মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌরভ চক্রবর্তী

চিনতে পারছেন?
বক্তৃতার পালা সাঙ্গ হয়ে গেছে বহুক্ষণ‌। অনুষ্ঠান‌ও প্রায় শেষের মুখে। স্টেজে বসে থাকতে-থাকতে ধোঁয়ার তেষ্টাটা ক্রমশ‌ই তীব্র হয়ে উঠছিল। শেষ অবধি থাকতে না পেরে নেমে আসছিলেন সুজন। স্টেজ থেকে নেমে হলঘরের বড় দরজাটার মুখে আসতেই আচমকা এই প্রশ্ন।
সবে জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছিলেন। সিগারেটের প্যাকেট আর বের করা হল না। হাতটা নিজের অজান্তেই নেমে এল। পরণে এখন শাড়ি উঠেছে, কপালে সিঁদুর। ভারী হয়েছে কোমর। তবে এক বিন্দুও বোধহয় শিথিল হয়নি সেই সৌন্দর্যের আকর্ষণ।
—চিনতে পারলেন না? সত্যিই চিনতে পারলেন না?
প্রথম প্রশ্নে ছিলে কৌতুকের ছোঁয়া। এবার যেন হতাশায়, বেদনায় টুকরো টুকরো হয়ে গেল সেই একই জিজ্ঞাসা।
না চিনতে পারার সম্ভাবনা যদিও ষোল আনাই ছিল, তবুও ভুল হয়নি সুজনের। মাত্র বারো ঘণ্টার স্মৃতি বছর পনেরো-কুড়ি পরে আর কারই বা মনে থাকে? কিন্তু সেই স্মৃতির সঙ্গে যদি জড়িয়ে থাকে ভালোলাগার এক তীব্র অভিঘাত? পনেরো-কুড়ি কেন, বোধহয় আমৃত্যুই সঙ্গী থেকে যায় সেই স্মৃতি।
— ভালো আছো?
অত্যন্ত ধীর, মৃদু গলায় প্রশ্ন করলেন সুজন। মৃদু, চাপা স্বরের গাম্ভীর্য‌ই প্রকাশ করে দিল তার আবেগ। প্রশ্ন কানে যাবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে গেল ভদ্রমহিলার। কয়েক মুহূর্ত। তারপরই চোখের পাতা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই দু’চোখের কোলে জল দেখলেন সুজন।
—আপনি ভালো আছেন?
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথিকে মঞ্চ থেকে নেমে আসতে দেখেই ছুটে এসেছিলেন উদ্যোক্তাদের দুজন। কিন্তু এই দৃশ্য, কথোপকথনের এই অন্তরঙ্গতা, তাদের থমকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল কয়েক কদম দূরে। এবার তাদের দিকে চোখ গেল সুজনের।
— স্যার…
ছেলে দুটির কণ্ঠ স্পষ্টতই কুণ্ঠার জড়তা। সেই কুণ্ঠাজাত তৃপ্তি আরও একবার সর্বাঙ্গে মেখে নিলেন সুজন। মেখে নিলেন, কারণ এই কুণ্ঠার উৎস তিনি জানেন। ছোট্ট এই মফস্বল শহরে তাঁর মতো ব্যক্তিত্বকে পাবার আশা এরা করেনি। কাল রাত্রে ট্রেন থেকে নামা অবধি প্রতি মুহুর্তেই তা টের পাচ্ছেন।
— না না ভাই, এমনিই উঠে এলাম। তোমরা ব্যস্ত হয়ো না।
আবার ভদ্রমহিলার দিকে ফিরলেন সুজন, “চলো আমরা বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।”
তীব্র ঝোড়ো হাওয়া আর সেই সঙ্গে মুষলধারে বর্ষণ। আবহাওয়া কদিন ধরেই খারাপ যাচ্ছিল। নদী-নালা সব ট‌ইটম্বুর। বন্যার আশঙ্কা এইসময় প্রতি বছরই থাকে। কমবেশি হয়‌ও প্রতিবছরই। বিশেষত এই উত্তরবঙ্গে। মা তাই প্রথম থেকেই আসতে দিতে চাননি। কিন্তু না চাইলেই কি আর সব হয়? প্রায় বছর পাঁচেক বেকার বসে। এই সময় একটা ইন্টারভিউ হাতছাড়া করা মানে…
সুজন তাই জোর করেই এসেছিল। কলেজ সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউ। হিল এরিয়ার কলেজগুলোর জন্য অধ্যাপক চাই। এমন অদ্ভুত ইন্টারভিউয়ের আয়োজন কমিশন আগে কখনো করেনি। তাদের যা কিছু ইন্টারভিউ সবই কলকাতায় তাদের নিজস্ব অফিসে, গড়িয়াহাটের মোড়ে বাসন্তী দেবী কলেজের ক্যাম্পাসে। এবারে এমনতর ইন্টারভিউয়ের আয়োজন সম্ভবত সুভাষ ঘিসিংয়ের দাবিতে। নবগঠিত গোর্খাল্যান্ড কাউন্সিলের চাপে।
প্রায় বছর পাঁচেক নতুন কোনও ইন্টারভিউ কমিশন করেনি। আর সুজনেরও অদ্ভুত গোঁ, অধ্যাপনার চাকরি ছাড়া অন্য চাকরি সে করবে না। বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছিল। ইন্টারভিউয়ের আগে পর্যন্ত অন্য কোন দিকে মন ছিল না। কিন্তু আজ দুপুরে ইন্টারভিউ শেষ হওয়া ইস্তক ভয়টা চেপে বসেছে। ইন্টারভিউ শেষ হবার পর প্রথমে অবশ্য এসেছিল বিরক্তি। ফার্স। সবটাই লোক দেখানো। মাথাপিছু দেড় মিনিটের ইন্টারভিউতেই টের পেয়ে গিয়েছিল এসব ফালতু। হয় গট আপ কেস, নয়তো লোক-ফোক কিস্যু নেবে না।

কিন্তু সেই বিরক্তিও কেটে যেতে দেরি হয়নি আকাশের অবস্থা দেখে। বাসস্ট্যান্ডে লোকজনের কথাবার্তা থেকেই টের পাচ্ছিল, বন্যা আসছে। দেরি না করে তাই কলকাতা- অভিমুখী প্রথম বাসটাতেই উঠেছে। কিন্তু বাস যত এগোচ্ছে বৃষ্টির বেগও যেন তত বাড়ছে। থমথমে মুখে বাসে বসে আছে সুজন। পাশেই যে একটি সুন্দরী সহযাত্রিনী, সেদিকেও খেয়াল নেই। হঠাৎই ঝাঁকানি খেয়ে বাস থেমে গেল।
— কি হল?
সুজন‌ই প্রথম উঠে দাঁড়ালো। আতঙ্ক তার কোন গভীরে বিস্তারিত হয়ে গেছে তা এই দ্রুত প্রতিক্রিয়া থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেল।
বাসের একেবারে সামনের দিকের সিট থেকে উঠে দাঁড়ালো কন্ডাক্টর‌ও। তারপর সুজনের দিকে একবার তাকিয়ে, উত্তর না দিয়ে, গম্ভীর মুখে ছাতা নিয়ে নেমে গেল নিচে। ছটফট করতে করতে সিট ছেড়ে ড্রাইভারের সামনে চলে এলো সুজন, “কি হল দাদা?”
উত্তর না দিয়ে ড্রাইভার সামনের দিকে অঙ্গুলি সংকেত করলেন। আতঙ্কিত চোখে সুজন দেখল গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ। কপালে হাত দিয়ে ধপ করে ড্রাইভারের পাশে বসে পড়ল সে।
“ঘাবড়াবেন না, তামাং যখন নেমেছে, ব্যবস্থা একটা হবে”। ড্রাইভারের কথায় টের পেল তামাং কন্ডাক্টর তামাংকে দেখা গেল। সঙ্গে তার জনা পাঁচ-ছয় লোক। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুজন এবার উঠে দাঁড়াল। লোকগুলো দ্রুতই হাতক্টারের নাম। খুব একটা ভরসা না পেলেও সেখানেই বসে রইল সুজন। বাসের কোথাও আর কোন‌ও শব্দ নেই। আকণ্ঠ উৎকণ্ঠা সবার মুখের শব্দটুকুও কেড়ে নিয়েছে। সবাই যেন রুদ্ধশ্বাসে কোন‌ও অলৌকিক সমাধানের আশায় বসে আছে।
এই মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে কি ব্যবস্থা হবে, কিভাবে হবে, কিছুই মাথায় ঢুকছিল না সুজনের। আশেপাশে কোন‌ও জনবসতি আছে বলেও তো মনে হচ্ছিল না তার।
তবে ব্যবস্থা সত্যিই একটা হল। মিনিট দশেক পরে ভেজা উইন্ডস্ক্রিনের মধ্যে দিয়ে ছাতা মাথায় কন্ডাক্টর তামাংকে দেখা গেল। সঙ্গে তার জনা পাঁচ-ছয় লোক। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুজন এবার উঠে দাঁড়াল। লোকগুলো দ্রুতই হাত লাগাল কাজে। তাদের হাতের টানে গাছ নড়তে সে নিজের সিটের দিকে পা বাড়াল।
— কিছু হল?
সিটে বসতে গিয়েও ফের সোজা হয়ে দাঁড়াল সুজন। এতক্ষণে প্রথম চোখ মেলে দেখল তার সহযাত্রিনীকে। দেখল এবং দেখে মুগ্ধ হল। তারপর মৃদু স্বরে জবাব দিল, “রাস্তায় গাছ পড়েছিল। ওরা গাছ সরাচ্ছে”।
সুজন বসে পড়ল।
— বাব্বা, যা ভয় করছিল আমার!
— স্বাভাবিক।
মাপা, সংযত জবাব দিল সুজন।
— তবু, ভাগ্যিস আপনি সঙ্গে আছেন!
চমকে উঠল সুজন। তার মানে! সুজনের চমকে ওঠা লক্ষ করে এবং তার কারণ বুঝে মেয়েটিও দ্রুত বলে উঠল, “না, মানে আপনিও বোধহয় আমার মতই কলকাতা যাবেন, তাই না?”
এতক্ষণে চারপাশটাকে দেখল সুজন। বাসে আর একটিও মহিলা নেই। নেই কোন‌ও অল্প বয়স্ক পুরুষ‌ও। সবাই মাঝবয়সী। দেখলে মনে হয় এরা এদিককার লোকজনই। কেন মনে হয়, ব্যাখ্যা নেই। মনে হচ্ছে, এই মাত্র। হতে পারে মেয়েটির অনুমান তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে তারও একইরকম মনে হচ্ছে। সুজন ওর কথার তাৎপর্য ধরতে পেরে চুপ করে গেল। নিজের প্রগলভতায় মেয়েটিও বোধহয় লজ্জা পেয়েছে। দুজনের নীরবতার মধ্যেই বাস ছেড়ে দিল।
বৃষ্টি আগের মতোই মুষলধারে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই দুশ্চিন্তা যেন অনেকটা কেটে গেছে। সুজন চুপচাপ বসেছিল। সেই আগের মতই, শুধু ভেতরের অস্থিরতাটা একটু কম। এবং তাই বোধহয় আবার ঘস…স করে থেমে গেল বাস।
“আবার কি হল!” প্রতিক্রিয়াটা এবারও প্রথমে এল সুজনের কাছ থেকেই, তবে এবার একটু ধীর লয়ে। এবং এবারও কন্ডাক্টার তামাং নীচে নেমে গেলেন ছাতা হাতে।
সুজন উঠে দাঁড়িয়ে দেখল সামনে দীর্ঘ ট্রাকের সারি। কিসের জ্যাম এটা? তার অস্বস্তি হচ্ছিল।
“বসুন, দাঁড়িয়ে থেকে কি করবেন?”
সুজন বসে পড়ল। “কি ব্যাপার বলুন তো?”
মেয়েটি জবাব দিল না। তার কাছে কোনও জবাব ছিল না। সুজনও জবাবের প্রত্যাশা করেনি।
আগেরবারের মতই কন্ডাক্টর তামাং যখন নেমেছেন ব্যবস্থা একটা হবে, এই আশাতেই সুজন বসেছিল। বাস এত নিস্তব্ধ হাতঘড়ির টিকটিক শব্দটাও কষ্ট না করে শোনা যাচ্ছিল। কোলের উপর রাখা পেটমোটা ব্যাগটিতে মাথা রেখে সুজনের সহযাত্রিনী চুপ করে শুয়েছিল। আড়চোখে একবার সেই শরীর দেখল সুজন। আধশোয়া হয়ে থাকলেও মেয়েটির শারীরিক গঠন বেশ সুন্দর। পিঠ দেখেই সেটা বোঝা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প-৩: আলোকসংশ্লেষ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৬: শারদীয় সংখ্যায় লিখে পাওয়া অর্থ বন্যাপীড়িত মানুষের কল্যাণে

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-৩১: সাহিত্যিক যখন কাছের মানুষ: প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং বুদ্ধদেব গুহ

নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি/৩

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৮: দশরথের অভিলাষ-রামের রাজ্যাভিষেক সংকল্প

মুখ ঘুরিয়ে বাসের ভেতর তাকাল সুজন। এবার যেন একটা নড়াচড়া শুরু হয়েছে বাসের মধ্যে। সবাই যে উসখুস শুরু করেছে সেটা বোঝা যাচ্ছিল। ঘড়ির দিকে তাকাতে অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল। আধ ঘন্টা কেটে গেছে ইতিমধ্যে। তামাংয়ের টিকি দেখা যাচ্ছে না। জ্যাম কাটারও বিন্দুমাত্র আভাস নেই। হঠাৎই একজন যাত্রী সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বাসের অন্য সবার দিকে একবার তাকালেন। তারপর সবাই বসে আছে দেখেই সম্ভবত আবার বসে পড়লেন।
সুজন বাইরে তাকাল। বৃষ্টি সমানতালে পড়ে যাচ্ছে। বাসের পাশ দিয়ে মাঝেমধ্যে দু-একজন এদিক ওদিক হচ্ছে। এছাড়া জীবনের আর কোনো স্পন্দন কোথাও আছে বলে মনে হচ্ছে না। কতদূর এসেছে বাস জানতে পারলে হত। কিন্তু আশেপাশে কোন দোকান-পাটও চোখে পড়ছে না। দোকান থাকলে তার সাইনবোর্ড থেকে বোঝা যেত।
সুজনের বাইরে তাকানো এবং এইসব ভাবনার মধ্যে দু’মিনিটও কাটেনি, সেই ভদ্রলোক আবার উঠে দাঁড়ালেন এবং তারপরই বাসের কাউকে কোনও কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই নেমে গেলেন বাস থেকে।
— আরে, কোথায় যাচ্ছেন ভদ্রলোক?
সুজনের গলার স্বরে আতঙ্ক ফিরে আসছিল। সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কন্ডাক্টর তামাং আর ফিরছিল না। বাসের দ্বিতীয় যাত্রীও এবার নেমে গেলেন, ফিরে এলেন না প্রথম জনও।
প্রথমে এক, তারপর দুই। এবার যেন নামার পালা শুরু হয়ে গেল। একেকজন উঠছেন, চারপাশে সহযাত্রীদের দেখছেন, তারপর নিঃশব্দে নেমে যাচ্ছেন বাস থেকে।
— কোথায় যাচ্ছে এরা সব?
থরথর করে কাঁপছিল মেয়েটির স্বর। তার প্রশ্ন সুজনকে। কিন্তু কি উত্তর দেবে সুজন? দুজনে দুজনের চোখে চোখ রাখল। নীরবে পড়ে নিল আতঙ্কের ভাষা।
চোখ সরিয়ে সুজন সামনে তাকাল। ড্রাইভার স্টিয়ারিংয়ে মাথা রেখেছে। হঠাৎই সুজন আবিষ্কার করল তারা দুজন ছাড়া বাসে আর একটিও যাত্রী নেই। এমনসময়ই কন্ডাক্টার তামাং ফিরে এল। তামাংকে দেখেই ফের উঠে দাঁড়াল সুজন। ওদের দিকে একবার তাকিয়ে তামাং চলে গেল ড্রাইভারের কাছে। তারপর দুজনেই উঠে এল সুজনদের কাছে।
— মাফ করবেন। বাস আজ আর যাবে না।
ড্রাইভারই কথা বলল।
— মানে?
সুজনের চীৎকারে চমকে উঠল মেয়েটি। ক্রোধ ঠিকরে বেরোচ্ছে গলার স্বরে।
— দেখুন, রাস্তায় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। রাত্রে আর এগোন রিস্কি। সবাই তাই দাঁড়িয়ে পড়েছে। যা হবার কাল সকালে হবে।
— তাহলে আমরা এখন কী করব?
নিজের অজান্তেই কখন সুজন মেয়েটিকে তার সঙ্গী করে নিয়েছে। ওর গলার স্বরে অসহায়তা আর আতঙ্ক, আর্তনাদ হয়ে বেরোচ্ছিল। সামান্য আগের ক্রোধ কোথায় উধাও। কে তার ক্রোধের পরোয়া করে?
— আমরা যাচ্ছি, সামনে মাইলখানেক দূরে একটা ধাবা আছে। সেখানে সারারাত বসা যেতে পারে। খাবারও জুটে যাবে। আপনারা ইচ্ছে করলে আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন, নইলে বাসেও থাকতে পারেন। এছাড়া আর তো কোন উপায় নেই।
সুজন চুপ করে রইল। মেয়েটি সম্ভবত সুজনের হাতেই তার ভাগ্য সঁপে দিয়েছে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে ড্রাইভার সঙ্গীকে সঙ্গে করে নিচের দিকে পা বাড়ালেন, “তাহলে আপনারা এখানেই থেকে যান।”
বাস ফাঁকা হয়ে গেল। সুজন দাঁড়িয়ে। শুধু নিজের নয়, তার ঘাড়ে এখন অন্য এক বোঝাও।
“আপনাদের সঙ্গে খাবার আছে তো? নইলে আমি খাবার এনে দিতে পারি।”
ড্রাইভার আবার উঠে এসেছে। প্রশ্ন শুনে দুজনেই দুজনের দিকে তাকাল। কিন্তু প্রশ্নের অর্থ সুজনের মগজে ঢুকেছে বলে মনে হল না। সঙ্গী উত্তর দিচ্ছে না দেখেই বোধহয় মেয়েটির মুখ খুলল। ওর গলার স্বর ভাঙ্গা, প্রায় শোনা যায় না এমন আওয়াজে জবাব দিল, “আছে”।
“ঠিক আছে তাহলে”, তারপর, সামান্য একটু ইতস্তত করেই যেন বলল, “তবে আপনারা বাসের আলো নিভিয়ে দিন। বাইরে কেউ যেন বুঝতে না পারে ভেতরে কেউ আছে”।
ড্রাইভার আবার নেমে গেল। সুজন টের পেল আর তার ফিরে আসার সম্ভাবনা শূন্য। হঠাৎই সে পায়চারি করতে শুরু করল। একবার সামনে, একবার পেছনে। একবার গিয়ে ড্রাইভারের সিটে বসল। তারপর ফের ফিরে এল। এসে বসে পড়ল নিজের সিটে।
— আলোটা নিভিয়ে দিন।
আরও পড়ুন:

ত্বকের পরিচর্যায়: ত্বক শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে? যত্নে কী কী করবেন? জেনে নিন ত্বক বিশেষজ্ঞের জরুরি পরামর্শ

হোমিওপ্যাথি: টনসিলের ব্যথায় নাজেহাল? এই সব উপায়ে মিলবে আরাম

পুজোর ছুটিতে সপরিবারে ঘুরতে যাচ্ছেন? কোন কোন বিষয় মাথায় রাখবেন? রইল ডাক্তারবাবুর জরুরি পরামর্শ

ডিমেনশিয়া ও অ্যালঝাইমার্সের ঝুঁকির মধ্যে আপনি নেই তো? সতর্ক হতে হবে গোড়াতেই/ পর্ব: ১

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩২: দেশে প্রথম গবেষণা সংস্থার কারিগরি সহায়তায় বেড়ে ওঠা সেরা প্রাপ্তি ‘জয়ন্তী রুই’ মাছ

ফিসফিস করে বলল মেয়েটি। বিদ্যুতাহত মানুষের মতো তড়িত্গতিতে গিয়ে সুজন আলো নিভিয়ে এল।
— দরজাটাও লক করে দিন প্লিজ।
মন্ত্রমুগ্ধের মত সেটাও করে এল সুজন। তারপর ফিরে এসে চুপ করে বসে পড়ল সঙ্গিনীর পাশে। বাইরে বর্ষার দাপট তীব্রতর হচ্ছিল। কোন‌ও ভাবনাই যেন আর কাজ করছিল না সুজনের। এতক্ষণ একটা তীব্র উদ্বেগ তার স্নায়ুতন্ত্রকে সচল রেখে দিয়েছিল। এখন সে উদ্বেগ আর নেই। এখন শুধু নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে অপেক্ষা করা। সুজন বাসের সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে অবসন্ন হাল ছেড়ে দেওয়া মানুষের ভঙ্গিতে বসে ছিল।
বাইরে বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছিল ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। হঠাৎ প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়ায় বাঁশের কাঁচগুলো ঝনঝন করে নড়ে উঠল। সেই তীব্র অভিঘাতেও সুজনের শরীরে কোন‌ও নড়াচড়া হল না। তবে সে টের পেল একটা ঠাণ্ডা নরম হাত শক্ত হয়ে চেপে ধরেছে সিটের উপর এলিয়ে পড়ে থাকা তার ডান হাতটাকে।
সেই স্পর্শ যেন সুজনকে বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনল। দমকা হাওয়া তখন সরে গেছে, সরে গেছে সেই নরম হাতও। খানিক পরে সুজন প্রশ্ন করল, “আপনার খিদে পেয়েছে নাকি?”
প্রথমে একটা হালকা ঘাড় নাড়া, তারপর একটু বিরতি নিয়ে, “আপনি খেয়ে নিন না”। কিন্তু সুজনের মধ্যে খাবার কোন‌ও উদ্যোগ দেখা গেল না। আসলে অস্বস্তি কাটাতেই সে প্রশ্নটা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। অতএব আবার সব চুপচাপ।
বাইরে ঝোড়ো হাওয়া আর বাসের মাথায় বৃষ্টির অনর্গল ফোঁটার শব্দে সব কথাই উড়ে যাচ্ছে। আকাশের বুক চিরে মাঝে মাঝে ছোট বড় বিদ্যুৎ আর তার আওয়াজের মধ্যেই “আপনি ভালো করে বসুন, আমি ওদিকের সিটে গিয়ে বসছি” বলে সুজন নড়েচড়ে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু আবার সেই নরম হাত আর আবার সেই দৃঢ় বাঁধন। সুজন টের পাচ্ছিল মেয়েটি ভয় পাচ্ছে। ও নড়াচড়া থামিয়ে দিল। বাঁধন‌ও আস্তে আস্তে আলগা হয়ে গেল। হাত সরে গেল হাতের উপর থেকে পুনরায়। তবে শরীরের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলেও তার ভেতরে, রক্তের গভীরে যে এক তীব্র নড়াচড়া শুরু হয়েছে, টের পাচ্ছিল সুজন।
চরাচর অন্ধকার। বাসের দু’পাশের জানালা দিয়েই কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পাবার কথাও নয়। তবুও মাঝে মধ্যে ঝলসে ওঠা বিদ্যুতের আলোয় সেটা দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছিল সুজন। কিন্তু কোথাও কিছু থাকলে তবে তো। দু’ধারে একেবারেই ধু ধু মাঠ। কিছুক্ষণ দেখার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল সুজন। এখন আর কোথাও অন্য কোনও শব্দ নেই। বৃষ্টি কখনও বাড়ছে, কখনও কমছে। মাঝে মাঝে পেছন থেকে এক একটা হেডলাইটের আলো উজ্জ্বল হতে হতে দপ করে নিভে যাচ্ছে। মানে পিছনে একের পর এক বাস বা গাড়ি এসে জড়ো হচ্ছে।
বসে বসে বোধহয় একটু ঝিমুনি ভাব এসে গিয়েছিল। হঠাৎই তীব্র আলো আর সেইসঙ্গে কানফাটানো আওয়াজে আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যেন ঝলসে গেল। আর সেই সঙ্গেই সুজন টের পেল এবার কেবল হাতের বাঁধন নয়, সে এক শক্ত আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ে গেছে।
আকাশের আলো নিভে গেল। হালকা হতে হতে আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল শব্দ‌ও। সুজনের শরীর থেকে দুই হাতের বাঁধন আস্তে আস্তে আলগা হচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সুজনের মুখ নেমে এল এক ঘন চুলের অরণ্যে। বিধ্বস্ত স্নায়ুতন্ত্রের বাধা টপকে তার দুই হাত জড়িয়ে নিল এক ভীতসন্ত্রস্ত নারীকে।
পরদিন সকালে বাস আবার ছাড়ল। দুই অপরিচিত নর-নারী কেউ জানতে চাইল না কারো পরিচয়। ইচ্ছে করেই, যৌথ সম্মতিতেই তারা ক্ষণকালকে ভাসিয়ে দিল অনন্তকালের ভেলায়।
আরও পড়ুন:

ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-১ : তার সৌন্দর্যের কথা আগেই শুনেছিলাম, এবার তাকে চাক্ষুষ করলাম

ছোটদের যত্নে: বাচ্চা খেতেই চায় না? কী করে খিদে বাড়াবেন? কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩: এক ফ্লপ মাস্টার জেনারেল-র ‘মর্যাদা’ [২২/১২/১৯৫০]

মনের আয়না: ঘুমোতে গেলেই মগজে ভিড় করছে রাজ্যের দুশ্চিন্তা? জন্মাচ্ছে অকারণ ভয়? রইল সমাধান

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-২৫: বনের পথে সূর্য দিলেন বর

— নিয়তি বোধহয় একেই বলে, না?
ভদ্রমহিলাই প্রথম কথা বললেন। ঘাসের উপর পা দুটো একটু বেশি ফাঁক করে এতক্ষণ বসে থাকা শরীরটাকে ছাড়িয়ে নিচ্ছিলেন সুজন। প্রশ্ন শুনে ফের সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “নিয়তি বলছ কেন?”
— তোমাদের সাহিত্যে কি বলে জানি না, আমরা মেয়েরা এরকমই বলি।
সুজন চমকে উঠলেন। কথার বাঁধুনিতে নয়, সম্বোধনে।
— চমকে উঠলে, না? কিন্তু তোমাকে ‘তুমি’ বলার একটা অধিকার আমার আছে। তাই অধিকারটা একবার ফলিয়ে নিচ্ছি।
ক্রমশই এবার কথার ধাঁধায় জড়িয়ে যাচ্ছিলেন সুজন। তাই কথা ঘোরাবার চেষ্টা করলেন।
— আমাদের সেদিনের সেই ইচ্ছে তো আর রইল না।
— কোন ইচ্ছে?
— অজ্ঞাত পরিচয় থাকার ইচ্ছে।
— ও। তো সে আর কি করা যাবে? একজন যদি প্রখ্যাত হয়ে যায়, এমন তো হয়েই যায়।
— বেশ তো। কিন্তু অন্য পক্ষের পরিচয় জানলে তো একটা কাটাকুটি হয়ে যায়।
ভদ্রমহিলা মৃদু হাসলেন,
— কিন্তু সেদিনের সে পরিচয় তো আর নেই। আজ তো তার অন্য পরিচয়। অন্যের পরিচয়ে পরিচিত সে।
— সে তো জীবনের নিয়ম। তবু পরিচয় তো একটা থাকবে।
— আমি কেয়া। বিয়ের আগে ছিলাম চক্রবর্তী, এখন চ্যাটার্জী।
— সুজন চুপ করে গেলেন। আর কি কথাই বা থাকতে পারে? কিন্তু সেদিনের সেই স্বল্পভাষিনী আজ প্রগলভা।
— জানতে চাইলে না, কিসের অধিকারে তোমায় তুমি বললাম?
— জেনে লাভ?
চুপ করে গেলেন এবার কেয়াও। হলে অনুষ্ঠান ভাঙছে। সমাপ্তি সংগীত গাইছে কোনও মেয়ে। “ভারী মিষ্টি গলা তো!” সুজন মন্তব্য করলেন।
— আমার মেয়ে।
কথাটা কানে এল, শব্দটা মস্তিষ্কে পৌঁছোলো না সুজনের। সুরে ভেসে যেতে যেতে সুজন তখন পৌঁছে যাচ্ছিলেন এক বর্ষণমুখর রাতে, আরেক মিষ্টি গলার ভীরু আওয়াজে।

* গল্প (Short Story) – অস্মর্তব্য (asmartabya) : অনিন্দ্য ভুক্ত (Anindya Bhukta) অর্থনীতির অধ্যাপক, নেতাজি মহাবিদ্যালয়

Skip to content