বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌরভ চক্রবর্তী

বারান্দার ফুলের গাছ থেকে ফুল তুলতে খুবই ভালোবাসে ছোট্ট রুমি৷ কখনও কখনও মায়ের হাত থেকে জলের মগ নিয়ে গাছে জলও দেয়৷ মাকে গাছে জল দিতে দেখলেই বলে আমাকে দাও আমি টবে জল দেব৷ তুমি দেবে না জল, আমি দেব জল গাছে৷ ফুলটাও তুমি তু্লবে না, আমি তুলব৷ এইরকম ছোট ছোট নানা বায়না রুমির৷ মার পিছু পিছু ঘোরে আবার কখনও কখনও নিজের খেলনাপাতি নিয়ে একাই খেলা করে৷

সেদিন বারান্দা থেকে হঠাৎ রুমি চেঁচিয়ে ডাকল মা-কে৷
—মা মা, দেখবে এসো, বারান্দার ভাঙা টিনের বাক্সের ভিতরে দুটো ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা বিড়াল৷ ওরা ওর মার কোলে শুয়ে দুধ খাচ্ছে৷ দেখবে এসো মা, শিগগির এসো৷ রুমির ডাকে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন মা৷ দেখে সত্যি তো, বিড়ালটা দুটো বাচ্চা দিয়েছে৷ কবে দিল? বাচ্চাগুলোকে কখন নিয়ে এল আমাদের বাড়িতে?
মা রুমিকে বললেন, ওখানে বিড়ালের কাছে যেও না মা! মা-বিড়ালটা ওর বাচ্চাদের দুধ খাওয়াচ্ছে৷ তুমি যেন ওই ছোট্ট বিড়ালকে কখনও ধরতে যেও না৷ তাহলে ওর মা তোমাকে আঁচড়ে দেবে৷ তখন মহা বিপদ হবে৷ করোনার জন্য সব হাসপাতাল ডাক্তারখানা ব্যস্ত আছে৷

রুমি মার কথা শুনল ঠিকই, কিন্তু সুযোগ পেলেই বাচ্চা বিড়ালগুলোকে দেখতে যায়৷ মা-টা বাচ্চাদের কেমন করে দুধ খাওয়াচ্ছে, কেমন করে ওদের গা চেটে চেটে আদর করছে৷ এসব দেখতে রুমির ভীষণ ভালো লাগে৷
এখন খেলাধুলা, ফুল তোলা সবই মাথায় উঠেছে৷ সারাদিন ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ালগুলোর নড়াচড়া, দুধ খাওয়া এসব দেখে৷

কিছুদিনের মধ্যেই বাচ্চাদুটো একটু বড় হয়ে উঠেছে৷ একদিন রুমি দেখল মা-বিড়ালটা বাচ্চা দুটোর ঘাড় কামড়ে ধরে দরজার বাইরে নিয়ে চলে গেল৷ রুমি মাকে বলে, মা-বিড়াল বাচ্চাদুটোকে নিয়ে চলে গেল৷ কোথায় গেল ওরা৷ ওরা তো আমাদেরই পোষা বিড়াল৷ মা-বিড়ালটাকে আমরা তো খেতে দিই৷ তাহলে ও চলে গেল কেন? মা দেখলেন সত্যি তো বাচ্চা দুটো, মা কেউই নেই ওখানে৷ রুমির কদিন হল খুব মনখারাপ বাচ্চা দুটোর জন্য৷

ঠিক দুদিন পরে মা-বিড়ালটা বাচ্চা দুটোকে আবার মুখে করে নিয়ে সেই আগের জায়গায় এনে রাখল৷ বাচ্চা নিয়ে বিড়ালের আসা দেখে রুমি চেঁচিয়ে ডাকল মা মা, শিগগির এসো, মা-বিড়ালটা বাচ্চা দুটোকে নিয়ে আবার এসেছে ওই টিনের বাক্সটায়৷ রুমির ডাকে মা এসে দেখল ঠিকই৷ মা-বিড়াল বাচ্চাদুটোকে নিয়ে এসেছে৷ মা রুমিকে বলল, বিড়ালটা বাচ্চাদের রাখার মতো নিরাপদ জায়গা পায়নি তাই আবার আমাদের বারান্দাতেই এনে রেখেছে৷ নিশ্চিন্তে ওদের দুধ খাওয়াতে পারবে, ওদের নিয়ে থাকতে পারবে, তাই৷

ছবি : লেখিকা

রুমির কী আনন্দ! সারাদিন বারবার ওদের কাছে আসে আর হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখে মা-বিড়ালটা কেমন করে বাচ্চাদের পেটের তলায় নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে, জিব দিয়ে গা চেটে দিচ্ছে৷ হাত দিয়ে কাছে টেনে নিচ্ছে৷ একটা বাচ্চার চোখ দুটো বন্ধ দেখে রুমি মাকে বলল, মা ওই সাদা বাচ্চাটা কি অন্ধ হবে? ও কি দেখতে পাবে না কোনওদিন?

মা বললেন, না না, অন্ধ কেন হবে? ওর এখনও চোখ ফোটেনি৷ পনেরো দিন না হলে ওদের চোখ ফোটে না৷ রুমি বলল, অন্য বাচ্চাটার তো দুটো চোখই খুলেছে৷
মা বললেন, এই বাচ্চাটা একটু দুর্বল রোগা৷ তা ওর দেরি করে চোখ খুলবে৷

এইভাবে পাঁচ বছরের ছোট্ট রুমি এত ছোট বয়স থেকেই পশুদের আচরণ স্বভাব লক্ষ করতে থাকল৷ রুমির মতো সব শিশুদের হয়তো এত ছোট বয়সে বিড়াল বাচ্চা দেখার সুযোগ হয় না৷ কিন্তু রুমি এত বুদ্ধিমান আর মনোযোগী যে ও সব কিছু লক্ষ করে চলেছে বাচ্চাদুটো আসার পর থেকেই৷ জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে মার কাছে বারবার প্রশ্ন করে আর আগ্রহী হয়ে সব কিছু মন দিয়ে শোনে আর দেখে৷

বেশ কয়েকদিন মায়ের কাছে শুয়ে থাকার পরে বাচ্চা দুটো একটু বড় হয়ে উঠল৷ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রুমি দেখল বাচ্চা দুটো বারান্দায় নেমে এসে খেলা করছে৷ লাফাচ্ছে৷ দুজনে দুজনকে হাত দিয়ে আদর করছে৷ কিন্তু ওদের মা কোথায় গেল? মা-বিড়ালটা তো নেই! রুমি এবার চিন্তিত হয়ে মাকে ডাকল, মা মা, দেখো, বিড়াল বাচ্চা দুটো মাটিতে নেমে এসে খেলা করছে৷ রুমির মা দেখেন, তাই তো কী সুন্দর খেলা করছে ওরা৷ ওরা এখন বড় হয়ে গেছে৷ কিন্তু ওদেরকে তো হুলো বিড়াল খেয়ে নিতে পারে৷ মা তক্ষুনি ওদের তুলে বাক্সের মধ্যে রেখে দিয়ে ওদের গায়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললেন, অ্যাই যা, এখানে চুপটি করে বোস৷ তোর মা খাবার খেতে গেছে৷ এক্ষুনি চলে আসবে৷

রুমি মায়ের কথা শোনে আর হি হি করে হেসে ওঠে৷ আর একদিন রুমি বাচ্চাদুটোর কাছে এসে বলল, আয় আয়, ম্যাও আয়৷ অমনি বাচ্চা দুটো রুমির ডাকে সাড়া দিয়ে ওর দিকে চলে আসে৷ তারপর রুমির পায়ের উপর লাফিয়ে পড়ে৷ এমনি ভাবে কিছুদিনের মধ্যেই ওরা রুমিকে চিনে ফেলে, ওর সাথে খেলাও করে৷ তার মানে পুষির বাচ্চাদুটোর ভয় একদম কেটে গেছে৷ ওরা বুঝে গেছে এই বাড়ির কেউ ওদের কিছু করবে না৷ তাই রুমিকে ওদের বন্ধু করে নিয়েছে৷

মা বললেন, বাবাঃ, রুমি লকডাউনে ভালোই বন্ধু পেয়েছ তুমি! স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না, বাড়িতেই মনের মতো খেলার বন্ধু পেয়ে গেছ৷ একথা শুনে রুমির কী হাসি!

এমনি ভাবে বেশ কিছুদিন বাচ্চা দুটো রুমির সঙ্গে খেলা করতে করতে হাঁটা, লাফানো এসব শিখে গিয়েছিল৷ কী জোরে জোরে লাফাত৷ রুমির চেয়ে আগে দৌড়তে পারত৷ একদিন দুপুরে রুমির মা দেখে মা-বিড়ালটা কোথা থেকে একটা ছোট্ট ইঁদুর ধরে এনে তাকে মেরে দু’টুকরো করে বাচ্চাদুটোর মুখের কাছে দিয়েছে৷ বলেছে, এটা তোরা দু’জনে একা একা কামড়িয়ে খা৷ বাচ্চাদুটো ইঁদুরের মাংস ছোট্ট দাঁত দিয়ে একটু একটু করে খাচ্ছিল৷ আর মা-বিড়ালটা পাশে বসে চুপটি করে বাচ্চাদের ইঁদুর খাওয়া দেখছিল৷ একটা বিড়াল বাচ্চা ইঁদুরের পেটটা পা দিয়ে চেপে ধরে একটু একটু করে চিবোচ্ছে৷ চেষ্টা করছে মাংস খেতে৷ আর ওর মা মাঝে মাঝে নেংটিটাকে মুখের কাছে ঠেলে ঠেলে দিচ্ছিল৷ অন্য বাচ্চাটা খেতে পারছিল না, শুধু নেংটির পা-দুটো মুখে ঢুকিয়ে চিবোচ্ছিল৷
মা-বিড়ালটা কিন্তু একটুও নিজে মুখে দেয়নি৷ শুধু চেয়েছিল বাচ্চাদুটো কেমন করে খাচ্ছে সেইদিকে৷ মাঝে মাঝে ওদের দিকে ইঁদুরটাকে ঠেলে দিচ্ছিল৷ নিজে কিন্তু একটুও মুখে দেয়নি৷ এইভাবে অনেকক্ষণ বসে থেকে থেকে যখন ওরা আর খেতে পারল না, তখন বাকিটুকু টেনে নিয়ে মা-বিড়ালটা সেটা খেয়ে নিল৷ এইভাবে ওদের মা ওদেরকে ইঁদুর খাওয়া শেখাল৷

ছবি : লেখিকা

এসব দেখে রুমি বলল, মা, তুমি যেমন আমার থালার না-খাওয়া মাছগুলো খেয়ে নাও পুষির মা-টাও ওদের বাচ্চাদের না খেতে পারা ইঁদুরটাকে খেয়ে নিল৷ দেখে কী হাসি রুমির৷ সবাইকে ডেকে ডেকে বাচ্চা বিড়ালের ইঁদুর খাওয়া শেখানোর গল্প করে৷
দিনে দিনে বিড়ালের বাচ্চাদুটো রুমির খুব প্রিয় হয়ে উঠল৷ ওরা এখন রুমির কোলে ওঠে৷ ঘরে ঢুকে পড়ে, রুমির কাছে আসতে চায়৷

রুমিদের বাড়ির দক্ষিণ দিকের জানলার বাইরে অনেক বড় বড় গাছ, নিমগাছ, কাঁঠালগাছ আছে৷ সেই গাছের ডাল বেয়ে মাঝে মাঝে বেজিদের নামাওঠা করতে দেখা যায়৷ কখনও বেজি তার বাচ্চা নিয়েই ঘোরাঘুরি করে৷ একদিন রুমির মা হঠাৎ ঘরে ঢুকে দেখেন জানলা দিয়ে একটা মস্ত বড় বেজি ঢুকেছে৷ আর মা-বিড়ালটা বেজির মুখের সামনে দাঁড়িয়ে ওঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ আওয়াজ করছে৷ আর বেজিটা কুতকুত আওয়াজ করছে আর বিরাট লেজটা নাড়ছে৷ ও বাবা, সে যে কী ভয়ংকর দৃশ্য! বিড়ালটা বেজিটাকে একটুও নড়তে দিচ্ছে না৷ ওকে বলছে তুমি জানলা দিয়ে এক্ষুনি বেরোও৷ ওকে কোনও দিকে যেতে দিচ্ছে না৷ পাশ কাটিয়ে চলে গেলেই বাইরে বাচ্চা দুটোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের তুলে নিয়ে খেয়ে নেবে৷ সেটা মা-বিড়ালটা জানত, তাই বেজিকে এক পাও যেতে দিচ্ছিল না৷

রুমির মা এই দৃশ্য দেখে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে পিছন দিক থেকে দরজা বন্ধ করে দিল৷ তারপর বাচ্চাদুটোকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল৷ রুমিকে বলল, এ ঘরে চলে আয় মা৷ জানলা দিয়ে ওই ঘরে বেজি ঢুকেছে৷ বিড়াল-বাচ্চা খেতে এসেছে৷ ঘরে মা-বিড়ালের সঙ্গে বেজির খুব ঝগড়া হচ্ছে৷ গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনলাম৷ দুজনে একেবারে মুখোমুখি৷ ভয়ে রুমি মাকে জড়িয়ে ধরল৷ মা কী করবেন, একহাতে রুমিকে ধরে অন্য হাতে বিড়াল বাচ্চাদুটোকে কোলের মধ্যে চেপে ধরে অন্য ঘরে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল৷

এরপর রুমিকে আর পুষিদুটোকে ঘরে রেখে একটা লাঠি নিয়ে মা গেলেন বেজি তাড়াতে৷ বেজির দিকে যেই লাঠিটা তুলেছে মা অমনি বেজিটা ভয়ে ঝগড়া ছেড়ে জানলা দিয়ে পালিয়ে গেল৷ সে কী দৃশ্য! বিড়াল আর বেজির মুখোমুখি যুদ্ধ৷

এদিকে মা-বিড়ালটা বেরিয়ে দেখে ওর বাচ্চা দুটো নেই৷ তারপর তার সে কী কান্না! ম্যাঁও ম্যাঁও অ্যাঁ অ্যাঁ কীরকম একটা নতুন ধরনের আওয়াজ৷ শুনে রুমির মা বুঝতে পারলেন ও বাচ্চাদুটোর জন্য কাঁদছে৷ ভেবেছে বেজিটাই বুঝি চুরি করে বাচ্চাদুটোকে নিয়ে চলে গেছে৷ রুমির মা বিড়ালটাকে পাশের ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন৷ মা-বিড়ালটা বাচ্চা দুটোকে রুমির কোলে দেখতে পেয়ে কী যে শান্তি পেল বলার নয়৷ ও এসে রুমির ছোট্ট পায়ের উপর উলটে চিৎ হয়ে রুমিকে আদর করতে লাগল৷ ভয়ে রুমি ও বাবা গো বলে লাফিয়ে উঠল আর সেই সঙ্গে হাত থেকে একটা বাচ্চা পড়েও গেল মাটিতে৷ তাই দেখে মা-বিড়ালটা একটু দূরে সরে গেল আর বাচ্চাটাও হেঁটে হেঁটে ওর মায়ের কাছে চলে গেল৷ নিশ্চিন্তে বাচ্চাটাকে পেয়ে মা-বিড়ালটা কতরকম করে আদর করতে থাকল৷ রুমি তাই দেখে অন্য বাচ্চাটাকেও ওর মায়ের কাছে দিয়ে দিল৷

এসব দেখে রুমির মা কাছে এসে রুমিকে কোলে বসিয়ে বললেন আমার বাচ্চাটাকে আমি একটু আদর করি মা-বিড়ালের বাচ্চার মতন৷ রুমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলে সব মা-ই তাদের বাচ্চাদের এইরকম করে আদর করে তাই না মা? ঠিক তুমি যেমন আমাকে আদর করো, বিড়ালের মা-টাও ঠিক তেমন করেই আদর করছে৷ মা বললেন, হ্যাঁ মা, মা কথার মানেই হল আদর আর ভালোবাসা৷

* গল্প (Short Story) মায়ের আদর (Mayer Ador) : পৃথা বল (Pritha Bal), সাহিত্যিক

Skip to content