শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ভাবনার নানা মুখ। (চিত্রকলা: সংগৃহীত)

 

ভাগ- ৬ (ক্রমশঃ)

স্টেজের অন্য অংশে এক চায়ের দোকানের সামনে আলো জ্বলে। সেখানে বেঞ্চে বসে বছর ৪৫/৪৬ চশমা পরা ছাপোষা সোমনাথ ও তার স্ত্রী বাণী (৩৮/৩৯) – ও অমলকান্তি কথা বলছে।

অমলকান্তি: না- দ্যাখো তোমার ব্যবসা নিয়ে আমার বলার কিছু নেই – তখন ভোম্বলের কাছে আমি সবটাই শুনেছিলাম। নটবর মিত্তিরের মতো একটা দালালের সাহায্যে নিজের ব্যবসার জন্যে গরিব বন্ধুর বোনকে- আসলে ভোম্বল বা কমলা কেউই মেনে নিতে পারেনি– তোমার বাবা অবশ্য জানতে পারেননি – হয়তো বা জানতে চাননি – যাক গে ওসব!! পুরোনো প্রশ্ন তোলাটা বোধহয় ঠিক হল না!! (মাথা নাড়তে থাকে) না না আমার ভাইঝি নীতা আমায় এতো করে শেখায় কিন্তু আমি উচিত প্রশ্নটা সেই, করেই ফেলি!!

সোমনাথ: এটা তো স্বাভাবিক প্রশ্ন!! মানে যাঁরা আমার শুরুটা জানেন- (অমলকান্তি বাণীর সামনে ইতস্তত করেন) নানা, বাণী সব জানে। আমি কাউকে কিচ্ছু লুকোইনি!

বাণী: হ্যাঁ আমি সবটাই জানি – সোমনাথ কেজরিওয়াল কটন মিলসে কেমিক্যাল সাপ্লাইয়ের একটা খুব বড় অর্ডারের সুযোগ পেল –স্যাম্পেল ল্যাবে পাশ করলেও অর্ডারটা চিফ অফিসার মিঃ গোয়েঙ্কার টেবিলে আটকে ছিল।

সোমনাথ: সহজে ব্যবসা পেতে গেলে কমিশন দিতে হয় – এটা বিশুদার অফিসেই শিখেছিলাম – কিন্তু মিঃ গোয়েঙ্কার চাহিদাটা যে নারীসঙ্গ সেটা আমায় নটবর মিত্তির শেখালো।

অমলকান্তি: আচ্ছা এসব থাক না।

সোমনাথ: থাকবে কেন!! – গোয়েঙ্কার দাবি মেটাতে গিয়ে ওই নটবর মিত্তিরের সঙ্গে রাতের কলকাতার কদর্য চেহারাটা দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম- গোয়েঙ্কার জন্যে নটবর মিত্তির যাদের চেষ্টা করেছিল তাদের না পেয়েই আমরা যুথিকার কাছে পৌঁছে গেলাম।

বাণী: যুথিকাই যে সুকুমারদের বোন কণা সেটা ও ট্যাক্সিতে উঠে বুঝতে পারলো –সোমনাথ কণাকে গোয়েঙ্কার হাতে তুলে দিতে চায়নি – বার বার ট্যাক্সি ঘুরিয়ে নিতে চেয়েছিল। সোমনাথ কণাকে বলেছিল হোটেলে ক্লায়েন্টের ঘরে যেতে হবে না – টাকা সোমনাথ এমনিই দেবে- কণা কিছুতেই রাজি হয়নি – বারবার বলেছে তার নাম কণা নয় – যুথিকা।

সোমনাথ: (অন্যমনস্ক) কেমিক্যাল সাপ্লায়ের অর্ডারটা পেয়ে আমি গেলাম- (স্বাভাবিক) তবে শুরুটা গণ্ডগোলের পথে হলেও – পদস্খলন ওই একবারই- “নটবর মিত্তিরের সাহায্য” জীবনে ওই একবারই নিতে হয়েছিল –তারপর আমি পরিশ্রম করে সাদা রাস্তাতেই।

বাণী: কণাকে সোমানাথ হারিয়ে যেতে দেয়নি। কণাকে সোমনাথ ফিরিয়ে এনেছে – সুকুমারদার কাজের ব্যবস্থা করেছে- কণা যে ছেলেটিকে ভালোবাসতো ও নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার সঙ্গেই কণার বিয়ে দিয়েছে।

সোমনাথ: কণার স্বামী এখন আমার কাছে কাজ করে। বিশুদার অফিসের থেকে বেরিয়ে আমি নিজে ঘর ভাড়া নিয়ে ক্লাইভ রোতে অফিস করেছি – চায়ের ব্রোকারি করি – বাগানের চা কিনে খুচরো ব্যবসায়ীদের বিক্রি করি।

অমলকান্তি: আবার রাস্তার চাও খাও?
সোমনাথ-বাণী-অমলকান্তি তিনজনেই হেসে ফেলে।
বাণী: সুকুমারদা এখন আর ট্যাক্সি চালায় না নিজেই গাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা করে।

সোমনাথ: আমার জানা একজনের ভেঞ্চার ছিল এখন সুকুমার ভালোই চালাচ্ছে।
অমলকান্তি দুজনকে দুচোখ ভরে দেখে।

অমলকান্তি: বাঃ!! আজকের সকালটা তোমরা বদলে দিলে –

বাণী: একদিন আসুন না আমাদের বাড়িতে – মানে সোমনাথদের পুরোনো বাড়ি! আমাদের সে বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট উঠে গিয়েছে।

সোমনাথ: বউদি বাড়ি ফিরুক! আমি নিজে গিয়ে আপনাকে- আপনার ঠিকানাটা।

অমলকান্তি: বরং তোমার ঠিকানাটা দাও! (আলো নেভে)
আরও পড়ুন:

নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি/৪

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: কবে আসবে তুমি মননের সে ‘সহযাত্রী’? [০৯/০৩/১৯৫১]

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৬: শারদীয় সংখ্যায় লিখে পাওয়া অর্থ বন্যাপীড়িত মানুষের কল্যাণে

শারদীয়ার গল্প-৪: অস্মর্তব্য

 

ভাগ- ৭

আলো জ্বলে লেখকের অংশে- আজ লেখকের পাজামা-পাঞ্জাবীর ওপরে হাউসকোট – অমলকান্তি গায়ের আলোয়ান ঠিক করে নেয়।

লেখক: তুমি কোনওদিন কাউকে তোমার ঠিকানা দাও না কেন বলো তো?

অমলকান্তি: কারণ আমরা ঠিকানা নিই বটে। তারপর সেই ঠিকানা লেখা কাগজটাই গর-ঠিকানায় হারিয়ে যায়। কি যায় তো?

লেখক: শীত করছে? এটা বুড়ো হওয়ার লক্ষণ

অমলকান্তি: মিনিকে দেখছি না তোমার নাতনি?!

লেখক (অপস্তুত): না মানে- মিনি

অমলকান্তি: বাড়ি নেই?!

লেখক: না –সে বাড়িতেই

অমলকান্তি: বুঝেছি। জ্বরজ্বালি। শীতের শুরু আর শেষটা বাচ্ছাবুড়ো সকলকেই ভোগায়!!

লেখক: না হে সে সব নয়।

চরিত্রের সাদাকালো। (চিত্রকলা :সংগৃহীত)

অমলকান্তি: তাহলে দাদুর সঙ্গে ঝগড়া করে মন খারাপ!

লেখক: না, আসলে ও মেন্টালি খুব শকড! ওর ক্লাসের একটি মেয়ে একই বয়সী –সুসাইড আটেম্পড করেছিল।

অমলকান্তি: সে কি! কেমন আছে সে!

লেখক: বেঁচে গিয়েছে!

অমলকান্তি: একরত্তি বয়সে কিসের এ তো দুঃখ!! মরলে দুঃখ কমবে??

লেখক: মেয়েটির কিছু ইনটিমেট ছবি তারই এক ছেলে বন্ধু নেটে আপ লোড করে দেয় –সেই লজ্জায় মেয়েটি!

অমলকান্তি: তা সে শারীরিক ছবি সে ছেলের কাছে গেলো কী করে?

লেখক: ন্যাচারালি তাদের মধ্যে রিলেশন ছিল!

অমলকান্তি: বয়েস কতো?

লেখক: ক্লাস এইট। আট পাঁচ তেরো বা মাক্সিমাম চোদ্দ ধরো।

অমলকান্তি: নীতা ঠিকই বলে – বাতাসের সঙ্গে পরিবেশের সঙ্গে মানুষের মনটাও বিষিয়ে গিয়েছে। গুডটাচ ব্যাড টাচ শিখিয়ে এসব বন্ধ হবে না – সহবৎটা শেখাতে হবে। গণ্ডিটা মুছে গিয়েছে! তুমি তো উদার এবং আধুনিক। আমাকে সোশ্যাল জ্যাঠামশাই-এর তকমা দিতে চাও কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু ওই বিষাক্ত ছেলেটির হাত-পা কেটে মাথান্যাড়া করে সারাদেশ পায়ে হেঁটে ঘোরালেও রোগটা শেষ হবে না। আসলে মেয়েটিকে নিজেকে সহজেই বে-আব্রু করার ভয়ংকর প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে। নানা- ওই টিভির প্রশ্ন কোরো না – মেয়েটিকেই বা কেন? তবে সেই কী শুধু দোষী! ওগুলো পচা এবং বাজে প্রশ্ন। দোষটা ওই ১৪/১৫ বছরের মেয়েটার বা ছেলেটার নয়। দোষ তাদের বাবা কাকা মামা মা জেঠী কাকির। দোষটা ওদের বড় করার ভুল পদ্ধতিটার- ভুল এটা নিয়ে অকারণ আলোচনা ও বিতর্ক সভার। মেয়েটিকে বোঝাতে হবে তার সাবধানতার কথা। ছেলেটিকে শেখাতে চেনাতে হবে সহজ ভুলের রাস্তা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলার পথ। পারিবারিক মর্যাদার গণ্ডিটা তার মাথায় বসিয়ে দিতে হবে- যাকে মূল্যবোধ বলে- মাঝের ও-কার টা তুলে দিয়ে আজকাল অবশ্য অনেকেই তার মূল্য –বধ করছে।
আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প-৩: আলোকসংশ্লেষ

ছোটদের যত্নে: বাচ্চা খেতেই চায় না? কী করে খিদে বাড়াবেন? কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪: যুদ্ধযাত্রী নবীনকিশোর, ভীত-শঙ্কিত পিতৃহৃদয়

গৃহসজ্জা: মডিউলার কিচেন বানাতে চান? তাহলে এই এই বিষয়গুলি খেয়াল রাখুন?

লেখক: কিন্তু এতবড় কঠিন কাজ। অ-নেক সময় সাপেক্ষ।

অমলকান্তি: রোগ যত পুরোনো হবে চিকিৎসার সময় তত বাড়বে – তবে কি জানো- তোমার নাতনির মনটা টবের ছোট্ট গাছের মতো নরম তো- ডাল পালাগুলো পাতলা, ভেতরের শিরা উপশিরা সব যেন স্পষ্ট- তাই বন্ধুর কষ্ট তাকে এ তো কাহিল করছে। আবার যখন আমার মতো বুড়ো হবে তখন সময়ের চাকায় পিষ্ট ছিন্নভিন্ন বন্ধুত্বকে দেখে করুণা হবে –আমার তো আবার হাসিও পায়- সে দিন সুধীন্দ্র বোসের আপিসে যা হল।

লেখক: ফিকি-র সুধীন্দ্র বোস?

অমলকান্তি: হ্যাঁ! ওদের তো দাদুর আমলের ব্যবসা – ভালো চাকরি তারপর মামা-শ্বশুরের সূত্রে তার স্ত্রী পেল একগাদা টাকা! একেবারে ত্র্যহস্পর্শ যোগ!

লেখক: আচ্ছা তোমার এই টইটই করে ঘুরতে ভালো লাগে??

অমলকান্তি: তোমরা তো কেউ আমার বাড়ি যাবে না – অগত্যা- আমাকেই তোমাদের কাছে পৌঁছতে হয়! (আলো নেভে) —চলবে

[বহুরূপী ব্যতীত আর কোনও নাট্যদলকে এ নাটকের মঞ্চাভিনয়ের অনুমতি দেওয়া হয়নি। নাটকটি ভারত সরকারের রেজিস্ট্রার অফ কপিরাইটস-এ দ্বারা আইনত রেজিস্ট্রিকৃত (L-76713/2018) নাটকের পূর্ণ বা আংশিক মঞ্চ, শ্রুতি বা চিত্রাভিনয় বা কোনপ্রকার অনুবাদ আইনত দণ্ডনীয়]

Skip to content