ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ভক্তদের সঙ্গে ১৮৮৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর রবিবার স্টার থিয়েটারে এসেছেন নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্রের স্বল্পায়তন দু’ অঙ্কের পৌরাণিক নাটক ‘প্রহ্লাদ চরিত্রে’র অভিনয় দেখতে। এটাই তাঁর দ্বিতীয়বার পেশাদার রঙ্গমঞ্চে আগমন। এ দিন রাতে ছিল ‘প্রহ্লাদ চরিত্র’ এবং রসরাজ অমৃতলাল বসুর প্রহসন ‘বিবাহ বিভ্রাট’-এর যুগ্ম অভিনয় রজনী। সেই রাতে ঠাকুরের সঙ্গে থিয়েটার দেখতে যেসব ভক্তরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মাস্টারমশাই শ্রী মহেন্দ্র গুপ্ত, বাবুরাম ঘোষ, তরুণ ভক্ত নারায়ণ। এছাড়া কালিপ্রসাদ চন্দ্র যিনি পরবর্তীকালে হয়েছেন স্বামী অভেদানন্দ এবং গৃহী ভক্ত দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার।
গিরিশচন্দ্রের প্রহ্লাদ চরিত্র নাটকটি প্রথম অভিনীত হয়েছিল শনিবার ২২ নভেম্বর স্টার থিয়েটারে। এই পৌরাণিক নাটকের উদ্বোধন রজনীতে অমৃতলাল মিত্র অভিনয় করেছিলেন হিরণ্যকশিপুর ভূমিকাতে। আর নটী বিনোদিনী অভিনয় করেছিলেন প্রহ্লাদের ভূমিকাতে। প্রহ্লাদ চরিত্র মাত্র দুই অঙ্কের ক্ষুদ্রতম পৌরাণিক নাটক। এর দৃশ্য সংখ্যা প্রথম অঙ্কে রয়েছে সপ্তম গর্ভাঙ্ক, দ্বিতীয় অঙ্কে রয়েছে সপ্তম গর্ভাঙ্ক। মূলত দুটি সংস্কৃত পুরাণ থেকে এই নাটকের কাহিনী চয়ন করেছিলেন গিরিশচন্দ্র। ব্যাসদেব রচিত দ্বাদশ স্কন্ধে রচিত সংস্কৃত পুরান ভাগবতের থেকেই তিনি কাহিনী আহরণ করেছিলেন। এই পর্যায়ের প্রথম থেকে দশম অধ্যায় পর্যন্ত দশটি অধ্যায় জুড়ে ভক্ত প্রহ্লাদের কাহিনী বিবৃত রয়েছে। দ্বিতীয় গ্রন্থটি সংস্কৃত পুরাণ গ্রন্থ বিষ্ণুপুরাণ। গিরিশচন্দ্র আলোচ্য নাটকের কাহিনী পরিকল্পনায় পুরাণ দুটির প্রভাব অপরিসীম। বেঙ্গল থিয়েটারে একসময় নাট্যকার রাজকৃষ্ণ রায়ের লেখা পৌরণিক নাটক ‘প্রহ্লাদ চরিত্র’ খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই ব্যাপারটি অনুধাবন করে বেঙ্গল থিয়েটারের প্রহ্লাদচরিত্র উদ্বোধনের ছয় সপ্তাহ পরে স্টার থিয়েটারে গিরিশচন্দ্র তাঁর প্রহ্লাদচরিত্র উদ্বোধন করলেন। এর থেকে বুঝতে পারা যায় যে, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র তাঁর নাটকে কিছু কিছু পরিবর্তন করেছেন। প্রহ্লাদ চরিত্র নাটকের আয়তন যেমন স্বল্প, গানের সংখ্যাও তেমনি কম। সেগুলির সুরকার ও সংগীত শিক্ষক ছিলেন সঙ্গীতাচার্য বেণীমাধব অধিকারী। গানগুলি হল— দিয়ে করতালি এস হরি বলি, আমার বংশী বদন শ্যাম, শ্যামসুন্দর নাচে বনমালা দোলে, আয় আয় আয় গুটিগুটি চলি, হৃদয়ে বহে প্রেমের তুফান, দৈত্য দম্ভ ভঙ্গ নরসিংহ ভীম রঙ্গ।
গিরিশচন্দ্রের প্রহ্লাদ চরিত্র নাটকটি প্রথম অভিনীত হয়েছিল শনিবার ২২ নভেম্বর স্টার থিয়েটারে। এই পৌরাণিক নাটকের উদ্বোধন রজনীতে অমৃতলাল মিত্র অভিনয় করেছিলেন হিরণ্যকশিপুর ভূমিকাতে। আর নটী বিনোদিনী অভিনয় করেছিলেন প্রহ্লাদের ভূমিকাতে। প্রহ্লাদ চরিত্র মাত্র দুই অঙ্কের ক্ষুদ্রতম পৌরাণিক নাটক। এর দৃশ্য সংখ্যা প্রথম অঙ্কে রয়েছে সপ্তম গর্ভাঙ্ক, দ্বিতীয় অঙ্কে রয়েছে সপ্তম গর্ভাঙ্ক। মূলত দুটি সংস্কৃত পুরাণ থেকে এই নাটকের কাহিনী চয়ন করেছিলেন গিরিশচন্দ্র। ব্যাসদেব রচিত দ্বাদশ স্কন্ধে রচিত সংস্কৃত পুরান ভাগবতের থেকেই তিনি কাহিনী আহরণ করেছিলেন। এই পর্যায়ের প্রথম থেকে দশম অধ্যায় পর্যন্ত দশটি অধ্যায় জুড়ে ভক্ত প্রহ্লাদের কাহিনী বিবৃত রয়েছে। দ্বিতীয় গ্রন্থটি সংস্কৃত পুরাণ গ্রন্থ বিষ্ণুপুরাণ। গিরিশচন্দ্র আলোচ্য নাটকের কাহিনী পরিকল্পনায় পুরাণ দুটির প্রভাব অপরিসীম। বেঙ্গল থিয়েটারে একসময় নাট্যকার রাজকৃষ্ণ রায়ের লেখা পৌরণিক নাটক ‘প্রহ্লাদ চরিত্র’ খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই ব্যাপারটি অনুধাবন করে বেঙ্গল থিয়েটারের প্রহ্লাদচরিত্র উদ্বোধনের ছয় সপ্তাহ পরে স্টার থিয়েটারে গিরিশচন্দ্র তাঁর প্রহ্লাদচরিত্র উদ্বোধন করলেন। এর থেকে বুঝতে পারা যায় যে, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র তাঁর নাটকে কিছু কিছু পরিবর্তন করেছেন। প্রহ্লাদ চরিত্র নাটকের আয়তন যেমন স্বল্প, গানের সংখ্যাও তেমনি কম। সেগুলির সুরকার ও সংগীত শিক্ষক ছিলেন সঙ্গীতাচার্য বেণীমাধব অধিকারী। গানগুলি হল— দিয়ে করতালি এস হরি বলি, আমার বংশী বদন শ্যাম, শ্যামসুন্দর নাচে বনমালা দোলে, আয় আয় আয় গুটিগুটি চলি, হৃদয়ে বহে প্রেমের তুফান, দৈত্য দম্ভ ভঙ্গ নরসিংহ ভীম রঙ্গ।
নাট্যকার রাজকৃষ্ণ রায় ও নটী বিনোদিনী
ঠাকুরের এই নাটক দর্শনের ব্যাপারে গিরিশচন্দ্র সুন্দর করে লিখেছেন— ‘আমি থিয়েটারের সাজ ঘরে বসিয়া আছি এমন সময় শ্রদ্ধাস্পদ ভক্ত প্রবর শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার মহাশয় ব্যস্ত হইয়া আসিয়া আমায় বলিলেন, পরমহংসদেব আসিয়াছেন।’ আমি বলিলাম— ‘ভালো বক্সে লইয়া গিয়া বসান।’ দেবেন্দ্রবাবু বলিলেন— ‘আপনি অভ্যর্থনা করিয়া লইয়া আসিবেন না?’ আমি বিরক্ত হইয়া বলিলাম— ‘আমি না গেলে তিনি আর গাড়ি থেকে নামতে পারবেন না?’ কিন্তু গেলাম। আমি পৌঁছিয়াছি, এমন সময় তিনি গাড়ি হইতে নামিতেছেন। তাঁহার মুখপদ্ম দেখিয়া আমার পাষাণহৃদয়ও গলিল। আপনাকে ধিক্কার দিলাম। সে ধিক্কার এখনও আমার মনে জাগিতেছে। ভাবিলাম এই প্রশান্ত ব্যক্তিকে আমি অভ্যর্থনা করিতে চাহি নাই? উপরে লইয়া যাইলাম। তথায় শ্রীচরণ স্পর্শ করিয়া প্রণাম করিলাম। কেন যে করিলাম, তাহা আমি আজও বুঝিতে পারি না।’ ‘প্রহ্লাদ চরিত্র’ নাটকের তখনও অভিনয় শুরু হয়নি। এই নাটকে গিরিশচন্দ্রের কোনও ভূমিকা নেই। গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথাবার্তার কিছু প্রসঙ্গ আমরা শ্রীম-এর লেখা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের মধ্যে পাচ্ছি। শ্রীরামকৃষ্ণ একটি বক্সে উত্তরাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। রঙ্গালয় আলোকাকীর্ণ। কাছে মাস্টার, বাবুরাম ও নারায়ণ বসিয়াছেন। গিরিশ আসিয়াছেন। অভিনয় এখনও আরম্ভ হয় নাই। ঠাকুরের সঙ্গে গিরিশ কথা কহিতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)— ‘তুমি বেশ লিখেছো’। গিরিশ— ‘মহাশয় শুধু লিখে গিয়েছি। শ্রীরামকৃষ্ণ— ‘না তোমার ধারণা আছে। সেই দিন তোমায় বললাম ভিতরে ভক্তি না থাকলে চালচিত্র আঁকা যায় না।’ অভিনয় যে শিক্ষার বাহন একথা শ্রীরামকৃষ্ণদেব মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। অভিনয়ের সাহায্যে একসঙ্গে অনেক মানুষকে উদ্দীপিত করা যায়। গিরিশচন্দ্র রঙ্গালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে আজীবন সাধারণ মানুষের মধ্যে লোকশিক্ষা বিতরণ করুক, শ্রীরামকৃষ্ণ বারবার সেই উৎসাহ দিয়েছেন। এখানে তার পরিচয় পাওয়া যায়। কথামৃতে দেখতে পাই গিরিশ যখন বলছেন— ‘মনে হয় থিয়েটারগুলো আর করা কেন?’ শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন— ‘না না, ওতে লোকশিক্ষা হবে।’ ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ অভিনয় দেখার পরে শ্রীরামকৃষ্ণকে ম্যানেজারের ঘরে নিয়ে এসে বসানো হয়। সেখানে গিরিশচন্দ্র তাঁকে অভিনয় কেমন দেখলেন জিজ্ঞাসা করায়, তিনি বললেন— ‘দেখলাম সাক্ষাৎ তিনি সব হয়েছেন। যারা সেজেছে তাদের দেখলাম সাক্ষাৎ আনন্দময়ী মা। যারা গোলকের রাখাল সেজেছে তাদের দেখলাম সাক্ষাৎ নারায়ণ। তিনি সব হয়েছেন।’ জনৈক ব্যক্তি ঠাকুরকে ‘বিবাহ বিভ্রাট’ দেখবেন কি না জানতে চাইলে তিনি সরাসরি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলছেন গিরিশ ঘোষকে— ‘এ কি করলে? ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ এরপর ‘বিবাহ বিভ্রাট’? আগে পায়েস মুন্ডি, তারপর শুক্তুনি।’ শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে কথোপকথনে গিরিশচন্দ্র খুব উৎফুল্ল ও অভিভূত। তাঁর নির্দেশে অভিনয় শেষে অভিনেত্রীরা ঠাকুরকে প্রণাম করছেন। ঠাকুর বলেছেন— ‘মা থাক থাক।’ কথাগুলো করুণা মাখা। তারা নমস্কার করে চলে গেলে ঠাকুর ভক্তদের বলেছেন— ‘সবই তিনি, এক এক রূপে।’