শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


পহেলগাঁওয়ের পার্ক।

সে এক স্বপ্নের দেশ যেন! চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। ড্রাইভার ভাই জানাল যে আমরা কাশ্মীরে এসে পড়েছি। অদূরে পাহাড় দেখা গেলেও সেই চড়াই উতরাই পথ আর নেই। গাড়ি চলেছে তীব্র গতিতে। সামনে দীর্ঘপথ দেখা যাচ্ছে। দু’ পাশে সবুজে সবুজ। গাছপালাগুলোর প্রকৃতিও বদলে গিয়েছে। দেখে সাধ মেটে না, ক্লান্তিও আসে না এ পথে। এ ভাবে দীর্ঘপথ চলার পর দেখা মিলল সেই সুন্দরী লিডারনদীর। ঠিক যেন পটে আঁকা ছবি। বার্চ উইলো পাইন গাছের মধ্যে দিয়ে দুধসাদা জলের চঞ্চলা সুন্দরী লিডার উদ্দাম গতিতে আপনখেয়ালে বয়ে চলেছে। অনন্তনাগ জেলার মধ্যে দিয়ে চলেছি। সেদিন এখানে বন্‌ধ। শুনশান চারপাশ। থেকে থেকেই চোখে পড়ছে মিলিটারী প্রহরা।

ড্রাইভার জানাল, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাব পহেলগাঁও। রাতটুকু পহেলগামেই কাটাব। পহেলগাঁও অপূর্ব সুন্দর, শান্ত ছোট গ্রাম। লিডারনদীর ধারে যাত্রীসাধারণের রাত কাটাবার জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা হয়েছে। ছোট বড় অজস্র তাঁবুর মেলা। সব মিলিয়ে চারিদিকে যেন উত্সবের পরিবেশ। পহেলগাঁওয়ে তাহেরভাই একটা খুব সুন্দর হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছেন। সেই হোটেলে জিনিসপত্র রেখে আশপাশ ঘুরে দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। ভোরে রওনা দেব অমরনাথের পথে। আর হয়তো এ পথে ফেরাই হবে না। যতটুকু দেখে নেওয়া যায় দু’চোখ মেলে। একদিকে বয়ে চলেছে লিডারনদী তার স্বভাবসিদ্ধ দ্রুত গতিতে। চারিদিকে সবুজ, সবুজ আর সবুজ। পার্কের গোলাপগাছগুলোতে অজস্র ফুল ফুটে রয়েছে। এমন নয়নাভিরাম রূপ দেখে দেখে যেন আর আশ মেটে না। এ সময় কাশ্মীরে সাধারণ যাত্রী নেই বললেই চলে। সকলেই প্রায় রওনা দেবে অমরনাথের পথে। জুন মাস। যাত্রীদের আসার ঋতু নয় এটা। যদিও কাশ্মীর সব ঋতুতেই সুন্দর। বর্ষায় সে মোহময়ী। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। হোটেলে ফিরে চললাম। সন্ধ্যায় হোটেলের অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ হল। আমরাই তাদের মধ্যে প্রথমবার চলেছি এ পথে। অন্যরা দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার চলেছে। কেউ বা তারও বেশিবার এসেছে এ পথে।

সকলেই আমাদের দেখে একবাক্যে বলল, ‘আপনারা এপথে হেঁটে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করবেন না। পারবেন না। ঘোড়ায় চড়ে যাওয়াই ভালো।’ ওদের তুলনায় কিঞ্চিৎ স্থূল হওয়ায় বোধহয় এই আশঙ্কা। ওদের নঞর্থক চিন্তা আমাদের মনকেও ঘিরে ধরল। এত দুর্গম পথ। যদি না পারি! মনে মনে এক প্রকার ঠিকই করে ফেললাম, ঘোড়ায় চড়েই যাব অমরনাথের পথে।
প্রসঙ্গত বলি, অমরনাথের উদ্দেশ্যে দুটি পথে যাত্রা করা যায়। একটি হল, পহেলগাঁও-চন্দনবাড়ি-শেষনাগ হয়ে তিনদিনের পথ। আর দ্বিতীয়টি শ্রীনগর-বালতাল হয়ে। আমরা প্রথম পথে তিনদিন ধরে যাব আর দ্বিতীয়পথে অর্থাৎ বালতাল হয়ে ফিরে আসব।

ভোরে রওনা দেব। তাই খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, কতশত তীর্থের দেশ আমাদের এই ভারতবর্ষ। প্রতিটি তীর্থে গেলেই শোনা যায় তাকে কেন্দ্র করে নানান গল্প। অমরনাথকে কেন্দ্র করেও রয়েছে এমনি গল্পকথা। তুষার লিঙ্গ অমরনাথের কাহিনী জানতে হলে আমাদের যেতে হবে সেই প্রাচীনকালে।

প্রাচীনকালে কোনও এক সময় পার্বতী মহেশ্বরের কাছে অমরকথা জানতে উৎসুক হন। কি সেই আখ্যান যা শুনলে আর জন্মগ্রহণ করতে হয় না! মহাদেব অনিচ্ছাসত্ত্বেও পার্বতীর অতি পীড়াপীড়িতে সেই কাহিনী শোনাতে রাজি হন। তবে একটা শর্তের বিনিময়ে। যে স্থানে তিনি এই কাহিনী শোনাবেন, সেখানে পার্বতী ছাড়া আর কারও থাকা চলবে না। কারণ, যে এই কাহিনী শুনবে সে অমর হবে।

বেতাব ভ্যালি।

এভাবে তিনি ও পার্বতী উপযুক্তস্থানের সন্ধান করতে করতে কৈলাসপর্বত থেকে এসে উপস্থিত হন আজকের এই অমরনাথগুহায়। পথে একজায়গায় প্রিয় পুত্র গণেশকে রেখে এগিয়ে যান। ওই জায়গা আজও ‘গণেশ পৈ’ বা ‘মহাগুণাস পৈ’ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। মহাদেব তাঁর গলার সর্পরাজকে যেখানে ত্যাগ করেন, সেই জায়গা আজও শেষনাগ নামে পরিচিত হয়ে আছে। পহেলগাম বা পহেলগাঁও হল সেই জায়গা যেখানে তিনি তাঁর বৃষ নন্দীকে পরিত্যাগ করেছিলেন (বৈল থেকে পহেল-এই হল অপভ্রংশ)। পঞ্চতরণী নামক স্থানে বিসর্জন দিয়েছিলেন পঞ্চভূত (ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ব্যোম)। এরপর গুহায় পৌঁছে একাদশ রুদ্রকে আদেশ করেন, অগ্নি প্রকট করতে যাতে সমস্ত জীবের বিনাশ হয়। মহাদেবের আদেশ পালনের পর কালাগ্নি অন্তর্হিত হলে তার দৃষ্টি এড়িয়ে কীভাবে যেন একটি শুকপাখির ডিম রয়ে যায় সেই গুহায়। তা থেকে এক পায়রার জন্ম হয়।

এদিকে মহাদেব গল্প শুরু করার আগে পার্বতীকে বলেছিলেন, পার্বতী, যখন আমি গল্প বলব, তুমি মাঝেমাঝে হুঁ হুঁ বলবে। পার্বতীও তাই করছিলেন। শুনতে শুনতে পার্বতী ঘুমিয়ে পড়লে তাঁর পরিবর্তে হুঙ্কার করে সেই পাখি। এ ভাবে সেই পাখি শুনে ফেলে মহাদেবের বলা অমরকথা। সে অমরত্ব লাভ করে। সব জানতে পেরে ক্রুদ্ধ মহাদেব সেই পাখির পিছু পিছু এসে উপস্থিত হন ব্যাসদেবের বাড়ি। ব্যাসদেবের পত্নীর গর্ভে প্রবেশ করে সেই পাখি আর পরবর্তীতে মহাজ্ঞানী শুকদেবরূপে জন্মগ্রহণ করে। তারপর কোনও এক সময় নৈমিষারণ্যে ঋষিদের সমাগম হলে শুকদেব সকলকে সেই অমরকথা বলতে প্রবৃত্ত হন। মহাদেব তখন প্রমাদ গোনেন। যদি সকলে এই কাহিনী শোনে তবে তো বিপদ! তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন, এই অমরকথা যে শুনবে, সে আর অমরত্ব লাভ করবে না। তবে তার শিবলোকপ্রাপ্তি হবে।
ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙলো অ্যালার্মের শব্দে। ঘড়িতে তখন ভোর চারটে বাজে। —চলবে
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

ছবি: লেখক


Skip to content