কৃষ্ণজন্মভূমি মন্দিরের প্রবেশ দ্বার।
জন্মাষ্টমীর দু’ মাস আগে মথুরার টিকিট কাটার সময় উদ্দীপনার অন্ত ছিল না! জন্মাষ্টমীর সময় মথুরায় ভিড় হবে জানতাম। তবু এ বছর যাবার সংকল্প অটল ছিল।
১৭ আগস্ট নির্ধারিত দিনে সপরিবারে রওনা হলাম মথুরাভিমুখে। ট্রেনটা ছিল আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট, দুপুর একটা দশে কলকাতা স্টেশন থেকে ছাড়ল। পরদিন সকাল নটায় পৌঁছে গেলাম ব্রজভূমি মথুরা। স্টেশনে পা দিতেই দেখলাম অগণিত তীর্থযাত্রী ও দশনার্থীর ভিড়। স্টেশনের কাছেই আইআরসিটিসি-র হোটেল রাজলক্ষ্মীতে আমাদের দু’ দিনের বুকিং ছিল। তাই অসুবিধা হল না।
১৭ আগস্ট নির্ধারিত দিনে সপরিবারে রওনা হলাম মথুরাভিমুখে। ট্রেনটা ছিল আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট, দুপুর একটা দশে কলকাতা স্টেশন থেকে ছাড়ল। পরদিন সকাল নটায় পৌঁছে গেলাম ব্রজভূমি মথুরা। স্টেশনে পা দিতেই দেখলাম অগণিত তীর্থযাত্রী ও দশনার্থীর ভিড়। স্টেশনের কাছেই আইআরসিটিসি-র হোটেল রাজলক্ষ্মীতে আমাদের দু’ দিনের বুকিং ছিল। তাই অসুবিধা হল না।
কৃষ্ণজন্মভূমি মন্দির।
জন্মাষ্টমীর আগের দিনটিতে মথুরায় উৎসবের সমারোহ চোখে পড়ল। চারিদিকে তীব্ৰ রোদ। সরকারি মিউজিয়াম দেখে লাঞ্চ করে টোটো ধরে কৃষ্ণজন্মভূমি মন্দির পৌঁছনো আমাদের লক্ষ্য ছিল। রাস্তায় স্থানে স্থানে কৃষ্ণলীলার নানান কাহিনি অবলম্বনে সুন্দর সুন্দর মাটির মূর্তির বর্ণময় সাজসজ্জা দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কোথাও বা বাঁশি, ময়ূরের পালক, মাখনের হাঁড়ি, রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো সেলফি পয়েন্ট তৈরি করা হয়েছে। চারিপাশের মানুষজনের মধ্যে আনন্দের মেজাজ। কৃষ্ণজন্মভূমি মন্দিরের এক কিলোমিটার আগে যানবাহন যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়ায় হাঁটতে শুরু করি আমরা। উৎসব উপলক্ষে দোকানগুলোতে জামাকাপড় সাজসজ্জার নানান সামগ্রী শোভা পাচ্ছে। রাস্তার ওপর স্থানে স্থানে মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। একস্থানে জনসমক্ষে উত্তরপ্রদেশের বাউল সম্প্রদায়ের বাজনার সঙ্গে নৃত্য প্রদর্শন ভালো লাগল।
আগ্রা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উত্তরে এবং দিল্লি থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে উত্তরপ্রদেশের মথুরাজেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র মথুরার উল্লেখ বেদে না থাকলেও রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক যুগের প্রসিদ্ধির কথা সর্বজনবিদিত। মউজপুর, মধুপুরি, মধুবন, মধুরা, মদুরা এভাবে যুগে যুগে মথুরার নামের পরিবর্তন হয়েছে। বৌদ্ধদের কাছেও মথুরা ছিল একটি বিশিষ্ট জনপদ। পারস্য মিথরা থেকে মথুরা — এই তত্ত্বও আছে।
মহাভারতে তো বৃন্দাবনের কথা নেই, রাধার কথাও নেই, শুধু মথুরা, গোকুল আর দ্বারকার কথা আছে। বৈষ্ণবতত্ত্বতে রাধার গুরুত্ব আছে।
মহাভারতে তো বৃন্দাবনের কথা নেই, রাধার কথাও নেই, শুধু মথুরা, গোকুল আর দ্বারকার কথা আছে। বৈষ্ণবতত্ত্বতে রাধার গুরুত্ব আছে।
খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে কৃষ্ণজন্মভূমি মন্দিরের স্থানটির গুরুত্ব লক্ষিত হয়। বহুবার আক্রমণকারীদের দ্বারা মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময় এই মন্দিরের স্থানে শাহি ঈদগাহ মসজিদ নির্মিত হয়। এরপর বিংশ শতকে মসজিদের পাশে কিছু ব্যবসায়ীর আর্থিক সহায়তায় কেশবদেবের মন্দির, গর্ভগৃহ ও ভাগবত ভবন সমন্বিত নতুন মন্দির নির্মিত হয়।
শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের লোহার দরজায় ‘শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি’ লেখাটি দূর থেকেও চোখে পড়ে। প্রবেশ দ্বারের ওপরে কুরুক্ষেত্রের রথে কৃষ্ণার্জুনের সুন্দর মূর্তি লক্ষিত হচ্ছে। জন্মাষ্টমীর আগের দিনটিতে বিকেলে লাইনে দাঁড়িয়ে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। পুরুষ মহিলাদের লাইন আলাদা ছিল। মন্দিরের ভেতরে ক্যামেরা, মোবাইল নিয়ে যাওয়া নিষেধ। অগত্যা বাইরে রেখে গেলাম। মন্দিরে ঢুকে দেখি বিশাল প্রাঙ্গনের একদিকে ভাগবত ভবন ও অন্য দিকে উচ্চ সিঁড়ি।
যমুনা বক্ষে মথুরার প্রাচীন ঘাট, বাঙালী ঘাট।
শ্রীকৃষ্ণের জীবন কাহিনি অবলম্বনে নৃত্য গীতের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে অনেক খানি উঠে মন্দিরের বিশাল সুসজ্জিত শ্বেত পাথরের গর্ভগৃহ। চারিপাশে অনেক অলিন্দ ও থাম। বৃহৎ আয়োজন চলছে পুজোর। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অগণিত লোক সমাগম হয়েছে। মন্দিরের অনিন্দ্য সুন্দর রাধা কৃষ্ণের মূর্তি দেখে মন প্রাণ ভরে গেল। বহু দূর দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ভিড় করেছে। জন্মাষ্টমী উপলক্ষে মিষ্টির দোকানে কাজু পেস্তার পেঁড়া ও হরেক রকম মিষ্টির সমাহার পর্যটকদের কাছে লোভনীয়।
মথুরার সব থেকে প্রসিদ্ধ পৌরাণিক বিশ্রাম ঘাট।
পরদিন সকালে যমুনাবক্ষে নৌবিহারে বের হলাম আমরা। মথুরায় প্রায় পঁচিশটা ঘাট যমুনার তীরে লক্ষিত হয়। যমুনার ওপর ব্রিজের তলা দিয়ে যেতে যেতে স্নিগ্ধ সতেজ হাওয়ায় সুন্দর অনুভূতি হচ্ছিল। প্রথমেই চোখে পড়ল প্রাচীন বাঙালী ঘাট। বর্ধমানের রাজা এটি নির্মাণ করেছিলেন বলে জানালেন নৌকা বাহক গোপাল নামক বয়স্ক ব্যক্তি। অনেক পূর্ণার্থী ঘাটে স্নান করছেন। পুজোপাঠও চলছে। যমুনার স্রোত বেশ ভালো, তাই স্নান করতে গিয়ে যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য ঘাটের কাছে চেন দিয়ে বাঁধা সিমেন্টের কিছু ছোট ছোট পিলার লক্ষ্য করলাম। আমাদের নৌকাটি কয়েকটি রঙিন পতাকাযুক্ত, রঙিন কাপড়ের ছাউনি দেওয়া এবং পাটাতনে রঙিন পাতলা কার্পেট কাপড় বিছানো ছিল। তাই ভাদ্র মাসের তীব্ৰ রোদ্দুরে নৌকাবিহার আরামদায়ক হয়েছে।
পৌরাণিক কংস-কেল্লা।
এরপর আমরা অসিকুন্ড ঘাটে অবতরণ করলাম। এই ঘাটে দ্বারকাধীশ মন্দিরটি খুবই প্রসিদ্ধ। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে শেঠ গোকুল দাস এটি নির্মাণ করেন। এখানকার মঙ্গল আরতি উৎসব ও জন্মাষ্টমী পালন অনুষ্ঠান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মন্দিরটি বল্লভাচার্য্যর অনুসারীরা পরিচালনা করেন। স্থাপত্যগত দিক দিয়ে মন্দিরটি বিশেষ আকর্ষণীয়। —চলবে
ছবি: লেখক
ছবি: লেখক