রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


বাঙালির বারো মাসে তেরোপার্বণ, আর তার মধ্যে সবথেকে বড় উৎসব দুর্গাপুজো। শরতের আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, মাঠভরা কাশফুল, গাছে-গাছে শিউলি— এই মনোরম পরিবেশেই মা দুর্গার আগমন হয়। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের প্রায় প্রথমা তিথি থেকে শুরু করে দশমী তিথি পর্যন্ত এই মহোৎসব উদযাপিত হয়। মা দুর্গা শক্তির দেবী। অশুভের বিনাশে শুভশক্তি প্রতিষ্ঠার প্রতীক এই পুজো। মাতৃ মূর্তির পাশাপাশি তনয়া পুজো করা এই উৎসবের একটি বড় আকর্ষণ। বাঙালির এই মহোৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নানান সমাজমূলক কাজ। বিভিন্ন জায়গায় অনগ্রসর শ্রেণির হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন জামা কাপড়। মা দুর্গার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ একদিকে যেমন উৎসবের রঙে রাঙা হয়ে ওঠে সেইরকমই এই কয়েকটা দিন কিছু মানুষের রুজি রোজগারের জোগান দেয়। ছোট-বড় নানান শিল্পকলার প্রসার ঘটে এই সময়।
থিম পুজোর প্রচলন শুরু হওয়াতে বিভিন্ন ধরনের শিল্পীরা তাদের শিল্পসত্ত্বা প্রসার করার সুযোগ পায়। এই থিমপুজোর দরুণ এমন অনেক অব্যবহৃত সামগ্রী যেমন পুরনো টায়ার, বোতল, ফেলে দেওয়া ক্যাসেট ইত্যাদি প্যান্ডেল সজ্জাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই সকল কারণে একদিকে যেমন অব্যবহৃত সামগ্রীগুলির রিসাইকেল হচ্ছে অপরদিকে পুজো কমিটিগুলির ব্যয় সংকোচন হচ্ছে। থিম পুজোগুলির ভাবনা (গাছ লাগানো, জল অপচয় না করা বা সদ্য ঘটে যাওয়া মহামারি থেকে মুক্তি ইত্যাদি) থেকে উঠে আসে পরিবেশ রক্ষামূলক নানান বার্তা। পুজোর জন্য কুমোরটুলিতে মৃৎশিল্পীদের ঘরে আনন্দের আলো ঝলমল করে। সারা বছর তারা কষ্ট করলেও এই সময়টা তে মূর্তি বিক্রয়লব্ধ অর্থ হাতে আসার ফলে কিছুটা সুখের দিন যাপন করে। মৃৎশিল্প টিকে থাকার সবচেয়ে বৃহৎ উদযাপন হলএই পুজো।
আরও পড়ুন:

ইংলিশ টিংলিশ: ‘CATS & DOGS’ অথবা ‘BLACK SHEEP’ — আসুন দেখি এগুলোর মানে আসলে কী?

শারদীয়ার গল্প-৪: অস্মর্তব্য

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৬: শারদীয় সংখ্যায় লিখে পাওয়া অর্থ বন্যাপীড়িত মানুষের কল্যাণে

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৮: দশরথের অভিলাষ-রামের রাজ্যাভিষেক সংকল্প

যোগা-প্রাণায়াম: পিসিওডি এবং পিসিওএস-এর সমস্যা? চিন্তা নেই যোগায় আছে সমাধান

চিত্র শিল্পীদের তুলির টানে মায়ের রূপের মাধুর্য ছড়িয়ে পরে চারিদিকে, তাই সারাবছরের তুলনায় মায়ের আগমনের এই সময়ে চিত্র শিল্পীদেরও একটু বেশি আর্থিক উন্নতি ঘটে। উৎসবের এই আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ডেকরেটার ও আলোকসজ্জা কর্মীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে এই সময়ে। পুজো প্যান্ডেলের আশেপাশে দৃশ্যমান হওয়া নানান বিজ্ঞাপন, ফ্লেক্স-এর মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ায় বিজ্ঞাপন শিল্পী ও ফ্লেক্স প্রস্তুতকারক সংস্থার আর্থিক উন্নতিও এই পুজোকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। কুটির শিল্প যেমন শোলার কাজ, পটচিত্র, ডাকের কাজ ইত্যাদি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কারুকার্য গুলি সারা বছর লক্ষ্য করা না গেলেও পুজোর সময় তার বহুল ব্যবহারে তা দৃশ্যমান হয়ে থাকে।

বাঙালিদের কাছে দুর্গাপুজো মানেই ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে ‘আর সঙ্গে ঢাকের আওয়াজ’। ঢাকিকাকুরা বছরের এই কটাদিনই হয়তো নিজেদের কর্মের সঠিক মূল্য পেয়ে থাকেন। সারাবছর পুরানো পোশাক পরিধান করলেও আপামর বাঙালি মায়ের বাপের বাড়িতে থাকার দিনগুলতে চেষ্টা করে নতুন পোশাক পরিধান করার, তাই তো এইসময়ে দর্জি, তাঁতি এবং পোশাক বিক্রেতারা কিছুটা লাভের মুখ দেখতে পারে। বাঙালির কাছে দুর্গাপুজো কেবল একটা ধর্মীয় উৎসবই নয়— এ এক মিলন উৎসব, এ এক সামাজিক উৎসব ও বটে। দেশ-বিদেশে কর্মরত বঙ্গবাসী একমাত্র এই মহোৎসবেই স্বভূমিতে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিকাশ-এই উৎসবকে কেন্দ্র করে উদযাপিত হয়। কলকাতার পুজোর প্যান্ডেলসজ্জা, আলোকসজ্জা, প্রতিমা দর্শনের লক্ষ্যে অসংখ্য বিদেশী দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে এই বাংলায়, যার ফলে দেশে বিদেশী মুদ্রার আমদানিও ঘটে থাকে।
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: বাচ্চা খেতেই চায় না? কী করে খিদে বাড়াবেন? কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত

দেখব এবার জগৎটাকে, পর্ব-১৩: ওকে নাড়ানোর চেষ্টা করলাম, সেও মিটমিট করে দেখল, ভাবলাম অ্যানাকোন্ডাটি হয়তো শিকারের আয়তন মাপছে!

নিয়ম মানুন, সুস্থ থাকুন—পুজোয় ভালো থাকার সহজ উপায় জানালেন ডাক্তারবাবু

মনের আয়না: পরীক্ষার আগে হারাচ্ছে মনঃসংযোগ? কী করলে ফিরবে মনঃসংযোগ? জেনে নাও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতামত

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-২৯: একাগ্রচিত্ত অর্জুন উর্বশীকেও ফিরিয়ে দিলেন

একটি পুজো প্যান্ডেলকে কেন্দ্র করে মণ্ডপের বাইরে ‘মেলা’ও বসে থাকে, যেখানে পাওয়া যায় নানান খেলনা, সাজসজ্জা, ঘরসজ্জা ইত্যাদি সামগ্রী এবং খাবারের নানান স্টল। বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষ পুজোর দিনগুলিতে নানা ভাবে আয়ের পথ খুঁজে নেয় যাতে পরের কয়েকটা দিন সুখে থাকতে পারে। পুজো কমিটিগুলি নানা ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এই সময় তারা বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা শিবিরের ব্যবস্থা করে যাতে দুঃস্থ মানুষজন বিনামূল্যে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রোগ নির্ণয় ও তার চিকিৎসা কিভাবে সম্ভব তা জানতে পারে। অনেক সময় পুজোকমিটিগুলো দুঃস্থ রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পথ্য দিয়ে সাহায্য করে থাকে।

অন্নদামঙ্গল কাব্যে ঈশ্বরী পাটনী বলেছিলেন— “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”। মা দুর্গাও চান তাঁর আগমনে মর্তবাসী কেউ যেন না খেয়ে থাকেন। তাই দেবী যতদিন আমাদের কাছে পূজিত হন ততদিন পুজো কমিটিগুলো প্রসাদ রূপে মায়ের ভোগ বিতরণ করে। যার ফলে সকলের সাথে অভুক্ত ও দুঃস্থ মানুষজনের ক্ষুন্নিবৃত্তির নিবারণ ঘটে। রোজকার ব্যস্ততায় ছুটে চলা জীবনে বিশেষ করে বাঙালি এবং আরও বিভিন্ন জাতির মানুষের কাছে দুর্গাপুজোর কয়েকদিন ফুস্ফুসে টাটকা অক্সিজেন এনে দেয়, যা মানসিক স্বাস্থের জন্য খুবই উপযোগী।

ঋজা, রহড়া ভবনাথ ইনস্টিটিউশন ফর গার্লস স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী

Skip to content