সোমবার ১১ নভেম্বর, ২০২৪


আমাজনের সূর্যাস্ত।

আবিলো আর বাদিয়া এসে পৌঁছল তখন বেলা গড়িয়ে প্রায় সাড়ে তিনটে। রারেনবাকের উপকণ্ঠে বেনি নদী। সেই বেনির উৎস মুখে জলপথে চলতে হবে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক। তবেই পৌঁছনো যাবে অরণ্য প্রান্তরে। আবিলো তার চেনা এক মাঝিকে স্থানীয় ভাষায় কিছু বলতেই সে তার নৌকো প্রস্তুতে লেগে গেল। আমরা এক এক করে লাফিয়ে উঠে পড়লাম তাতে।

আধঘণ্টা চলার পরেই আশপাশের দৃশ্যপট পরিবর্তন শুরু হল। যত সময় যাচ্ছে দু’পারে শুধু গাছ আর গাছ—সূচকীয় মাত্রায় বেড়ে চলেছে তাদের ঘনত্ব। তারই মাঝখান দিয়ে এক পার্বত্য প্রস্তর উঠে গিয়েছে হঠাৎ করে অনেক উঁচুতে। সেখান দিয়ে ঝরে পড়ছে গুটিকয়েক ছোট ছোট, ক্ষীণস্রোতা ঝরনা। আর তাদের সাক্ষী রেখে আমরা কয়েকজন সভ্যতার গণ্ডি পেরিয়ে চলে যাচ্ছি দূউউউরে। বহু দূউউউউরে। কেউ কারওর সঙ্গে কোনও কথা বলছি না। শুধু দুচোখ ভরে দেখছি সবুজ আর প্রাণের সমারোহ নদীর দুকূল ছাপিয়ে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে এই পৃথিবীকে। এ কি আনন্দের অনুভূতি, নাকি অভিযানের উত্তেজনা, নাকি অনিশ্চিতের আশঙ্কা, সে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই প্রাণভরে শুধু শ্বাস নিয়ে চলেছি সেই অভিজ্ঞতা আর সেই অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে নিজের দেহে মনে চিরকালের জন্য মজুত করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে।
নৌকো পাড়ে এসে ভেড়ার পর অনেকটা রাস্তা, প্রায় ১৫-২০ মিনিট চড়াইয়ে উঠে যেতে হল আর সেখান থেকেই শুরু আমার ছোটবেলার ফ্যান্টাসি, আমাজনের গহন অরণ্য প্রান্তর। ঠিক হল সেই রাতটা ওখানেই কাটানো হবে। আবিলো আর বাদিয়ার সহযোগিতায় দুটো তাঁবু খাটিয়ে ফেললাম আমরা। এটা অনেকটা খোলামতো জায়গা। এখানে অনেকেই জঙ্গলে ঢোকার আগে থাকে। রাতটুকু কাটিয়ে ভোরবেলায় ঢুকে পড়ে ট্রেকিঙে। পর্যটকদের সুবিধার্থে সেখানে একটি জেনারেটার বসানো আছে। সন্ধে ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় সবার মোবাইল ফোন, পাওয়ারব্যাংক এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি চার্জ করে নেওয়ার জন্য। যদিও নেটওয়ার্ক কভারেজ থেকে শত যোজন দূরে তবুও ছবি তোলার জন্য ওই যন্ত্রটি কার্যকরী রাখা খুবই দরকার। চাইলে একটি পাওয়ারব্যাংকও সঙ্গে নেওয়া উপযোগী।

পরের দিন ঘুম ভাঙল মোবাইলের এলার্মের শব্দে। তখন প্রায় সকল ৬টা। মুখপ্রক্ষালনাদি সম্পন্ন করে দুএকটি গ্রানোলা-বার উদরস্থ করে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। সারা শরীরে তখন শিহরন। কী অপেক্ষা করে আছে ওদিকে কে জানে। ওখানে কি এল ডোরাডো দেখা যাবে? বা জঙ্গলে ঢুকেই কি দেখব একটা এনাকোন্ডা হাঁ করে গিলে খেতে আসছে? বা একটা জাগুয়ার কি হঠাৎ করে তেড়ে আসবে? এই সব আশঙ্কা, উত্তেজনা সব নিয়েই ঢুকে গেলাম জঙ্গলের মধ্যে।

জাগুয়ারের পায়ের ছাপ।

কিছুদূর হাঁটার পরেই বুঝলাম এ রাস্তা তথাকথিত ট্রেইল-এর চাইতে একেবারে আলাদা। ট্রেইল-এ গাছগাছালি সব কিছু কেটে অনেক ক্ষেত্রে তাকে কৃত্রিমভাবে হাঁটার উপযোগী করে তোলা হয়, এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় পর্যটনের স্বার্থে। কিন্তু এখানে পায়ের তলায় হাজারটা লতাপাতা, পিচ্ছিল শ্যাওলা, ভেঙে পড়া ডাল; সব মিলিয়ে, এককথায় হাঁটা বেশ কষ্টকর। তার ওপরে ওই হাঁটু পর্যন্ত বুট পরে হাঁটতে আরও অসুবিধা। তার ওপরে মশার উপদ্রব; মলমের প্রতিক্রিয়া শেষ হয়েছে কি হয়নি মুখে চোখে এসে ছাবরে ধরছে। মানুষের রক্তের স্বাদ পাওয়া গেছে, অত সহজে কি আর ছাড়া যায়।

ঠিক হল প্রতি ২ ঘণ্টা অন্তর আমরা একবার করে একটু বিশ্রাম নেব ১০-১৫ মিনিটের জন্য৷ কোনও একটা সময় দুপুরের খাওয়ার বিরতি। সঙ্গে থাকা মানচিত্র দেখে আবিলো দূরত্ব হিসেব করে প্রতিদিনের একটা করে গন্তব্য ঠিক করে রেখেছে কাল রাতেই। কী করে ঠিক করেছে আমার কোনও ধারণা নেই। আমার চারদিক দেখতে একই রকম লাগছিল। তারা নাকি অনেক ছোট থেকেই এসব জায়গায় যাতায়াত করছে। গাছের রকমফের দেখে নাকি জায়গা আন্দাজ করে নিতে পারে। সে যা-ই হোক, সূর্য ডোবার আগে ওই গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। সঙ্গে তিন-চার দিনের মতো খাবার মজুত আছে। আবিলোর পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে অপর এক প্রান্তে আমরা বেরিয়ে যেতে পারব তার মধ্যেই। আর মধ্যিখানে দেখা হবে ম্যাকাও পাখির উপত্যকা। ভয়ংকরের মধ্যে একরত্তি সুন্দর।
—চলবে

ছবি সৌজন্য: লেখক

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content