শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

দীর্ঘ দু’বছর ধরে খুদেরা করোনার কারণে প্রায় গৃহবন্দি। এই সময়ে তারা অনলাইনেই স্কুলের পড়া করেছে। গানবাজনা, পড়াশোনা, খেলাধুলা প্রায় সবই অনলাইনে। ফলে টানা দীর্ঘ সময় ধরে তারা স্মার্টফোনের সঙ্গে সময় কাটায়। এই সময় বাচ্চাদের মধ্যে স্মার্টফোনে আসক্তি মাত্রা আগের থেকে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। এর ফলে ওরা ওদের অজান্তে একাধিক রকমের মানসিক সমস্যার শিকার হচ্ছে। স্মার্টফোনের এই আসক্তি বাড়তে বাড়তে এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে, বাবা-মায়েরা জানেন না কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে এখন তাঁরা দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন।

তাই এই সময়ে প্রায় সব বাড়ির সাধারণ সমস্যা হয়ে ওঠা পরিবারের খুদে সদস্যদের স্মার্টফোনে আসক্তি থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব৷ তার উত্তর খুঁজতেই আজ এই বিষয়টিকে আলোচনার জন্য বেছে নিয়েছি৷ বিজ্ঞান যেমন একদিকে আমাদের কাছে আশীর্বাদ, তেমনি অভিশাপও৷ ঠিক তেমনি স্মার্টফোনও আমাদের কাছে যেমন আশীর্বাদস্বরূপ, তেমনি অভিশাপেরও একটি রূপ৷ আমাদের জানতে হবে কীভাবে গ্যাজেটসটিকে আমরা ব্যবহার করব।

কী করে বুঝবেন সন্তান স্মার্টফোনে আসক্ত?

● প্রথমত: স্মার্টফোনে আসক্ত হলে ছোটদের স্মার্টফোনের সঙ্গে সময় কাটানোর সময়সীমা অনেকটাই বেড়ে যাবে। যখনই আপনি তাকে দেখছেন তখনই সে স্মার্টফোন নিয়ে কিছু-না-কিছু করছে৷ কিন্তু আপনাকে দেখামাত্র সে ওটি লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। এমনকী বাথরুমে গিয়ে লুকিয়ে স্মার্টফোন দেখছে! অর্থাৎ আপনাকে আড়াল করে সবসময় ও স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। তখন আপনার মধ্যে সন্দেহ জাগবে যে, পড়াশোনার সময় তো সে আপনার সামনেই স্মার্টফোনে ক্লাস করছে। তবুও তাকে কেন আপনাকে লুকিয়ে স্মার্টফোন দেখতে হবে? এটি কিন্তু তার মোবাইলের প্রতি আসক্তি হয়ে পড়ার একটি প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।

● দ্বিতীয়ত: আপনি লক্ষ করে দেখবেন আপনার স্মার্টফোনের বিভিন্ন গেমস বা অন্যান্য চ্যাটিং অ্যাপ ডাউনলোড করে সে অনেকটা সময় ওতে বুঁদ হয়ে থাকছে৷ অর্থাৎ এভাবেই তার গেম গেম খেলা বা চ্যাটিং-এর মাধ্যমে স্মার্টফোনে আসক্তি অনেকটা বেড়ে গিয়েছে বা বাড়ছে।

● তৃতীয়ত: আপনি একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, খুদের পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ অনেকটাই কমে গিয়েছে। যে ছেলে-মেয়ে আগে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করত, এখন সে আর ততটা মনোযোগ দিতে পারছে না। এটাও কিন্তু স্মার্টফোনে আসক্তির ফল। শুধু পড়াশোনা নয়, তার দৈনন্দিন কাজকর্ম—যেমন, স্নান করা, খাওয়া প্রভৃতি সে ঠিক সময়ে করছে না, যা বেশ চিন্তার বিষয়।

এছাড়াও আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না, ও আপনার অগোচরে স্মার্টফোনে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করছে। কিন্তু একটু নজর করলেই আপনি লক্ষ করবেন, সে হয়তো খেতে বসেও বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করে চলেছে। বাবা-মা বারণ করলে সে বিরক্তি প্রকাশ করছে। অথবা আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রকাশ করছে। খুদের এই অস্বাভাবিক আচরণও স্মার্টফোনে আসক্তির জন্য হচ্ছে।

কী কী কারণে বাচ্চাদের মধ্যে এই স্মার্টফোনে আসক্তি দেখা যায়, তার অনেকগুলো সম্ভাব্য কারণ আগেই আলোচনা করেছি। এছাড়াও কিছু কিছু বাচ্চার মধ্যে জন্মগত সমস্যা থাকে। যার জন্য তাদের মধ্যে অমনোযোগিতার লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেসব ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই স্মার্টফোনের প্রতি আসক্তির সম্ভাবনা বেশি থাকে। আবার কারও কারও মধ্যে ‘অবসেসিভ কম্পালসিভ বিহেভিয়ার’ দেখা যায়। যাদের মধ্যে এই সমস্যা রয়েছে তাদের অন্যদের তুলনায় বেশি স্মার্টফোনে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কখনও কখনও এও দেখা যায়, ‘ডিপ্রেশন’ থেকেও বেরিয়ে আসার কারণে স্মার্টফোনে আসক্তি হয়। অর্থাৎ ‘ডিপ্রেশন’ থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে সে স্মার্টফোন দেখে অনেক সময়ই আনন্দ পায়। এখানেই শেষ নয়, পরিবারে অন্য কোনও সদস্যও যদি ”অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার’-এর মতো সমস্যায় ভোগেন, তাহলে পরিবারে ছোটদের মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা যেতে পারে।

তাহলে এর থেকে মুক্তির উপায়?

এক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হল, যখন বাচ্চারা ছোট থাকে মানে দু’-তিন বছর বয়স তখন অধিকাংশ বাবা-মা-ই ‘বিনোদন’-এর জন্য তাদের হাতে স্মার্টফোন ধরিয়ে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে বাবা-মায়েদের বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে অনেক সতর্ক ও দায়িত্ববান হতে হবে। বিশেষ করে অনেক বাড়িতেই দেখা যায় বাচ্চাদের সামনেই বাবা-মায়েরা সবসময় স্মার্টফোনে ব্যস্ত থাকছেন। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, একবার একজন মা তাঁর মেয়েকে নিয়ে আমার চেম্বারে এসেছেন স্মার্টফোনে আসক্তি নিয়ে পরামর্শ নিতে। মায়ের বক্তব্য: ‘মেয়েকে কিছুতেই স্মার্টফোন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না। তাকে স্মার্টফোন না দিলে সবকিছু ভেঙে ফেলছে। প্রতি মাসে নিত্যনতুন তার স্মার্টফোন দরকার। প্রচুর টাকা-পয়সা নষ্ট করছে। ডাক্তারবাবু আপনি বাঁচান।’ এই পরিস্থিতিতে যখন আমি মেয়েটির সঙ্গে কথা বলছি, তখন লক্ষ করলাম মা সমানে বসে বসে স্মার্টফোনে চ্যাট করে যাচ্ছে৷ আমার এই কথা বলার মূল উদ্দেশ্য হল, বাচ্চার স্মার্টফোনে আসক্তির ক্ষেত্রে অনেকটাই দায়ী কিন্তু বাবা-মায়েরা। অর্থাৎ এক্ষেত্রে নিজেকে সতর্ক তো হতেই হবে, পাশাপাশি ছোটকেও বোঝাতে হবে, স্মার্টফোন শুধু কাজের সময়ই ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু আপনি নিজে যদি এই নিয়ম ভাঙেন তাহলে ছোটদের স্মার্টফোনে আসক্তি থেকে বাঁচানোও কঠিন হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে বাচ্চা যদি স্মার্টফোন ব্যবহার করে তাহলে আপনি তাকে বারণ করলেও সে শুনবে না। বরং তার জেদ আরও বেড়ে যাবে। তাই আগে সাবধান হতে হবে বাবা-মাকেই।

খুব প্রয়োজন হলে বাচ্চাদের সেই সব স্মার্টফোনই দেবেন যাতে গেম অ্যাপ থাকবে না। কারণ ছোটবেলাতে মস্তিষ্কের বৃদ্ধির সময় যদি সে গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে তবে তাকে পরবর্তী জীবনে সামলানো অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। তাই প্রথম থেকেই স্মার্টফোন এমনভাবে লক করে রাখুন যাতে সে কোনওরকম অ্যাপস ডাউনলোড করতে না পারে। অবশ্যই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। মনে রাখবেন, বাচ্চার চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই স্মার্টফোনে নিয়ন্ত্রিত করতেই হবে। কিছুটা সময় তাকে মোবাইল দেবেন ঠিকই কিন্তু বাকি সময়টা স্মার্টফোন আপনার কাছেই রাখবেন।

আরেকটি বিষয় হল, বাড়িতে একাধিক স্মার্টফোন রাখবেন না। দু-তিনটির বেশি স্মার্টফোন যদি বাড়িতে থাকে তাহলে বাচ্চার কিন্তু আসক্তি হওয়া স্বাভাবিক। এগুলো ছোট ছোট বিষয় হলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রথম থেকেই আপনাদের সতর্ক হতে হবে, বাচ্চাকে কখন স্মার্টফোন দেবেন, আর কখন দেবেন না।

আসক্ত হলে কী কী করণীয়

প্রথমেই সন্তানকে বকাঝকা না করে স্মার্টফোনের খারাপ দিক সম্পর্কে ওকে গল্পচ্ছলে বোঝাতে হবে। স্মার্টফোন দেখার একটা নির্দিষ্ট সময় দিতে হবে৷ তাকে বলুন তুমি যদি চার ঘণ্টা পড়াশোনা করো তাহলে এক ঘণ্টা তোমাকে স্মার্টফোন দেখতে দেওয়া হবে। স্মার্টফোন দেখার ক্ষেত্রে অবশ্যই সময় নিয়ন্ত্রিত করুন। যতক্ষণ পারবে স্মার্টফোন দেখবে এটা কিন্তু একেবারেই করতে দেওয়া যাবে না। এটা সন্তানকে ছোট থেকেই শেখাতে হবে। হঠাৎ করে ১৪-১৫ বছর বয়সে এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে কিন্তু তা আর সম্ভব নয়৷

এর পরেও যদি সমস্যাটি না মেটে তাহলে বুঝতে হবে বাচ্চার একটা মানসিক সমস্যা বা স্মার্টফোনের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়েছে। যদি এমন পরিস্থিতি কারও ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাহলে বিষয়টিকে অবহেলা না করে একজন মনোবিদের পরামর্শ নিন৷

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

যোগাযোগ: ৯৪৩৩২৯১৮৭৭


Skip to content