শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে দোসরা আগস্ট গিরিশচন্দ্রের ভক্তি রসাত্মক প্রথম চরিত নাটক ‘চৈতন্যলীলা’র শুভ উদ্বোধন ঘটেছিল স্টার থিয়েটারে। প্রথম থেকেই এই নাটক মঞ্চ-সফল। এর অভিনয় সুদীর্ঘকাল ধরে আপামর দর্শকমণ্ডলী ও সমাজকে আকৃষ্ট করেছিল যে তা ইতিহাসের কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। এই অসাধারণ জনপ্রিয়তার মূল একদিকে যেমন ছিল গিরিশচন্দ্রের লিখন-দক্ষতা, অপরদিকে তেমনি ছিল নিমাই চরিত্রের অভিনেত্রী বিনোদিনীর অনবদ্য অভিনয় প্রতিভার অবিস্মরণীয় অবদান।

অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক পরম বৈষ্ণব মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষ বাগবাজারের অধিবাসী ছিলেন এবং তিনি গিরিশচন্দ্রের প্রতিবেশী এবং গিরিশচন্দ্রের সুদীর্ঘকালের বন্ধু। শিশিরকুমার নাটক-প্রেমিক মানুষ ও পেশাদার রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। গিরিশচন্দ্র যখন নিমাইয়ের জন্মগ্রহণ থেকে শুরু করে বাল্যলীলা, কৈশোরলীলা ও গার্হস্থ্যলীলা অবলম্বনে সন্ন্যাস গ্রহণের ইঙ্গিত মাত্র দিয়ে চৈতন্যলীলা নাটক লিখে তার রিহার্সাল শুরু করেন, তখন শিশিরকুমার প্রায়ই রিহার্সাল দেখতে যেতেন এবং চৈতন্য চরিত্রের ভূমিকায় তিনি নানাভাবে বিনোদিনীকে অভিনয়ে উৎসাহ দিতেন। চৈতন্যলীলার অকল্পনীয় মঞ্চ সাফল্যে মোহিত হয়ে শিশিরকুমার চৈতন্যদেবের পরবর্তী সন্ন্যাস লীলা অবলম্বনে আরেকটি নাটক লেখার জন্য গিরিশচন্দ্রকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন এবং রচনাকালে চৈতন্য তত্ত্ব তথ্যাদি দিয়ে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন শিশিরকুমার। বস্তুত তাঁরই অনুপ্রেরণায় গিরিশচন্দ্র নিমাই সন্ন্যাস নাটকটি রচনায় ব্রতী হন। চৈতন্যলীলা নাটকের চৈতন্যের ভূমিকায় বিনোদিনী অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। ঠিক তেমনি বনবিহারিণী করেছিলেন নিতাইয়ের চরিত্রে এবং শচীমায়ের চরিত্রে করেছিলেন গঙ্গামণি। এই কৃতিত্বের কথা মাথায় রেখে বিনোদিনী, বনবিহারিণী, গঙ্গামণিকে নিমাই সন্ন্যাস নাটকেও তাদের ওই ভূমিকাগুলিতেই নিয়েছিলেন। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন কেশব ভারতীর চরিত্রে অমৃতলাল মিত্র, প্রতাপ রুদ্রের চরিত্রের প্রবোধচন্দ্র ঘোষ, রামানন্দ চরিত্রে উপেন্দ্রনাথ মিত্র প্রমুখ। নিমাই সন্ন্যাস নাটকের যখন অভিনয় প্রস্তুতিপর্ব চলছে তখন স্টার থিয়েটারে সুরকার ও সংগীত শিক্ষকের পরিবর্তন ঘটে।

এ যাবৎ সংগীত পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন সংগীতাচার্য বেণীমাধব অধিকারী। তাঁকে সরিয়ে দিয়ে ওই পদে সংগীতাচার্য রামতারণ সান্যালকে নিযুক্ত করেন গিরিশচন্দ্র। নিমাই সন্ন্যাস নাটকের সমস্ত গান নিয়ে বিভিন্ন রাগে এবং তালে উল্লেখিত হয়েছে। নাটকটিতে গানের অত্যধিক প্রাচুর্য রয়েছে এবং এদের সংখ্যা ২৩। নিমাই সন্ন্যাস নাটকে নিতাইয়ের গান সবচেয়ে বেশি, তারপরেই নিমাইয়ের। তেইশটি গানের মধ্যে নিতাই একাই গেয়েছেন চারটি গান। আলোচ্য নাটকটি মঞ্চ সাফল্য অর্জনে সমর্থ না হলেও এতে সংগীতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি গানই সুগভীর ভাবোদ্দীপক। ‘রাধে যাই’, ‘প্রেমের দায়ে’, ‘প্রেমের রাজা কুঞ্জবনে কিশোরী’, ‘কি দোষে খেলিলে রাঙ্গা পায়’, ‘দেখো দেখো কানাইয়ের আঁখি ঠারে ওই’, ‘শুকালো মালতী মালা প্রভৃতি গান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নাটক দেখতে স্টার থিয়েটারে এসেছিলেন স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ১৮৮৫ সালের ১০ জানুয়ারি। নিমাই সন্ন্যাস গিরিশচন্দ্রের দ্বিতীয় চরিত নাটক। নিকটতম পৌরাণিক নাটক প্রহ্লাদ চরিত্রের ব্যর্থতা এবং পূর্ববর্তী চৈতন্যলীলার ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিমাই সন্ন্যাস নাটক লিখতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। বৃন্দাবন দাসের লেখা চৈতন্যভাগবত, কবিরাজ কৃষ্ণ দাস গোস্বামীর লেখা শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত এবং লোচন দাস-এর চৈতন্যমঙ্গল এই তিনটিকে অনুসরণ করেছিলেন গিরিশচন্দ্র। ষোড়শ শতাব্দীতে সমগ্র নবদ্বীপধামের কেন্দ্রীয় প্রাণপুরুষ নিমাইয়ের সন্ন্যাস গ্রহণের আভাস দিয়ে পূর্ববর্তী চৈতন্যলীলা নাটকের যবনিকাপাত ঘটেছে। ভক্তদের সঙ্গে কাটোয়ায় কেশব ভারতীর কাছে নিমাইয়ের সন্ন্যাস গ্রহণকে কেন্দ্র করেই নিমাই সন্ন্যাস নাটকের সূচনা হয়েছে। তারপর শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্য-এর বাড়িতে সকলের সঙ্গে মিলনের পরে ভক্তগণ সহ নীলাচলে গমন, পরিশেষে নবদ্বীপে নিমাই বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাব সম্মেলনের মাধ্যমে কাহিনির পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

১৮৮৭ সালের পয়লা জানুয়ারি শনিবার অভিনয়ের পর স্টার থিয়েটার পরিত্যাগ করেন বিনোদিনী। তাঁর রঙ্গালয় থেকে বিদায় গ্রহণের পর নিমাই সন্ন্যাস নাটকের অভিনয় আর কোনওদিন হয়নি। নিমাই সন্ন্যাস চরিত্রের নামভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন বিনোদিনী। তাঁর সম্পর্কে বহু সমালোচকরা একমত যে নিমাই সন্ন্যাস আধ্যাত্মিক তথ্যপূর্ণ নাটক বলেও হয়তো সাধারণ দর্শকের কাছে জনপ্রিয় হয়নি কিন্তু ওই ভূমিকায় তত্ত্বজিজ্ঞাসার ভাব ফুটিয়ে তুলতে বিশেষ যত্ন ও পরিশ্রম করতে হয়েছিল বিনোদিনীকে।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

Skip to content