রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

‘বয়স হয়ে গেছে তাই কম খেতে হবে’—বয়স্ক মানুষদের বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনায় এই কথাটি প্রায়শই শুনতে পাওয়া যায়। এটা কি আদৌ ঠিক? বয়স হয়ে গেলেই কি কম খেতে হবে? বয়স হয়ে যাওয়া মানেই কি অনুষ্ঠানবাড়িতে বা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে? বয়স হয়ে গেছে মানেই কি লোভনীয় কোনও খাবারই আর খাওয়া যাবে না? এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে বহু দ্বিধাদ্বন্দ্ব।
কম খাওয়া বা সব কিছু বর্জন করলেই কিন্তু প্রবীণদেরকে ভালো রাখা যাবে না। তার জন্য দরকার আমাদের সঠিক জ্ঞান এবং সার্বিক সচেতনতা। বরং আমাদের অনেক ভুল ধারণার কারণে এবং কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে গিয়ে দেখা গেছে উলটে অপুষ্টির শিকার হচ্ছেন প্রবীণ মানুষেরা। আর সেই কারণে ঘটছে অনেক বিপত্তি। তাই অযাচিতভাবে আতঙ্কিত হয়ে অতিরিক্ত সাবধানতার বদলে আমাদেরকে জানতে হবে কীভাবে সঠিক মাত্রায় সুষম পুষ্টির মাধ্যমে বয়স্কদের ভালো রাখা যায়। কারণ মনে রাখবেন সুস্থ বার্ধক্যের অন্যতম চাবিকাঠি কিন্তু সঠিক পুষ্টি। চিকিৎসক হিসেবে আমি আমার আলোচনায় সহজভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করব এই বিষয়ে।

চলুন প্রথমেই জেনে নিই বার্ধক্যে পুষ্টি এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নানা ধরনের ক্ষয়জনিত পরিবর্তন আসে। তার সঙ্গে সমন্বয় রেখে খাদ্য ও পুষ্টিতে পরিবর্তন করার দরকার ভীষণ আবশ্যিক।

বার্ধক্যে বিশেষ করে হাড়, হৃৎপিণ্ড, শিরা, ধমনি, যকৃৎ, কিডনি, চোখ, চামড়া-সহ প্রায় সকল প্রকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়া শুরু হয়।
মস্তিষ্কেও কোষের সংখ্যা কমতে থাকে, এই বিষয়কে মাথায় রেখে প্রবীণদের খাদ্যতালিকা নির্বাচন ভীষণ জরুরি।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয় বার্ধক্যজনিত নানান জটিল রোগ, ব্যাধি। পুষ্টির ক্ষেত্রে এই দিকটিকেও গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

খাদ্যে শোষণ ক্ষমতা মেটাবলিজম কমতে থাকে।
এই সমস্ত কারণে বৃদ্ধ বয়সে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে পুষ্টির মাত্রা সঠিক হওয়া চাই।

বেশি বয়সের প্রবীণদের ক্ষেত্রে দাঁত পড়ে যাওয়ার কারণে খাদ্যের চর্বণজনিত সমস্যার দিকটি ও খাদ্য নির্বাচনের সময় মাথায় রাখা দরকার।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাবারের হজমের ক্ষমতা কমতে থাকে, এর সঙ্গেও কিন্তু পুষ্টির অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে।

কোষ্ঠকাঠিন্য ও মলের সমস্যা বয়স্কদের অন্যতম প্রধান সমস্যা। খাদ্য নির্বাচনে এই দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রবীণ মানুষেরা বহু ধরনের ওষুধ খান। এর সঙ্গেও কিন্তু পরোক্ষভাবে খাবারের হজম, শোষণ জড়িত। তাই এই বিষয়টিও খেয়াল রাখা জরুরি।

মহিলাদের রজঃনিবৃত্তির পর হাড় ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে। পরিমিত ক্যালশিয়ামপূর্ণ খাদ্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে।

প্রবীণদের অনেকেই শয্যাশায়ী। আবার অনেকেরই রাইলস টিউবের মাধ্যমে খাবার দিতে হয়। খাদ্য নির্বাচনে এই বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে।

সব প্রবীণদেরই কি এক খাবার?

একেবারেই নয়। কারণ আমাদের দেশে প্রবীণ বলতে বোঝায় ৬০ বয়সের ঊর্ধ্বে। আজকাল প্রচুর মানুষ ৯০ বছরের বেশি বাঁচেন। এমনকী শতায়ু প্রবীণদের সংখ্যাও কম নয়। তাই বয়স্কদেরকেও তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন—
নবীন বার্ধক্য : ৬০-৬৯ বছর
মধ্য বার্ধক্য : ৭০-৭৯ বছর
প্রৌঢ় বার্ধক্য : ৮০ বছর ও তদূর্ধ্ব

এই হিসেবে যাঁরা নবীন বার্ধক্যে পড়েন তাঁদের কায়িক শ্রম সাধারণভাবে বেশি তাই তাঁদের তুলনামূলক বেশি ক্যালোরি যুক্ত খাবারের প্রয়োজন। সেইভাবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়ার জন্য ক্যালোরির চাহিদাও কমে যেতে থাকে। তাই সেইভাবে খাদ্য নির্বাচন জরুরি। আবার প্রবীণদের মধ্যে যাঁরা আপাততভাবে সুস্থ তাঁদের সঙ্গে যাঁদের বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, লিপিডের আধিক্য, কিডনির সমস্যা, হজমের সমস্যা, স্নায়ুর সমস্যা, চলন জনিত সমস্যা প্রভৃতি রয়েছে তাঁদের খাদ্যতালিকায় অবশ্যই পার্থক্য থাকবে। কারওর ক্ষেত্রে যেমন কিছু নিষেধাজ্ঞা থাকবে আবার কারওর ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ খাদ্য যোগ করতে হবে।

প্রবীণ মহিলাদের হরমোনের ঘাটতি জনিত সমস্যার দিকটি আলাদা করে নজর দিতে হবে। আর আগেই বলেছি শয্যাশায়ী রোগীদের জন্য আলাদাভাবে চিন্তাভাবনা করে খাদ্য নির্বাচন জরুরি। তাই প্রবীণ মাত্রেই এক ধরনের খাবার বা পুষ্টি এটা একেবারেই সত্য নয়। বরং এক্ষেত্রে চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ গ্রহণ সর্বতোভাবে কাম্য।

লেখক: কর্ণধার ‘বাঁচবো’, সহ সম্পাদক জেরিয়াট্রিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া, পশ্চিমবঙ্গ শাখা৷ উপদেষ্টা, প্রোটেক্ট দ্যা ওয়ারিয়ার্স। যোগাযোগ : ‘বাঁচবো’, ফোন : ৯৯০৩৩৮৮৫৫৬


Skip to content