শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের যা কিছু উন্নতি সব স্বামী অক্ষরানন্দজির (কালীপদ মহারাজ) চেষ্টাতেই হয়েছে বলে জানতে পারলাম৷ আশ্রমের বয়েজ স্কুলের সামনে বিরাট বকুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে অমল মহারাজ গল্প করতে করতে আমাকে বলেছিলেন, ‘আজও আমাদের মনে হয়, প্রয়াত পরম শ্রদ্ধেয় অক্ষরানন্দজি মহারাজ যেন অলক্ষ্যে এই আশ্রমের সবকিছু দেখছেন৷’

আশ্রমের আউটডোর চিকিৎসা ব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়েছিলেন অক্ষরানন্দজিই৷ যার সুফল হিন্দু-মুসলমানসহ ঢাকার সমস্ত সম্প্রদায়ের অসুস্থ মানুষই এখন পাচ্ছেন৷ অক্ষরানন্দজিকে মুসলমানরাও বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখত৷ এমনকী তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরাও স্বামী অক্ষরানন্দের নাম শুনে শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াতেন৷ এ কথাও শুনেছি, একবার ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনে গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করে কিছু দুষ্কৃতী৷ আশ্রম রক্ষা করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন অক্ষরানন্দজি৷ বাংলাদেশের তৎকালীন মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন তিনি৷ রাষ্ট্রপতির নির্দেশে অল্প সময়ের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনী পৌঁছে যায় অকুস্থলে৷

গত কয়েকদিন ধরে অমল মহারাজ দেখা হলেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন—গুপ্তভায়া, আপনি রমনা কালীমন্দিরে গিয়েছেন? ওই মন্দিরে একবার গিয়ে ঘুরে আসুন৷ ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা মন্দিরটিকে ভেঙেচুরে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়৷ আর ওদের বন্দুকের গুলিতে কত মানুষ যে মারা গিয়েছিল! ভাবলে শিউরে উঠি৷ রমনা কালীমন্দিরের পর আরও একটা জাগ্রত কালীমন্দির অবশ্যই দর্শন করবেন—শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী মাতা৷ হাতে সময় থাকলে একদিন শাঁখারি বাজারের দিকটাও পারলে ঘুরে আসুন৷ ভালো লাগবে৷ মনে হবে কলকাতারই কোনও হিন্দু অধ্যুষিত এক বিরাট বাজারে আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ সেদিন আশ্রমে সকালের টিফিন গরম গরম খিচুড়ি আর মুচমুচে আলুভাজা৷ স্নানের পর এরকম ব্রেকফাস্টের মজাই আলাদা৷ এরপর উপরি পাওনা রং চা৷ বাংলাদেশের মানুষ লিকার চা-কে রং চা বলতেই অভ্যস্ত৷ প্রথম প্রথম রং চায়ের ব্যাপারটা আমারও মাথায় ঢোকেনি৷ তারপর যতদিন ওই দেশে কাটিয়েছি, আমিও রং চা বলতে যেন অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম৷ হয়তো বাংলাদেশের মাটির গুণ৷

ঢাকা শহরের যানজট কিন্তু রিকশ সওয়ারিদের বিশেষ অসুবিধায় ফেলতে পারে না৷ কারণ, কোনও রাস্তায় বেশি ভিড়ভাট্টা হলে নানা রাস্তাঘাট ও অলি-গলি ঘুরে রিকশচালক ঠিক পৌঁছে দেবে গন্তব্যস্থলে৷ যেমন আমার বেলায় ঘটল৷ রামকৃষ্ণ মিশন থেকে শ্রীশ্রীরমনা কালীমন্দিরে যাচ্ছিলাম নিতাই মণ্ডলের রিকশয়৷ ব্যাটারিতে নয়, প্যাডেল করেই রিকশ চালাচ্ছিল নিতাই৷ পুরাতন ময়মনসিংহ রোডে রমনা কালীমন্দির৷ জায়গাটি শাহবাগ অঞ্চল৷ ময়মনসিংহ রোডের নব নামকরণ হয়েছে কাজি নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, ঢাকা-১০০০৷ বাংলা অ্যাকাডেমির উলটোদিকে ঐতিহাসিক রমনা কালীমন্দির৷

ঢাকার গুলিস্তান জায়গাটি দারুণ জমজমাট৷ প্রচুর ইলেকট্রনিক গুডসের দোকান এখানে৷ একই কথা মতিঝিল অঞ্চল সম্বন্ধেও প্রযোজ্য৷ স্বাভাবিক নিয়মেই রাষ্ট্রপতি ভবনের আশপাশ ঝাঁ-চকচকে৷
বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম-এর নির্মাণশৈলী তারিফ করার মতো৷ যাতায়াতের পথে মসজিদটি দেখার জন্য রিকশ থেকে নেমে পড়েছি৷ ঢাকার প্রায় মোড়ে মোড়ে মসজিদ৷ আর প্রতিটিই খুব যত্নের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে৷ এমনকী গোটা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জেও বড় বড় মসজিদ দেখে তাক লেগে যায়৷

মসজিদ নির্মাণের জন্য ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাসস্ট্যান্ডে জনসাধারণের কাছে অর্থসাহায্য চেয়ে মাইকে ঘোষণাও করা হয়৷ ঢাকার লালবাগ শাহি মসজিদ, শিয়া মসজিদ, কাঁকরাইল মসজিদের নতুন করে পরিচয়ের দরকার পড়ে না৷

নিতাই মণ্ডল রিকশ চালাতে চালাতে আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘বাবু, পথে আজ যতই ভিড় থাকুক আপনারে ঠিক সময়ে কালীমন্দিরে পৌঁছাইয়া দিমুই দিমু৷’ গরমে ঘামতে ঘামতে সে সমানে প্যাডেল করছিল৷ মাঝে মাঝে কাঁধের গামছা দিয়ে মুখ মুছছে৷ মতিঝিলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম৷ আশপাশে গায়ে গায়ে বহুতল৷ একটু আগেই ‘দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ বাঁ-হাতে রেখে এসেছি৷ এক হিন্দু ভদ্রলোকের বেশ নামকরা মিষ্টির দোকান৷ তারপর কিছুটা এগিয়ে ‘সরষে ইলিশ রেস্টুরেন্ট’ ও ‘পাঁচফোড়ন রেস্তরাঁ’ পাশাপাশি৷ দুই লেন চওড়া রাস্তা৷ অন্যদিকে ‘টাঙ্গাইল সুইট্স’ ও ‘টাঙ্গাইল মিষ্টি ঘর’৷ এই অঞ্চলের জনপ্রিয় দুটো মিষ্টির দোকান৷ শাপলা চত্বর (চার মাথার মোড়ে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলার সুন্দর ভাস্কর্য) পেরিয়েই নিতাই বলল, ‘যেরকম ভিড় দেখতাছি এরপর অলি-গলির ভিতর দিয়া যাইতে হইব৷’ বললাম, ‘তোমার রিকশয় উঠেছি৷ যেরকম বোঝো নিয়ে চলো৷ তবে রমনা কালীমন্দিরে আমার একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছনো দরকার৷’
নিতাই রিকশর মুখ ডানদিকে ঘুরিয়ে দ্রুত প্যাডেল করতে লাগল৷ শহরের এদিকটায় সেদিন তুলনামূলকভাবে যানজট খানিকটা কম৷ ঘাড়ের ওপর ঘন ঘন মানুষের নিঃশ্বাস পড়ে না৷ গাড়ি-ঘোড়া একে অপরের গায়ে হুমড়ি খায় না৷

এত যে যানজট ঢাকায়, একদিনও কিন্তু একটা বড়সড় দুর্ঘটনা চোখে পড়েনি আমার৷ বিশেষ করে রিকশগুলো অদ্ভুত কায়দায় একে অপরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি এড়াতে পারে৷

রাস্তার ধারে দেওয়ালে কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের বাঁধাগতের বুলি চোখে পড়েনি৷ দেখে ভালো লাগল, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি লেখা লাল রঙে—‘সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে…’, কিংবা ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী…৷’ রয়েছে কাজি নজরুল ইসলামের কবিতা ‘বলো বীর বলো উন্নত মম শির…৷’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা দেওয়াল জোড়া৷ রয়েছেন জসীমউদ্দীনও৷

‘বাবু, এই হল গিয়া আমাগো রমনা কালীবাড়ি…৷’ সত্যি, এতখানি পরিশ্রমের পরেও একেবারে গলদঘর্ম হয়ে হাসিমুখে তাহলে কথাগুলো বলতে পারল নিতাই! আসতে আসতে ভিনদেশি এক সহজ-সরল রিকশওয়ালার সুখ-দুঃখের বারোমাস্যা শুনেছিলাম৷ একসময় তার বাড়ি ছিল পদ্মানদীর ধারে৷ হঠাৎ এক দুর্যোগের রাতে পদ্মার তাণ্ডবে শেষ হয়ে গেল সবকিছু৷ মা-বাবা আর ছোট দুটো ভাই-বোন বন্যার জলে কোথায় যে ভেসে গেল! আজও ওদের আর্তচিৎকার কানে বাজে নিতাইয়ের৷

সে বেঁচে গিয়েছিল স্রোতে ভেসে যাওয়া একটা গাছ কোনওরকমে আঁকড়ে ধরে৷ পদ্মার ধারে ধারে প্রিয়জনদের কত খুঁজে বেড়িয়েছে৷ কত চোখের জল ফেলেছে৷ নিতাই আজও বিশ্বাস করে মা-বাবা ও ভাই-বোনকে একদিন সে ফিরে পাবে৷

ভাগ্যসন্ধানে একরকম ভাসতে ভাসতেই নিতাই ঢাকা শহরে এসেছিল বছর দশেক আগে৷ গাঁয়ের ইস্কুলে যখন পড়ত, লেখাপড়া করে একদিন বড় হওয়ার কথা ভেবেছিল৷ ভাগ্যের কষাঘাতে আজ সে রিকশ চালায়৷
উদয়াস্ত খেটে কোনও কোনও মাসে কুড়ি হাজার টাকা পর্যন্তও রোজগার তার৷ সংসার আছে৷ স্ত্রী, ছোট দুই ছেলে-মেয়ে৷ একদিন নিজে যা পারেনি ছেলে-মেয়েদের ভালোভাবে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার ইচ্ছা নিতাই মণ্ডলের৷ রিকশ চালাতে চালাতে সেই স্বপ্নেই যেন বিভোর থাকে সে৷ ওর সঙ্গে ৫০ টাকা ভাড়া রফা হয়েছিল৷ ওকে একশো টাকা দিয়ে বললাম, ছেলে-মেয়েকে মিষ্টি খাইয়ো৷ সেই মুহূর্তে কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল নিতাইয়ের চোখ-মুখ৷ —চলবে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content