গরুড় ও বালখিল্যমুনিসংবাদ৷ ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে ৷
মহাভারত হল কৌরব ও পাণ্ডবভাইদের জন্ম, তাদের বড় হওয়া, কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে তাদের যুদ্ধ এসবকে কেন্দ্র করে নানান আখ্যানের সমাহার। সুতগণ এক এক আখ্যান বলতে গিয়ে জুড়েছেন আরও কতশত আখ্যান। সেইসব আখ্যানমালা আর নানা চরিত্র নিয়েই এই গল্প বলা— মহাভারতের আখ্যানমালা। প্রতি সপ্তাহে এই ধারাবাহিকটি লিখছেন বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজ -এর অধ্যাপক ড. অদিতি ভট্টাচার্য।
পর্ব : ৩
মাকে বিমাতার দাসীবৃত্তি করতে দেখে আদরের ছেলে গরুড়ের ভালো লাগে না৷ তিনি ঘোরাফেরা করেন আশপাশে আর অবশেষে বারংবার প্রশ্নে মায়ের মৌনতা ভাঙতে সমর্থ হন৷ মায়ের কাছে তিনি জানতে পারলেন কীভাবে কদ্রু আর তাঁর পুত্র সাপেদের শঠবৃত্তির ফলে তাঁর এই অপমানের দাসিত্ব৷ মাকে তিনি বলেন, ‘তুমি দেখো একদিন আমি তোমাকে এই পরাধীনতা থেকে মুক্ত করব৷’ সাপেদের গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘বলো তোমরা, কী করলে তোমরা আমার মাকে মুক্ত করবে?’ সাপেরা বলে ওঠে, ‘তুমি যদি কষ্ট করে আমাদের জন্য অমৃত এনে দাও, তবেই তোমার আর তোমার মায়ের মুক্তি৷’ গরুড় চিন্তায় পড়ে যান৷ অমৃত, সে তো বড় সহজ জিনিস না! সে পেলেই সাপেরা অমর হবে৷ তাতে হয়তো তারা আরও প্রবল হবে৷ কিন্তু এই মুহূর্তে গরুড় মায়ের মুক্তির জন্য যেকোনও কাজ করতে প্রস্তুত৷ যদিও স্বর্গে মর্তে তাঁর অবাধ গতি কিন্তু তিনি কি পারবেন সেই অমৃতের সন্ধান পেতে? এদিকে অমৃত হাসিল করতে পারলেই সাপেদের দাসত্ব থেকে তাঁরও মুক্তি, তাঁর মা বিনতারও৷ প্রাণপ্রিয় সন্তানকে মা খোঁজ দিলেন অমৃতের৷ বললেন সমুদ্রের মাঝে একপ্রান্তে যে ব্যাধেদের বাড়ি রয়েছে, সেখানে বাস করে নিষ্ঠুর, পাপিষ্ঠ হাজার হাজার ব্যাধ৷ তাদের ভক্ষণ করলেই অমৃত হাসিল করা সম্ভব৷ মায়ের এত অবমাননা সত্ত্বেও যে পুত্র মায়ের কষ্ট দূর করতে প্রস্তুত, তাইতে স্নেহপরায়ণা মা তাঁর সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করে প্রাণপ্রিয় পুত্রকে বিদায় দিলেন৷ গরুড়ের অতিকায় শরীর৷ তিনিও খুশি হলেন, ব্যাধেদের দিয়ে তাঁর খিদেতেষ্টার সাময়িক নিবৃত্তি সম্ভব৷ মা বলে দিয়েছিলেন, নিষ্ঠুর ব্যাধেদের বিনাশ করবার সময়, যেন কোনও নিষ্ঠাবান পণ্ডিত ব্রাহ্মণ যেন হত না হন৷ কার্যকালে সে কথা গরুড়ে স্মরণে রইল না৷ অনেক অনেক নিষাদের ভিড়ে এক ব্রাহ্মণও তাঁর কণ্ঠবিবরে প্রবেশ করে গলার কাঁটার মতো বিঁধে রইলেন৷ সেই মুহূর্তে গরুড় সচেতন হলেন এবং নিষাদী পত্নীর সঙ্গে ব্রাহ্মণকে রেহাই দিলেন৷ এতশত নিষাদভক্ষণেও যখন গরুড়ের ক্ষুন্নিবৃত্তি হল না, তখন তিনি মনের মতো দ্রুতগামী পাখা নিয়ে আকাশে উঠলেন, পথে দেখা হল পিতা কাশ্যপের সঙ্গে৷ কাশ্যপের কুশল প্রশ্নে পিতার কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে উঠলেন৷
বললেন, তিনি প্রচুর ভোজনে সমর্থ হচ্ছেন, তা ঠিক, তবে প্রচুর ভোজনে সবসময় আবার মঙ্গল নেই৷ শোনালেন তাঁকে সাপেদের কাছে দাসত্বের কথা৷| পিতার কাছে জানতে চাইলেন, আর এমন কোন খাবার আছে যাতে তাঁর ক্ষুধানিবারণ যেমন হবে আবার অমৃত আহরণের সামর্থ্যও জন্মাবে! মহাভারত যেন গল্পের সাগর৷ কত না আখ্যান উপাখ্যানের প্রসঙ্গ এসেছে কথায় কথায়৷ পিতা কাশ্যপ গরুড়কে বলতে থাকেন গজকচ্ছপের কথা৷ প্রাচীনকালে বিভাবসু নামের এক ঋষি ছিলেন৷ ঋষি হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্রোধী৷ আর তাঁর ভাই সুপ্রতীকেরও তপস্বীকুলে প্রসিদ্ধি ছিল৷ একবার তাঁদের মধ্যে ধনসম্পদের বাটোয়ারা নিয়ে মতানৈক্যের জেরে উভয়ে উভয়কে শাপ দিয়ে বসলেন৷ বিভাবসু হলেন বিশালাকৃতির হাতি আর সুপ্রতীক মস্ত বড় কচ্ছপে পরিণত হলেন৷ তাঁদের পূর্বশরীরের বিবাদ কিন্তু রয়ে গেল তাঁদের সঙ্গে৷ কশ্যপ বললেন, হে পুত্র সেই ঘোররূপ গজকচ্ছপকে বধ করে ভক্ষণ করো৷ তারপর তুমি তোমার অভীষ্ট পথে অর্থাৎ অমৃতের সন্ধানে যাও৷ অমৃতলাভের পথে এসব হয়তো বাধা৷ প্রকারান্তরে বাবা মা উভয়েই কি সেই দিকেই ইঙ্গিত করলেন? গজকচ্ছপকে হাসিল করা বড় সহজ কাজ ছিল না৷ কিন্তু গরুড়ের মন তো তৈরি আরও বড় লক্ষ্যের পথে৷ সাপেরা তাঁর আর তাঁর মায়ের জীবনে অন্ধকার৷ সে সব দূর হয়ে গিয়ে আলোর দিন আসুক, এই তাঁর মনের ইচ্ছে৷ সেই বিপুলাকার গজকচ্ছপকে নিয়ে মনের বেগে এগিয়ে চলেন৷ গরুড়ের তীব্র বেগে পথের বড়বড় ফুলফলে সমৃদ্ধ গাছপালা যেন ভয়ে কাঁপতে লাগল৷ সেইসব গাছের মধ্যে সেরা ছিল একটি বিশালাকৃতির বটগাছ৷ সে ছিল পক্ষীকুলের আশ্রয়দাতা৷ তার ছায়ায় বিশ্রাম পেতেন মনুষ্যকুলও৷ সেই বটগাছ বলে উঠল গরুড়কে উদ্দেশ করে, আমার এই সুবৃহৎ শাখায় বসে আপনি ভোজনকার্য সমাধা করতে পারেন৷ এদিকে গজকচ্ছপসহ গরুড় যেইমাত্র সেই গাছের শাখায় বসতে গেলেন শক্তপোক্ত সে শাখা গেল ভেঙে৷ তত্ক্ষিণাৎ তিনি সেই শাখাটিকে ধরে ফেললেন এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন সেই গাছের ডালে বালখিল্য নামের মুনিরা অধোমুখ হয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় তপস্যা করছেন৷ অমিতবলশালী গরুড় তপোরত মুনিদের রক্ষা করবার ইচ্ছায় ভক্ষ্য গজকচ্ছপকে নখ দিয়ে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে চঞ্চু দিয়ে শাখাটিকে ধরলেন৷ এই মস্ত পাখিটির এমন ভয়ানক কাজ দেখে মুনিরা অত্যন্ত বিস্মিত হলেন৷ এমন গুরু ভার বয়ে উড়তে সক্ষম তাই তার নাম দিলেন গরুড়৷ মায়ের আশীর্বাণী আর পিতার উত্সাহ যেন তাঁর হৃদয়ে প্রবল তেজের সঞ্চার করেছিল৷ অমিততেজোবলশালী সেই গরুড় বালখিল্যমুনিদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে কোথায় বসবার স্থান পেলেন না৷ এমনিভাবেই গজকচ্ছপকে ধারণ করে এবং অধোমুখে ঝুলন্ত বালখিল্যমুনিদের নিয়ে তিনি উড়ে চললেন৷ পথে প্রবল বেগশালী নিজের পুত্রকে দেখে পিতা কাশ্যপের গর্ব হল আবার তিনি ভয়ও পেলেন৷ তিনি বালখিল্যমুনিদের তপোবল বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন৷ তিনি জানতেন এই বালখিল্যমুনিগণ সূর্যকিরণমাত্র ভক্ষণ করে তপস্যা করছেন এবং প্রবল তপস্যায় সমস্ত পাপ তাঁদের বিনষ্ট হয়েছে, কোনওভাবে যদি তাঁরা গরুড়ের ওপর অসন্তুষ্ট হন, তবে তার প্রাণসংশয় অনিবার্য৷ পিতা ভয় পেলেন৷ অনুরোধ করলেন বালখিল্যমুনিগণকে৷ যদি তাঁরা এই বৃক্ষশাখা ছেড়ে অন্যত্র যান তবে তাতে অনেকের উপকার হবে৷ কারণ গরুড় লোকের মঙ্গলের জন্য এমন শাখা বহন করছে৷ নচেৎ এই শাখার ভারে বহু প্রাণ বিনষ্ট হবে৷ অন্যদিকে অমৃত আনার মতো গুরুতর কাজের ভারও রয়েছে, তার ওপর৷ বালখিল্যমুনিগণ কাশ্যপের সেই প্রার্থনায় সাড়া দিলেন৷ তাঁরা চলে যেতে গরুড় পিতা কাশ্যপের পরামর্শমতো দুর্গম বরফাবৃত এক পর্বত যা কিনা মনুষ্যজনের অগম্য, এমন স্থানে সেই শাখাটিকে নিয়ে গিয়ে ফেললেন৷ আর তারপর সেই পাহাড়ের চুড়োয় বসে গজকচ্ছপকে ভক্ষণ করলেন৷ বালখিল্যমুনিরাও রক্ষা পেলেন আর বৃহৎ উদ্দেশ্যে আগুয়ান গরুড়েরও আপাত ক্ষুন্নিবৃত্তি হল৷