সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

পাণ্ডবদের প্রতি আবাল্য ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন দুর্যোধন৷ সেই অযথা হিংসের জেরেই গোপনে পাণ্ডবদের ক্ষতি করবার চেষ্টা করেছেন বারংবার৷ কিন্তু সফল হননি৷ জতুগৃহে আগুন লাগানোর পর তো নিশ্চিতই ছিলেন এই ভেবে যে, পথের কাঁটা দূর হল৷ আর পাণ্ডবদের সমৃদ্ধির কথা সকলের মুখে শুনতে হবে না৷ অর্জুন ভীম সকলের সুনাম শুনতে শুনতে তিনি ক্লান্ত৷ গোপনে এবার যে কাজ সেরে ফেলেছেন, ব্যস! সব জ্বালা থেকে মুক্তি৷ কিন্তু তিনি যে কতটা ভুল, তা পাণ্ডবেরা যেন প্রমাণ করে দিলেন পুড়ে যাওয়া জতুগৃহ থেকে নতুন জন্ম লাভ করে ফিরে এসে৷ সেই পাণ্ডবদের আগের চাইতেও বহুগুণ বেশি শ্রীবৃদ্ধির কথা শুনে তীব্র জ্বালা ধরল মনে৷ তা বলে নিজের কৌতূহল দমন করতে পারলেন না মোটেই৷ যুধিষ্ঠিরের সাদর আমন্ত্রণে অন্যান্যদের সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থের সে আশ্চর্য সভায় উপস্থিত হলেন তিনিও৷ রাজসূয়যজ্ঞেও শামিল হলেন৷ অপদস্থও হলেন৷ হয়তো এমনটাই ছিল নিয়তি৷ হস্তিনাপুরে ফিরে আসা ইস্তক তাঁর ঘুম নেই চোখে৷ একটাই চিন্তা, কীভাবে পাণ্ডবদের ছাপিয়ে যাওয়া, কীভাবে তাদের পরাস্ত করা যায়, কীভাবে সুখসমৃদ্ধি সব চুরি করে নেওয়া যায়, কীভাবে তাদের আবার পথে বসানো যায়! চাইলে কী না হয়! আর সেই চাওয়া যদি তীব্র হয়? সর্বনাশা আত্মনাশা সেই তীব্র চাওয়া দোসরও জুটিয়ে দিল৷

ওদিকে জনমেজয়ের যজ্ঞসভায় যে গল্পকথার আসর বসেছিল, তাতে উপস্থিত শ্রোতাদের মনেও এমন টানটান উত্তেজনার গল্প শুনতে শুনতে নানান প্রশ্নের ভিড়৷ সকলের মুখপাত্র হয়েই যেন কৌতূহলী জনমেজয় জানতে চাইলেন বৈশম্পায়নের কাছে, ‘কী এমন ঘটল, যে আমার পিতামহেরা এমন সর্বনাশা পাশাখেলায় মেতে উঠলেন! কেন তাঁরা রাজি হলেন? এ যাবৎ অনেক বিপদের পর তো তাঁরা একটু একটু করে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন! তবে কী এমন ঘটল?’ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত সকলের মনেই এসেছিল, ‘কী এমন ঘটল? পাণ্ডবদের কি বুদ্ধিনাশ ঘটেছিল? দুর্যোধনের অসত্প্রিবৃত্তিবিষয়ে তাঁরা যে ওয়াকিবহাল ছিলেন না তা নয়, তবে?’

বৈশম্পায়নও নিজে কথাগুলো সাজিয়ে নেন, এবার তো গল্পের মোড় ঘুরতে শুরু করবে৷ শ্রোতারাও হয়তো উত্তেজিত হয়ে পড়বেন সেসব শুনে৷ তাঁর তো আর বিচলিত হলে চলবে না! তাঁর কাজ শুধু বলে যাওয়া৷ তাই গুছিয়ে নেন নিজেকে৷ আর তারপর বলে চলেন৷ ঘটে যাওয়া অতীত যেন ছবির মতো স্পষ্ট ভেসে ওঠে তাঁর চোখে৷

দুর্যোধন জানতেন যে তাঁর পিতার তাঁর প্রতি বিশেষ দুর্বলতার কথা৷ সে বড় ছেলেই বলেই হয়তো! অথবা দুর্যোধনের জন্মের সময়ে যে সমস্ত কুলক্ষণ চোখে পড়েছিল, লোকে বলেছিল, এ সমস্ত লক্ষণ আগামীদিনের অনেক সর্বনাশের ইঙ্গিত৷ বাবার মন কি আর সেসব কথা মানতে চায়? তবু ধৃতরাষ্ট্র ফেলে দিতেও পারেননি সেকথাগুলো৷ মন তাঁর কু গাইতই৷ কী জানি কী হয়! এমন ক্ষেত্রে যথার্থ পিতার মতো ছেলেকে শাসনও করতে পারেননি৷ তাঁর অন্ধ স্নেহ দুর্যোধনের ক্ষেত্রে আরও ক্ষতিকারক হয়েছে৷ নয়তো দুর্যোধনের অন্যায় কাজগুলো ভুলে গিয়ে পাণ্ডবেরা যখন আবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন পরিবারের অন্যান্য সকলের সঙ্গে, তখন ভাইয়ে ভাইয়ে বাঁধন যেন দৃঢ় হয়, সেটা দেখা তাঁর কর্তব্য ছিল৷ সেখানে দুর্যোধনের অযথা অন্যায় আবদার মেনে নিলেন তিনি৷ আর মনে মনে ভাবলেন, ‘দৈবই সহায় হবে৷’ নিশ্চয়ই ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ হবে না৷ নিশ্চয়ই এ পাশাখেলা শুধুমাত্র সম্প্রীতির নিদর্শন হয়ে থাকবে৷

কী আশ্চর্যের কথা! দৈবকে কেই-বা অতিক্রম করতে পারে! ‘নিয়তি কেন বাধ্যতে?’ দুর্যোধনের নিয়তি, ধৃতরাষ্ট্রের নিয়তি, পাণ্ডবদের নিয়তি সব যেন একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেল ধৃতরাষ্ট্রের পাশাখেলায় অনুমতিপ্রদানের সঙ্গে সঙ্গে৷

এদিকে দুর্যোধন পিতাকে ঠিক ততটুকুই বলেছিলেন, যতটুকু বলা দরকার ছিল৷ মামা শকুনি যে আশ্বস্ত করেছেন, পাশাখেলায় প্রয়োজনে ছল করেও পাণ্ডবদের হারিয়ে দেবেন, একথা পিতাকে বলার প্রয়োজন মনে করেননি৷ কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র কি তা বোঝেননি? একটা অঘটন যে ঘটতে চলেছে তা তিনিও বুঝেছিলেন৷ কিন্তু পুত্রের প্রতি অন্ধস্নেহে তিনিও ভুল করলেন৷ অনুমতি দিলেন ইন্দ্রপ্রস্থের মতো জাঁকজমকে ভরা প্রাসাদ নির্মাণের৷ আর তারপর সেই প্রাসাদে আয়োজন হবে সম্প্রীতির পাশাখেলা৷ আমন্ত্রিত হবেন আত্মীয়বন্ধুস্বজন৷ আমন্ত্রিত হবেন পাণ্ডবেরা৷ আর তারপর?…

মামা শকুনি পাশাখেলায় তুখোড়৷ আর যুধিষ্ঠিরকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি যে সেটা ফেরাতে পারবেন না, সেটা দুর্যোধন জানতেন৷ পাণ্ডবদের সমৃদ্ধি দেখে ঈর্ষান্বিত দুর্যোধনের ক্রমাগত বিলাপে শকুনিরও মনে হতে থাকে, তাঁর আর কীসের স্বার্থ! একেই এই পরিবার তাঁর জীবনে অপকার বই উপকার তো কিছু করেনি৷ এই পরিবারের জন্যই তাঁর অমন বিদুষী ভগ্নীর এমন দুর্দশা৷ অন্ধ রাজাকে বিবাহ করে তারপর স্বেচ্ছায় এমন আলোহীন জীবন বরণ৷ সবই তো এই পরিবারের জন্য৷ রুক্ষ কঠোর দেশের মানুষ তিনি৷ মন তাঁর ততোধিক কঠোর৷ হস্তিনাপুরের আরামে আয়েশে যাদের বাস তারা তাঁর মুখের ভাব দেখে কোনওমতেই মন পড়তে পারবে না, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত৷ দুর্যোধনের বিলাপে আরও দৃঢ় কঠোর হয় তাঁর মন৷ সাময়িকভাবে দুর্যোধনকে নির্বৃত্ত করার চেষ্টা করেন৷ কূটবুদ্ধি কঠোর হৃদয়ের লোকের ক্ষেত্রে হয়তো সেটাই স্বাভাবিক৷ যদি তিনি তা না করতেন তবে সকলের সন্দেহ তাঁর ওপরেই গিয়ে পড়ত৷ সকলের নজরে তিনি তো আসতে চান না৷ তিনি শুধু চান এমন গুরুত্বহীন হয়ে আড়ালে থেকে কাজ হাসিল করতে৷ এতকাল দুর্যোধনের ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকবার ফল এতদিনে ফলেছে৷ পাশাখেলায় তাঁকে হারাবে এমন মানুষ খুব কমই রয়েছে৷ তার ওপর খেলায় কপটতা করলে তো কথাই নেই৷ রাজ্যে লোকে তাঁকে গান্ধারীর ভাই বলেই চেনে৷ আর বেশি চেনাতেও চাননি তিনি৷ আজ নিজেকে প্রকাশ করবার সময় এসেছে৷ দুর্যোধন যখন নিজের অন্যায় কাজের দোসর করতে চাইলেন, তিনি রাজি হলেন৷ কথা দিলেন পাশে থাকার৷ পাণ্ডবদের বশে আনার জন্য পাশাখেলা ছাড়া আর উত্কৃদষ্ট কোনও উপায় নেই, দুর্যোধনকে একথা বোঝালেন তিনি৷

দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে তাঁর মনের মোড় ঘোরালেন৷ ধৃতরাষ্ট্রকে বুদ্ধি দেবার জন্য সেখানে ভীষ্ম বিদুর প্রভৃতি কোনও কুরুবৃদ্ধই উপস্থিত ছিলেন না৷ এমন প্রস্তাব যে কেউই অনুমোদন করবেন না তা কি আর জানতেন না দুর্যোধন? পিতামহ ভীষ্ম, পিতৃব্য বিদুর সকলেরই এমন পাণ্ডবপ্রীতি! ভাবতে ভাবতে আরও দৃঢ় হয় দুর্যোধনের মন৷ পিতাকে তিনি বোঝান, না কোনও যুদ্ধ নয়, কোনও বিবাদ নয়, কেবল পাশা খেলে তিনি পাণ্ডবদের সমৃদ্ধিহরণ করতে চান৷

বৃদ্ধ, অন্ধ, পুত্রস্নেহাতুর রাজা ছেলের অন্যায় প্রস্তাবের মায়াজালে পড়ে যান৷ কতকটা যেন দৈবপ্রেরিত হয়েই আদেশ দেন কর্মচারীদের, এক বিচিত্র সভা নির্মাণ করবার জন্য৷ আর ভাই বিদুরকে ডেকে পাঠান৷ পাণ্ডবেরা বিদুরকে শ্রদ্ধা করেন৷ বিদুরও পাণ্ডবদের অত্যন্ত স্নেহ করেন৷ পাশাখেলার আমন্ত্রণের জন্য কোনওমতে যদি বিদুরকে বুঝিয়েসুঝিয়ে পাঠানো যায় পাণ্ডবদের কাছে৷

নিয়তির হাতের ক্রীড়নক তো সকলেই! পাণ্ডবদের শ্রদ্ধাভাজন বিদুরই বা কীভাবে নিয়তির ডাক উপেক্ষা করতে পারেন!
কীভাবেই বা অগ্রাহ্য করতে পারেন ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধ! ধৃতরাষ্ট্রের দূত হয়ে সদ্য তৈরি হস্তিনাপুরের বিচিত্রসভায় পাশাখেলার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ইন্দ্রপ্রস্থের পথে এগিয়ে চলেন বিদুর, নিতান্ত অনিচ্ছাভরে, নানা অমঙ্গল আশঙ্কা করতে করতে৷

Skip to content