ছবি প্রতীকী
আজ আমরা জানব কীভাবে অ্যান্টিবায়োটিক বিজ্ঞানসম্মত ভাবে আমরা ব্যবহার করতে পারি। প্রথমত জ্বর হলে আমরা কয়েকদিন বাদেই পরীক্ষা করে জ্বরের আসল কারণ জানার চেষ্টা করি। এখন আর জ্বর হলেই অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় না। প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে, এটা ভাইরাস ঘটিত জ্বর কিনা। অর্থাৎ করোনা, ডেঙ্গু, ইনফ্লুয়েঞ্জা এই ধরনের জ্বর কিনা। তাছাড়া ম্যালেরিয়ার কারণেও জ্বর হতে পারে। এক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে কোনও লাভ নেই। সেক্ষেত্রে অ্যান্টি-ম্যালেরিয়াল ড্রাগ অর্থাৎ ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ যেমন ক্লোরোকুইন দিতে হবে। একই ভাবে টাইফয়েড হলে টাইফয়েডের ওষুধ দিতে হবে।
জ্বর হলে প্রথমেই রোগীকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আশেপাশে বা সহকর্মীদের কারও জ্বর হয়েছে কিনা? কারণ, যখন একসঙ্গে অনেকেরই জ্বর হয় তখন ধরেই নিতে হবে এটা সাধারণত ভাইরাল ফিভার। কিন্তু যদি একসঙ্গে অনেকের জ্বর না হয়, তখন আমরা রোগীর উপসর্গ দেখি। যেমন কোনও রোগী হয়তো বলছেন, তাঁর জ্বরের সঙ্গে কাশি হচ্ছে। কাশি কিন্তু ভাইরাল জ্বর হলেও হয়। তখন রোগীকে জিজ্ঞাসা করা হয় কফের রং কী রকম? রং যদি হলুদ, সবুজ, কালো হয়, তাহলে বুঝতে হবে ভাইরাস ছাড়াও অন্যান্য জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমাদের দুটি কাজ করতে হবে।
প্রথমত, রোগীর রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। সেই পরীক্ষায় আমরা মোট ‘ডব্লুবিসি কাউন্ট দেখি’ এবং ‘সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন’ বলে এক ধরনের পরীক্ষা হয় তা করে দেখি। আসলে এই পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে প্রোটিনের উপস্থিতির খুঁটিনাটি দেখা হয়। সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিনের স্বাভাবিক মাত্রা হল ৬- এর নীচে। কারও ভাইরাল ফিভার হলে এই মাত্রা ১৫ থেকে ২০ পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু কারও যদি ৩০ থেকে ৩৫ বা তার উপরেও ‘সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন’ থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে এক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণ হচ্ছে। ফলে তাঁর অ্যান্টিবায়োটিক লাগতে পারে। এক্ষেত্রে ডব্লুবিসি কাউন্ট বা রক্তের শ্বেত কণিকার মাত্রা বেড়ে যাবে। ডব্লুবিসি কাউন্ট-এর স্বাভাবিক মাত্রা হল ৪ হাজার থেকে ১১ হাজার পর্যন্ত। তবে কারও কারও কখনও কখনও ১১ হাজারের থেকে অনেক বেশি ১৪-১৫ হাজার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে একটা জিনিস আমাদের দেখতে হবে, শ্বেত কণিকার মধ্যে নিউট্রোফিল বেড়ছে কি না। নিউট্রোফিল যদি শতকরা ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই অ্যান্টিবডি লাগবে। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে টাইফয়েড। টাইফয়েডে শ্বেতকণিকা খুব একটা বাড়ে না। কিন্তু ‘সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন’ বাড়ে। তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম, এই রোগীর শ্বেতকণিকা ১১ হাজারের বেশি হয়ে গিয়েছে, সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিনও বেশি। ফলে তাঁর অ্যান্টিবডি লাগবে।
অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার আগে কী করণীয়?
অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার আগে দেখতে হবে জ্বরের কারণ কী? কফ থাকলে কালচার করতে পাঠাতে হবে। কালচার করলে জীবাণু বাড়ছে কিনা তা দেখা যাবে। আবার কারও ধরুন ইউরিন অর্থাৎ প্রস্রাব করতে গেলে জ্বালা, ব্যথা করছে তাহলে বুঝতে হবে মুত্রনালীতে সংক্রমণ হচ্ছে অর্থাৎ কিডনি এবং তার নিচে যে মূত্রনালী সেখান থেকে সংক্রমণ হয়ে প্রস্রাব করতে গেলে জ্বালা বা ব্যথা হচ্ছে, জ্বর আসছে। সেক্ষেত্রে আমাদের ইউরিন কালচার করতে দিতে হবে। যদি এইসব কোনও উপসর্গই না থাকে, যেমন ধরুন টাইফয়েডের ক্ষেত্রে এই দুটো উপসর্গই থাকে না, অথচ উত্তরোত্তর জ্বর বাড়ছে, কোষ্ঠকাঠিন্য হচ্ছে বা অনেক সময় ডায়রিয়া হচ্ছে সেক্ষেত্রে আমাদের ‘ব্লাড কালচার’ করতে হবে।
অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করার আগে আমরা কী দেখি?
দেখি যদি কফের থেকে সংক্রমণ হচ্ছে কিনা। তাই কফ কালচার করতে পাঠানো হয়। ইউরিনে সমস্যা থাকলে ইউরিন কালচার করতে হয়। পাশাপাশি রক্তও কালচার করা হয় গুরুত্ব বুঝে। কালচারের রিপোর্ট আসতে ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে। তাহলে ৭২ ঘণ্টা কি আমরা অপেক্ষা করব? না ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষা করা হয় না। আমরা রোগীকে পরীক্ষা করে বুঝতে পারি, কোন ধরনের জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, ইউরিনের সংক্রমণ থেকে শরীর খারাপ হলে আমরা অভিজ্ঞতা অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক নির্বাচন করে রোগীকে দিই। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক’ বলা হয়। তবে ৭২ ঘণ্টার পর কালচার রিপোর্টে যদি দেখা যায় কোন হালকা অ্যান্টিবায়োটিকে ওই রোগকে রুখে দেওয়া যাবে, তাহলে ‘ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক’ পরিবর্তন করতে হবে।
কালচারের রিপোর্টে কী দেখে বুঝবো কোন ধরনে অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে?
ইউরিন, কফ বা ব্লাড কালচার রিপোর্টে দেখবেন ‘এস’-‘আই’-আর লেখা থাকে। এস মানে ‘সেনসেটিভ’। ধরুন অ্যান্টিবায়োটিক ‘অ্যাম্পিসিলিন’-এর পাশে লেখা আছে সেনসেটিভ, তার মানে ‘অ্যাম্পিসিলিন’ কাজ করবে। আর একটা অ্যান্টিবায়োটিক ‘জেন্টামাইসিন’-এর পাশে লেখা আছে ‘ইন্টারমিডিয়েট’ মানে ‘আই’ অর্থাৎ কাজ করতেও পারে আবার নাও করতে পারে। এই ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া একদমই উচিত নয়। আর একটা অ্যান্টিবায়োটিক যেমন ‘ডক্সিসাইক্লিন’ পাশে লেখা আছে ‘আর’, আর মানে ‘রেজিস্টান্ট’। অর্থাৎ এই অ্যান্টিবায়োটিকে জীবাণুকে প্রতিরোধ করা যাবে না।
অবশ্যই মেনে চলা উচিত
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সাধারণত সাত থেকে আট দিনের বেশি আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দিই না। কিন্তু আমরা যেটা ভুল করি, তা হল অ্যান্টিবায়োটিক মাঝপথে বন্ধ করে দিই। সাত দিনের জায়গায় চার দিন খেয়েই অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দিই। এটা মারাত্মক ভুল। এতে কী অসুবিধা হতে পারে? এক্ষেত্রে রোগীর পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক মানুষদেরও সমস্যা বাড়তে পারে। কেমন করে? ধরুন কারও শরীরের রক্তে এক লক্ষ টাইফয়েডের জীবাণু আছে। তিনি পাঁচ দিন অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে বন্ধ করে দিলেন। তাহলে কী হল? এতে হয়তো ৯৯ হাজার ৯০০ জীবাণু পাঁচ দিনে ধ্বংস হয়ে গেল। কিন্তু ১০০ জীবাণু থেকে গেল। তারা কিন্তু ওই অ্যান্টিবায়োটিকের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য নিজেকে পাল্টে নেবে। তারপর আবার বংশবিস্তার করতে শুরু করবে। আবার টাইফয়েড বা অন্য যে ইনফেকশন হয়েছিল তা কিন্তু আবার ফিরে আসতে পারে। এবার ওই জীবাণুগুলি ওই রোগীর থেকে নিশ্বাসের মাধ্যমে, কফ, মল বা ইউরিনের মাধ্যমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এই ‘রেজিস্টান্ট’ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার ফলে পারিপার্শ্বিক লোকদেরই ওই ‘রেজিস্টান্ট’ জীবাণু থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। সেই জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের পুরো কোর্স করতেই হবে।
আশাকরি, আমরা কীভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করি তার একটা ধারণা দিতে পারলাম।
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
যোগাযোগ: ৯৮৩১৬৭১৫২৫