শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ ব্যাধির অন্যতম প্রধান কারণ হল, শৈশবকালীন অ্যাজমা বা হাঁপানি। সাধারণত পাঁচ বছর বয়স থেকেই হাঁপানি দেখা যায়। অবশ্য তার কম বা বেশি বয়সেও হাঁপানি শুরু হতে পারে। এক বছরের কম বয়সী শিশুদের হাঁপানি হলে বেশি সমস্যার সৃষ্টি হয়।
 

হাঁপানি কেন হয়?

হাঁপানি সাধারণত বংশগত রোগ। অবশ্য বংশগত হাঁপানির ইতিহাস না থাকলেও হতে পারে। তাছাড়া অ্যালার্জি বা একজিমার একটা পারিবারিক ইতিহাস থাকতে পারে। আর হাঁপানির প্রত্যেকবার আক্রমণের পিছনে একটা উদ্ভাবক (ট্রিগারিং ফ্যাক্টর) থাকবেই। আবহাওয়া পরিবর্তন জল-বৃষ্টিতে ভেজা, ঠান্ডা লাগা, বিশেষ কিছু খাদ্য গ্রহণ করা যেটাতে শিশুর এলার্জি রয়েছে, এগুলি ট্রিগারিং ফ্যাক্টর। তাছাড়া শিল্প কলকারখানার ধোঁয়া, নির্গত রাসায়নিক, বাতাসের ধুলো ময়লা, ফুলের রেনু, পাখির পালক, গৃহপালিত প্রাণীর লোম, লোমস খেলনা— এসবই শিশুদের হাঁপানির প্রিসিপিটেটিং ফ্যাক্টর। ভালো ভাবে বিশ্লেষণ করলে কোনও না কোনও একটা এলার্জির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যাবেই।
 

হাঁপানি রোগে শিশুদের ফুসফুসে কী পরিবর্তন হয়

এই রোগে অন্য রোগ সংক্রমণ খুব সাধারণ ব্যাপার। এর ফলে শ্বাসনালীর ভিতরের স্তরে প্রদাহ হওয়ায় শ্বাসনালীর ভেতরের মাংসপেশি সংকুচিত হয়। তাছাড়া কিছু উত্তেজক পদার্থের প্রভাবে শ্বাসনালীর গ্রন্থি থেকে প্রচুর মিউকাস জাতীয় আঠালো কফ নিঃসৃত হয়ে শ্বাসনালীতে জমা হয়, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের বাতাস চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। যার ফলে শিশুর শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। নবজাতকের ক্ষেত্রে শ্বাসনালীটি তুলনামূলক বড় বাচ্চাদের তুলনায় সরু। যেখানে ভাইরাস বা ছত্রাক সংক্রমণ হলে শ্লেষ্মা দ্বারা শ্বাসনালী অবরুদ্ধ হয়ে বেশি সমস্যার সৃষ্টি করে।

 

শিশুদের অ্যাজমার লক্ষণ কী কী?

বুকে অস্বস্তি, দমবন্ধ ভাব।
শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট।
বুকের ভিতর সোঁ সোঁ শব্দ।
ঘন ঘন শুষ্ক কাশি।
গলার নিচের অংশ, দুই পাঁজরের মধ্যবর্তী অংশ- শ্বাস নেওয়ার সময় ভিতরে ঢুকে যায়।
শিশু চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে পারে না।
রাতের বেলা বেশি উপসর্গ দেখা যায়।
শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিকের তুলনায় দেড় থেকে দু’ গুণ বেশি হয়।
খেতে কষ্ট হয়।
রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকায় ঠোঁট ও নখ নীল হতে পারে।

 

প্রাথমিক গৃহ চিকিৎসা

সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার শিশুদের অ্যাজমা রোগ অনেক সময়ই ঠান্ডা, সর্দি- কাশি, ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া ইত্যাদি বলে অবজ্ঞা করা হয়, তাতে কিন্তু চিকিৎসা বিভ্রাট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

যে সমস্ত শিশুর হাঁপানি রোগ রয়েছে, তাদের একটু সর্দি কাশি হলেই বাড়াবাড়ি হওয়ার আগেই চিকিৎসা শুরু করতে হবে। কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হলে ব্রঙ্কোডাইলেটর সিরাপ বা ট্যাবলেট (বড় বাচ্চার জন্য) যেমন অ্যাস্থালিন আট ঘণ্টা অন্তর কোনও ডাক্তার দেখানোর আগেই বাড়িতে শুরু করা যায়। সর্দিতে নাক বন্ধ হলে অক্সিমেটাজলিন নাকের ড্রপ বা মোমেটাজোন নাকের স্প্রে ব্যবহার করা যায়।

এই সব ওষুধের ডোজ সাধারণত মা-বাবা তাঁদের পারিবারিক বা নিয়মিত চিকিৎসকের কাছ থেকে আগেই জেনে যায়। কোনও শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করতে নেই। নাকের ড্রপ প্রত্যেক নাকে দু’ ফোঁটা করে রোজ চারবার এবং নাকের স্প্রে প্রত্যেক নাকে একবার করে রোজ তিনবার লাগালে আস্তে আস্তে শ্বাসকষ্ট কমে। এটা করে উল্লেখযোগ্য ভাবে শ্বাসকষ্ট না কমলে শিশুকে লিভোসালবিউটামল ও বুডেসোনাইট ইনহেলার দিতে হবে। ইনহেলারের ব্যবহার মা-বাবাকে যেমন শিখতে হবে, তেমনি বড় শিশুরা যাতে নিজে নিতে পারে — সেটা তাদের শেখাতে হবে। লিভোসালবিউটামল ইনহেলার প্রথম দিকে দিনে চারবার এবং বুডেসোনাইট ইনহেলার দিনে দু’ বার নিতে হয়। শিশুর শ্বাসকষ্ট কমার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো দেওয়ার ফ্রিকোয়েন্সি কমাতে হয়।

 

ডিভাইস ব্যবহারের নিয়ম

শ্বাসকষ্ট কমানোর জন্য কোন বয়সে কী ডিভাইস ব্যবহার করা উচিত তার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে।
• চার বছর বয়স পর্যন্ত: মাস্কের সাহায্যে নেবুলাইজার অথবা মাস্ক ও স্পেসার-এর মাধ্যমে মিটার ডোজ ইনহেলার।
• পাঁচ থেকে আট বছর পর্যন্ত: রোটা হেলার অথবা মাস্কের মাধ্যমে মিটার ডোজ ইনহেলার।
• আট বছরের বেশি বয়সীদের জন্য: মিটার ডোজ ইনহেলার এবং রোটা হেলার।

এছাড়া একটা অ্যালার্জির ওষুধ যেমন মন্টেলুকাস্ট অথবা মন্টেলুকাস্ট ও লিভোসেট্রিজিন কম্বিনেশন- দু থেকে তিন সপ্তাহ বা আরও বেশি দিন খাওয়ানো নিয়ম। তবে এসবের ডোজ কোনও শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো নির্ধারণ করা উচিত। অন্তত দুজন সাহায্যকারী ছাড়া শিশুদের নেবুলাইজার দেওয়া যায় না। মা শিশুকে ঠিকভাবে ধরে রাখলে অন্য আর একজন ফেস মাস্ক শিশুর নাকে মুখে ঠিকভাবে ধরতে পারে। বাড়িতে কোনও শিশুর অ্যাজমা রোগ থাকলে এ সমস্ত ডিভাইজ গুলোর যোগান বাড়িতেই রাখতে হবে।
 

কখন চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে নিয়ে যাবেন?

নেবুলাইজার ব্যবহার করার পরেও শ্বাসকষ্ট না কমলে।
শ্বাসকষ্টের কারণে খেতে না পারলে বা বমি হলে।
শ্বাসকষ্টের সময় কথা বলতে না পারলে বা একটা বাক্য শেষ করতে না পারলে।

 

প্রতিরোধ

শিশু তুলোর বালিশে ঘুমালে বালিশে প্রথমে একটা প্লাস্টিকের খোল পড়িয়ে তার ওপর আবার সুতির একটা কভার লাগাতে হবে।
সপ্তাহে অন্তত একবার বিছানা ও শিশুর ব্যবহারের অন্যান্য কাপড় চোপড় ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে।
শিশুকে পশমী জাতীয় খেলনা দেওয়া যাবে না।
বাড়িঘর সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে।
বাইরে বেরোলে ধুলোবালি থেকে রেহাই পেতে শিশুদের মাস্ক পরাবেন। তবে ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জাপানীদের এটা দৈনন্দিনের নিয়মিত অভ্যাস।

শিশুর কোল্ড অ্যালার্জি থাকলে এয়ারকন্ডিশনে রাখা যাবে না।
শিশুকে সিগারেটের ধোঁয়া থেকে দূরে রাখতে হবে।
শীতকাল শিশুর জন্য কম্বল ব্যবহার না করে কভার দেওয়া লেপ ব্যবহার করবেন।
ঘর পরিষ্কার করার সময় বাচ্চাকে সরিয়ে রাখুন।
আঁশযুক্ত খেলনা, কার্পেট, কুশন থেকে শিশুকে দূরে রাখুন।
ঘরে মশার কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার করবেন না।
অ্যালার্জি টেস্ট না করলেও শিশুকে চিংড়ি মাছ, বেগুন, ডিমের সাদা অংশ খাওয়াবেন না।

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

যোগাযোগ: ৯৮৩০২৯৪৯৩২

Skip to content