সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে সঙ্গীত পরিবেশন করছেন লতা মঙ্গেশকর। ছবি : লেখক

প্রায় ৩৪ বছর আগের কথা। সেবার পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে আয়োজন করা হয়েছিল এক বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেদিন উপস্থিত ছিলেন লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহ মুম্বই চলচ্চিত্র জগতের তাবড় তাবড় অভিনেতা-অভিনেত্রী ও গায়ক-গায়িকা। উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সস্ত্রীক জ্যোতি বসু। ঘূর্ণায়মান মূল মঞ্চের সামনে ভিআইপি এনক্লোজারে বসে লতাজি, সামান্য তফাতে বসে রয়েছেন জ্যোতি বসু। সাংবাদিক হিসেবে আমিও ভিআইপি এনক্লোজারে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। প্রসঙ্গত, কলকাতার স্বনামধন্য ব্যবসায়ী গোয়েঙ্কা পরিবারের কোনও সদস্যা লতার সঙ্গে ছিলেন। তিনি কলকাতায় এলে গোয়েঙ্কাদের গেস্ট হাউসে উঠতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।

অনুষ্ঠানে প্রথমেই মঞ্চে উঠলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কয়েকটি জনপ্রিয় গানের পর ‘রানার’ ধরলেন। লতাজির দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম গানের তালে তালে পা ঠুকছেন, মাঝে মাঝে তালের সঙ্গে মাথাও দোলাচ্ছেন। তাঁর অভিব্যক্তি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি আন্তরিকভাবে গানটি উপভোগ করছেন। গান শেষ হতেই নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে করতালির সঙ্গে শ্রদ্ধা জানালেন তাঁর প্রিয় গায়ককে। ঘটনার মাধুর্য নিরীক্ষণ করে হাসির রেখা দেখা গেল জ্যোতি বসুর মুখে। যাঁকে হাসতে দেখা যেত কদাচিৎ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পরেই গান গাইতে উঠবেন লতা। হেমন্তবাবু মঞ্চ থেকে নেমে আসার আগেই তাঁর দিকে চটপট এগিয়ে গেলেন লতা মঙ্গেশকর। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন তখন দর্শক- শ্রোতাদের মুহুর্মুহু করতালিতে ফেটে পড়ছে। লতাকে দেখে হেমন্তবাবু স্নেহমাখা কণ্ঠে বলে উঠলেন—’ও আমার ছোট বোন, লতা এবার গাইবে।’ সুরসম্রাজ্ঞী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পদধূলি গ্রহণ করে আবেগমথিত কণ্ঠে বললেন, ‘আশীর্বাদ দিজিয়ে দাদা। ম্যায় ঠিক সে গা সকুঁ।’ এরকমই দাদা-বোনের এক সুমধুর সম্পর্ক ছিল তাঁদের।

পরে অন্য এক সাক্ষাৎকারে লতাজি এই লেখককে বলেছিলেন —’কেবল সুরকার বা গায়ক নন, তার থেকে অনেক বেশি কিছু ছিলেন হেমন্তদা। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অন্যরকম, সহজ সরল জীবনযাত্রা ছিল তাঁর। তিনি ছিলেন আমার পরিবারের অভিভাবক, আমার ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন।’ এমনকী লতাজি নিজের মুখে একথা স্বীকার করেছিলেন যে, তাঁকে রবীন্দ্রসংগীত গাইবার ব্যাপারে সর্বপ্রথম অনুপ্রাণিত করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই। লতাজির বক্তব্য অনুযায়ী—’রবীন্দ্রসংগীত গাইবার ক্ষেত্রে আমি বেশ ভয়ই পেয়েছিলাম। সেখানেও আমাকে সাহস জুগিয়েছিলেন হেমন্তদা।’ লতাজি এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘তোমার হল শুরু আমার হল সারা’, ‘মধুগন্ধে ভরা’, ‘তুমি রবে নীরবে’— এমন অনেক রবীন্দ্রসংগীত দর্শকদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এছাড়াও লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া হিন্দি চলচ্চিত্রের সেরা দশটি গানের মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরারোপিত ‘বিশ সাল বাদ’-এর ‘কাঁহি দীপ জ্বলে কাঁহি দিল’ গানটিকে অন্যতম বলে চিহ্নিত করেছেন তিনি।

বাংলার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল সুরসম্রাজ্ঞীর। বাংলার কথা বলতে গেলেই অত্যন্ত স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়তেন চিরকালই। সেই বাংলাকে কেন্দ্র করেই আমার সঙ্গে একবার ভাগ করে নিয়েছিলেন এক মধুর স্মৃতি। বাংলার তাঁতের শাড়ি ছিল তাঁর ভালোবাসার জিনিস। বাংলার মিষ্টি ছিল তাঁর বড়ই প্রিয়। মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘কলকাতা থেকে হেমন্তদা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আমার জন্য কলকাতার মিষ্টি এবং শাড়ি নিয়ে আসতেন। তখন তো আমার লম্বা চুল ছিল। দু’ বেণী বেঁধে শাড়ি পরতাম। হেমন্তদা আমাকে দেখে খুশি হয়ে বলতেন, তোমাকে একেবারে বাঙালি মেয়েদের মতো দেখতে লাগছে লতা।’ সচরাচর কারও পায়ে হাত দিয়ে তিনি প্রণাম করতেন না, কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে এসেছেন চিরকাল। বলতেন, ‘হেমন্তদার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে বড় ভালো লাগত। তিনি চলে গিয়েছেন, তাঁর গান শুনি, মনে হয় মন্দিরে বসে কোনও সাধক যেন গাইছেন।’

ভারতবর্ষের সুরসম্রাজ্ঞীর কোকিলকণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল আজ চিরকালের মতো। কিন্তু তাঁর নানা ভাষার অজস্র গান চিরদিন আমাদের মনে কালজয়ী হয়ে থাকবে। গোটা বিশ্ববাসীকে তাঁর সুরমাধুর্যে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, যা তাঁকে অমর করে রাখবে।

তাই সুরসম্রাজ্ঞীর অন্তিমযাত্রায় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে ফিরে যাব তাঁরই গানের দুয়ারে। তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন চিরকাল।

Skip to content