসতে বললেন। মিনিট পাঁচেক বাদে উনি প্রক্ষালণ সেরে গামছায় হাত-পা মুছে, সেটি বারান্দার দড়িতে মেলে, আমার উল্টো দিকের চেয়ারে এসে বসলেন। এবার আমার আসার অভিপ্রায় ওঁকে জানালাম। এবং এও বললাম, ‘সারা দেশের লোক আপনাকে মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চিনলেও, আমি কিন্তু আপনাকে নাটকের মানুষ বলেই চিনি। বিরুপাক্ষ ছদ্মনামে আপনার অসংখ্য রম্য রচনার নাটকীয় পাঠ রেডিওতে বহুবার শুনেছি। আপনি এলে আমরা খুব খুশি হব।’
প্রায় আধ ঘণ্টা নানা বিষয়ে কথাবার্তা হওয়ার পর, উনি আসতে রাজি হলেন। তার আগে অবশ্য জেনে নিয়েছেন, নাটকটি কয় অংকের অর্থাৎ সময়সীমা কতক্ষণ এবং ওঁকে কীভাবে আনা-নেওয়া হবে? উনি বিরতি পর্যন্ত নাটক দেখতে রাজি হলেন এবং হাতে টানা রিকশায় যেতে-আসতেও সম্মত হলেন। ওই অল্প সময়ের আলাপচারিতায় বুঝেছিলাম, মানুষটি ভীষণ আড্ডাবাজ। এবং মনের মতো লোক পেলে উজাড় করে দেন মনের কথা। উনি বললেন, ‘আজ তো তোমাকে কিছু খাওয়াতে পারলাম না, তুমি কালকে একবার সন্ধের দিকে আসতে পারলে ভালো হয়।’ আমি রাজি হলাম। এমন একটা মানুষ আমাকে নিজে ডেকেছেন, যাব না মানে! তাছাড়া আমন্ত্রণপত্র রেডি করে ওঁকে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারটাও তো আছে। প্রণাম করে বিদায় নেওয়ার সময় বললেন, ‘তুমি তো এখনও ডাক্তার হওনি, ফাইনাল ইয়ারে পড়ছো। পারলে আমার জন্য একটা ভালো টনিক নিয়ে এসো তো! বয়স হয়েছে, শরীরটা দুর্বল লাগে।’
পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় আবার হাজির হলাম আমি। সঙ্গে এক ইন্টার্ন ডাক্তার দাদার থেকে সংগ্রহ করা এক বোতল টনিক। পেয়ে খুব খুশি হলেন। আমাকে পাশের দোকান থেকে কিনে আনা কচুরি খাওয়ালেন, সঙ্গে চা। আমি তখন একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে চলেছি, যেটির কথা একটু আগেই বলেছি। সেই পত্রিকার জন্য ওঁর একটি বিরুপাক্ষ ছদ্মনামের লেখা চাইলাম। রাজি হলেন। তবে সামান্য কিছু সম্মান দক্ষিণা চাইলেন। বললেন, ‘এখন তো আমি বেকার। যদি সম্ভব হয় আমাকে কিছু সম্মান দক্ষিণা দিও।’ আমি দিয়েছিলাম, মাত্র পনেরো টাকা, উনি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। অনেক কথাই তো ওঁর সঙ্গে হয়েছিল দু’দিনের আড্ডায়। সব কথা এখন আর মনে নেই। তবে দুটো কথা মনে আছে, বলি। প্রথমটি হল, বেতার কর্তৃপক্ষ ওঁকে না জানিয়ে ‘দেবীদুর্গতিহারিণীম’ (যেটি আমাদের কাছে উত্তমকুমারের মহালয়া নামে পরিচিত) সম্প্রচার করায়, উনি খুব অপমানিত, দুঃখিত এবং ব্যথিত হয়েছিলেন। পাশাপাশি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন, বঙ্গবাসীর তীব্র ক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখে এবং ফোনে মহানায়ক উত্তমকুমার তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করায়। আড্ডায় একাধিকবার বলেছেন, ‘তোমাদের ওই উত্তম কুমার, সে কিন্তু আমার বন্ধু, আমার এই বাড়িতে এসেছে। তুমি যে চেয়ারটা এখন বসে আছো, ওই চেয়ারটাতেই বসেছে। এবং আমাকে বীরেনদা বলে ডাকে, সম্মান করে।’

এসব তো কত বছর আগের কথা! ৪৩/৪৪ আগের তো হবেই। তবু গৌরবর্ণ আনুনাসিক সুরের ওই প্রণম্য মানুষটিকে আমি ভুলতে পারিনি আজও। শুধু আমি কেন, সারা পৃথিবীতে যেখানে যত বাঙালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, বছরের একটি দিন অর্থাৎ মহালয়ার পূণ্য প্রভাতে ওনাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। ওঁর কণ্ঠে স্তোত্র পাঠ শুনে ওই দিন আমাদের ঘুম ভাঙে যে! যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমো…

Skip to content