সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


স্বাধীন বাংলাদেশের দাবিতে কলকাতায় এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের পদযাত্রা ।

মিহির সেন আমাদের নিয়ে যখন এক্সপ্লোরার্স ক্লাবে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করছেন, পূর্ববঙ্গে ততদিনে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পূর্ববঙ্গের ওপর। দিনটা ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। নির্বিচারে গোলাগুলি চালিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেলতে লাগল সেনাবাহিনী। তাদের এই হত্যালীলায় কেঁপে উঠেছিল গোটা বিশ্ব। কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারত ছাড়া আর কোনও দেশ তখন পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতাকামী জনগণের পাশে দাঁড়ায়নি। তবে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণকারী বাঙালি ইপিআর সৈন্যরা জীবনমরণ পণ করে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। ইপিআর হল ‘ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস’। ইপিআর সেনাদের সঙ্গে স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা সমস্ত ভয়ভীতিকে তুচ্ছজ্ঞান করে সব ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। গড়ে ওঠে অকুতোভয় মুক্তি বাহিনী। ওদিকে পাকিস্তানি সেনাদের নরমেধ যজ্ঞে নানাভাবে সাহায্য করে চলল পূর্ববঙ্গের বিহারী মুসলমান সম্প্রদায়। এদের সঙ্গে হাত মেলায় স্থানীয় রাজাকাররা। নারী-শিশুরাও সংগঠিত এই হত্যালীলা থেকে বাদ গেল না। পাক সেনাদের অত্যাচারের শিকার হলেন অসংখ্য হিন্দু ও মুসলমান মহিলা। ধর্ষিতা হয়ে অনেকেই লজ্জা ও অপমানে আত্মঘাতী হলেন। সে বড় করুণ ইতিহাস। অশ্রুভেজা দিনলিপি। যুগে যুগে বিশ্ব ইতিহাসের পাতা ওলটালে এরকমই দেখা যায় যে, নারীজাতিই সমস্ত অপমানের যেন চূড়ান্ত লক্ষ্য। পরে এক পরিসংখ্যানে জানা গিয়েছে, এই স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ মারা যায়।

এদিকে ওপার বাংলা থেকে শরণার্থীর ঢল নামে এপার বাংলায়। ভীতসন্ত্রস্ত নরনারী প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ফেলে এককাপড়ে রাতারাতি চোখের জলে মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হল। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে তারা আশ্রয় নেয়। সল্টলেকে তখনও জনবসতি হয়নি। সেখানেও অনেকগুলো শরণার্থী শিবির ছিল। ‘রেডক্রস’সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সল্টলেকে শরণার্থীদের চিকিৎসা পরিষেবা থেকে শুরু করে নানাভাবে সাহায্য করতে দেখেছিলাম।

‘৭১-এর ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হল। এই জায়গাটি পূর্ববঙ্গের মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা ও ভবরপাড়া অঞ্চল। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের ক্যাবিনেট শপথ গ্রহণ করে। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান, কার্যকরী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। আওয়ামি লিগের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন বিভিন্ন মন্ত্রকের দায়িত্ব পান। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায়। ভারত সরকার এই সরকারকে সর্বতোভাবে সাহায্যের আশ্বাস দেয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নিক।

এক অনুষ্ঠানে শ্রীযুক্ত মিহির সেনের সঙ্গে লেখক।

মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬ দফা দাবির কথা মাথায় রেখে মিহিরদা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এক্সপ্লোরার্স ক্লাব অব ইন্ডিয়ার ছয় রকমের কর্মকাণ্ডের কথা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ঘোষণা করেন।
১. ইউথ ফর বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে। অর্থাৎ যুবসমাজ যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নানাভাবে সহযোগিতা করে সেই লক্ষ্য পূরণে ছেলে ও মেয়েদের নিয়ে দুটো আলাদা ভলেন্টিয়ার দল তৈরি করা হবে।
২. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও স্বাধীন দেশ হিসেবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একে স্বীকৃতি জানানোর জন্যে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান শুরু করা হবে। স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারত।
৩. বাংলাদেশের মানুষের দুঃসহ অবস্থা ও মেয়েদের ওপর পাকসেনার বর্বরোচিত আচরণ এক ফোটো এক্সিবিশনের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে। এই এক্সিবিশন হবে ধর্মতলার ব্যস্ত চার রাস্তার মোড়ে।
৪. সল্টলেক সেক্টর ওয়ানে শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য একটা টেন্ট (শিবির) খোলা হবে।
৫. কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে পদযাত্রা ও মিটিং হবে।
৬. কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে অর্থ সাহায্য নেওয়া হবে। এই অর্থ খরচ করা হবে শরণার্থীদের খাদ্যদ্রব্য বিতরণে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের জন্য খাবার পাঠানো হবে সীমান্ত এলাকাগুলিতে। বলা বাহুল্য, এক্সপ্লোরার্স ক্লাব এই কাজগুলো যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিল।

মিহিরদা মিটিংয়ের পর হাসিমুখে আমাদের বললেন, ‘এবার দারুণ একটা খবর দেব তোমাদের।’ সেই চমক কী হতে পারে ভাবছিলাম। শ্রদ্ধেয় মিহির সেন ছিলেন দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক কথার মানুষ। সাঁতারু হিসেবে জগৎজোড়া খ্যাতি ছিল তাঁর। লন্ডন থেকে সাফল্যের সঙ্গে ব্যারিস্টারি পাশ করে কলকাতা হাইকোর্টে একসময় প্র্যাকটিসও করেছেন। ব্যবসায়ী হিসেবে দেশজোড়া সুনাম অর্জন করেছেন। সাত ও আটের দশকে বিশ্ববাজারে রেশমের থান রপ্তানিকারক হিসেবে তাঁর সংস্থা ‘হিন্দুস্থান হ্যান্ডলুম অ্যান্ড হ্যান্ডিক্র্যাফটস’ দেশে পয়লা নম্বর জায়গায় ছিল। রেডিমেড গার্মেন্টসেরও ব্যবসা ছিল তাঁর। এই মাপের একজন ব্যক্তিত্ব কীভাবে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় চূড়ান্ত দারিদ্রের মধ্যে মারা গেলেন সে এক দুঃখের ইতিহাস। যা পাঠকদের যথাসময়ে শোনাব।

মিহিরদা যে খবরটা আমাদের দিলেন তাতে আমরা প্রচণ্ড উৎসাহিত হলাম। বললেন, ‘প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথাবার্তা হয়েছে। আমাদের জনস্বাক্ষর সংগ্রহের কর্মসূচির প্রতি ওঁর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। উনিও চান পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিক ভারত। আমি অনুরোধ করেছিলাম—এ ব্যাপারে প্রথম স্বাক্ষরটা কিন্তু আপনাকেই করতে হবে।উনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। আমার কাছে থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর জানতে চাইলেন। বিপন্ন শরণার্থীদের কথা বলতে গিয়ে খুব অসহায় লাগছিল মি. রায়কে। তিনি একথাও বলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এই মৃত্যুমিছিল, নারীর চূড়ান্ত অবমাননা, শরণার্থীর স্রোত এসব নিয়ে উনি একটা সিরিজ আঁকতে চান। একথা শুনে আমিও উদ্বুদ্ধ হলাম।’

মিহিরদার মুখে যামিনী রায়ের কথা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। কেন জানি না যামিনী রায়কে সামনে থেকে দেখার ইচ্ছে ক্রমশ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। কিংবদন্তি চিত্রশিল্পীর বাড়িতে কবে কখন কারা যাবে সে ব্যাপারে মোটামুটি এই মিটিংয়ে চূড়ান্ত হয়ে গেল। যামিনী রায় থাকতেন বালিগঞ্জে। মিহিরদা বললেন, ‘শিল্পীর বয়স হয়েছে। ওঁকে অযথা বিরক্ত করা উচিত হবে না। তাই আমরা কয়েকজন সকালের দিকেই মি. রায়ের বাড়িতে যাব। উনি জানতে চেয়েছেন কখন আমরা যেতে চাইছি। আমি ফোন করে সময়টা জানিয়ে দেব।’

যামিনী রায় এত নামী মানুষ। অথচ কী বিনয়ী। এসব কথাই ভাবছিলাম। তাঁর প্রতি অলক্ষ্যে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল আমার৷

ছবি : লেখক

Skip to content