রাতের অন্ধকারে অরণ্যের পথে। আবিলো হঠাৎ লক্ষ্য করেছে গাছে জড়িয়ে আছে দু' তিনটি বিষাক্ত ভাইপার।
আমরাও আবিলো আর বাদিয়ার দেখাদেখি একবার পচামামাকে স্মরণ করে নিলাম যে যার নিজের নিজের ভাষায়। সকলের ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, জাতি, ভাষাভাষী সব এক হয়ে যায় ধরিত্রী মাতার সামনে, বেঁচে থাকার প্রার্থনায়, জীবনের শুভকামনায়। আবিলোর মতো আমরাও আশা রাখি সব বিপদ কাটিয়ে ধরিত্রী মাতাই আমাদের বাইরে বের করে নিয়ে যাবেন সুস্থ শরীরে।
কথা হয়ে গেল, সব সময় একদম কাছাকাছি থাকতে হবে। আবিলো বলে দিয়েছে ফটো তোলার জন্যও দাঁড়ানো যাবে না; পাছে অন্যেরা এগিয়ে যায় আর ফটোগ্রাফার একা রয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। প্রতিটা মুহূর্তেই বিপদ ঘটতে পারে। আর যদি একান্তই দাঁড়াতে হয় তাহলে সবাই একসঙ্গে দাঁড়াবে এক জায়গায়।
আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু এবার মনের মধ্যে ভয় খুব। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছি না এতটুকু। সব সময়ই মনে হচ্ছে এই বুঝি জাগুয়ারটা ওত পেতে বসে আছে… এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়ল। তবে সেরকম কিছু হল না কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে ঝপ করে কেমন যেন সন্ধে নেমে গেল আর কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই গাঢ় অন্ধকার। ভয় তো আছেই তার সঙ্গে যোগ হল এক অদ্ভুত আবদ্ধ ভাব। কিছু হলে কোন দিকে পালাব, কী করব কিছুই জানি না। দেখাই যায় না যে কিছু। আমরা ফ্ল্যাশলাইটগুলো জ্বালিয়ে ফেললাম। ওই রকম অন্ধকারে ফ্লাশলাইটের আলোয় ভালো করে লক্ষ্য করলে যেকোনও প্রাণীরই (এমনকী ছোট পিঁপড়েরও) চোখটা দেখা যায়। তাদের চোখে ওই আলো প্রতিফলিত হয়ে চকচক করলেই ঠাহর করে নেওয়া যায় যে ওখানে কিছু আছে। তবে তার জন্য একটু তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন যা কিনা আবিলো আর বাদিয়ার আছে খুব স্বাভাবিকভাবেই।
আমাজোনিয়ান ভাইপার। পৃথিবীর সবচাইতে বিষধর সাপগুলির মধ্যে এরা অন্যতম। আমাজনের জঙ্গলে বিভিন্ন প্রজাতির ভাইপার পাওয়া যায়। তাদের বিষের মাত্রা বিভিন্ন রকম। তবে বেশিরভাগই প্রাণঘাতী।
হঠাৎ করে হাঁটতে হাঁটতে আবিলো হাত দেখিয়ে কড়া সুরে আমাদের দাঁড়িয়ে যেতে বলল। আমরা প্রথমটায় বুঝতে পারিনি। তারপর তার আঙুলের অভিমুখে সামনের দিকে চেয়ে রক্ত জল হয়ে গেল। আমাদের মাত্র ৩-৪ ফুট সামনে, মাথা থেকে বড়জোর ৬-৭ ইঞ্চি ওপরে হবে; পাশাপাশি গাছ থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝুলছে দুটি কি তিনটি পিট্-ভাইপার। আমি দেখলাম দুটি, কিন্তু আবিলো বলল ওই আড়ালে নাকি আরও একটি আছে যেটা আমি দেখতে পাচ্ছি না। এখন আমার চোখের আড়াল হোক ক্ষতি নেই; আশা করি আবিলোর চোখের আড়ালে আরও কয়েকটা বসে নেই। তাদের গায়ে ছোঁয়া লাগলেই নিশ্চিত মৃত্যু। আমরা নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। শুধুই মনে হচ্ছে এই বুঝি তেড়ে এসে মারল ছোবল।
পেছনে জাগুয়ার, সামনে ভাইপার। আর তার মধ্যিখানে আমরা। অন্ধকারের মধ্যে এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। আর ওই দু তিনটে সাপকে অমন সামনে থেকে দেখে শুধুই মনে হচ্ছে আমাদের চারপাশেই বুঝি সাপ। সে যে কী অসহনীয় পরিস্থিতি বলে বর্ণনা করতে পারব না। সত্যজিৎ রায়ের ‘খগম’ গল্পটি পড়া থাকলে খুব সহজেই ধারণা করা যাবে আমাদের মানসিক অবস্থাটা। যদিও গল্পে লেখা সাপ তাড়ানোর সেই লোকগীতিটির কথাটুকু মনে করার ক্ষমতাও তখন আমার নেই। আমার হাত পা কিছুক্ষণের জন্য প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো হয়ে গিয়েছিল। নড়তে পারছিলাম না। শুধু বারবার মনে হচ্ছিল মা-বাবা অতবার করে বারণ করেছিল আমাজনে যেতে। তবে এক দিকে রক্ষা। এরকম সময়ে আমাদের বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি বা ‘সারভাইভাল ইনস্টিংক্ট’ প্রচণ্ড বেড়ে ওঠে সহজাত ভাবেই, প্রাকৃতিক এবং মানবীয় দুই নিয়মেই। সম্ভবত শুধু সেইটুকুর ওপরে ভরসা করেই আমরা বেঁচেছিলাম এই মুহূর্তে। হাতে পায়ে একটু সংবিৎ ফিরে পেতেই ওই সময়টার একটা ছবি তুলে রেখে দিয়েছি শেষ মুহূর্তে। সামনে থেকে সাপের ছবি ভালো করে তুলতে যাওয়ার মতো সাহস ছিল না সেই সময়, বিশেষত যেখানে অন্ধকারে কয়েকটাকে চোখেই দেখতে পাচ্ছি না।
রাতের অন্ধকারে গাছের ওপরে একটি বোয়া সাপ।
আমরা সেই মুহূর্তে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু তারপর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে এই বুঝি সাপ উঠে আসছে গায়ে অন্ধকারের মধ্যে থেকে। গায়ে গাছের পাতা লাগলেই চমকে উঠছি। আবিলো আর বাদিয়া অবশ্য অভয় দিয়ে বলেছে যে তারা সব কিছুই সামনে এবং পেছন থেকে লক্ষ রাখছে। কিছু হলেই তারা বলে দেবে। তাদের চোখ এড়িয়ে কিছু হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। কিন্তু ওই প্রায় শব্দটিতেই যে পৃথিবীর সমস্ত ভয়, আকা, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা সব কিছু মিশে আছে। যাই হোক, আমরা আর কথা না বাড়িয়ে এগোতে লাগলাম রাতের অন্ধকারে এই গহন অরণ্যে। তবে হ্যাঁ, এই আদিবাসীদ্বয়ের চোখ আছে বটে। যেতে যেতে আবার একবার আমাদের দাঁড় করিয়ে মাথার অনেক ওপরে দেখাল একটি বোয়া সাপ। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় তার সরীসৃপ সুলভ নড়াচড়া বোঝা যায় বটে। আমরা তাদের দৃষ্টিশক্তিতে অবাক হয়ে গেলাম। এই বোয়া নির্বিষ। তারা নরখাদকও নয়। কাজেই ভয় নেই। আমরা এগিয়ে চললাম তাকে ছাড়িয়ে।
আরও প্রায় এক ঘণ্টা কি তার থেকেও কিছু বেশি সময় হেঁটে শেষে আমরা পৌঁছলাম আবিলোর পরিকল্পিত জায়গায়। সেখানে চারদিকটা একটু পরিচ্ছন্ন। বেশ কিছু বড় বড় গাছ রয়েছে তাঁবু আর মশারি খাটানোর জন্য। বাদিয়া তার ব্যাগ থেকে স্টোভ বের করে পাস্তা আর ডিমসেদ্ধ চড়িয়ে দিল। আশপাশের কাঠ কুটো এক জায়গায় করে আবার আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হল কালকের মতোই। একই রকম ভাবে পাস্তা, সস আর ডিমসেদ্ধ মেখে খেয়ে নিলাম সবাই। তবে আজ আর কারও ঘুম এল না। যা দিন গেল। আর তার ওপরে জাগুয়ার এখানেও চলে আসতে পারে না কি? যদি সেই জাগুয়ারটা এদিকেই এসে থাকে? আবিলো আর বাদিয়া বলেছে যে তার সম্ভাবনা প্রায় নেই। নাহলে এতক্ষণে কিছু না কিছু হয়ে যেত। কিন্তু আবার গণ্ডগোল করল ওই ‘প্রায়’… ওই অনিশ্চয়তা নিয়ে কি আর ঘুম হয় কারও।
যাইহোক আর শুধু আজকের রাতটুকু। আগামীকাল সন্ধের আগেই আমরা বেরিয়ে যেতে পারব জঙ্গল থেকে। এর পরের পথটুকুতে তেমন বিপদের সম্ভাবনা নেই। কারণ তার বড় অংশ পড়বে ন্যাশনাল পার্ক এবং রিসার্ভড ফরেস্ট-এর আওতায় যেখানে সাধারণ ট্রেইল আছে এবং ট্রেইল-এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং সুরক্ষার বন্দোবস্ত করে সরকার বা অন্যান্য সংস্থা।
ছবি: লেখক
বাইরে দূরে
লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com