শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

‘কত শত ব্যঞ্জন যে নাহি লেখাজোখা
পরমান্ন পিষ্টক যে রান্ধিছে সনকা
ঘৃত পোয়া চন্দ্রপাইট আর দুগ্ধপুলি
আইল বড়া ভাজিলেক ঘৃতের মিশালি
জাতি পুলি, ক্ষীর পুলি, চিতলোটি আর
মনোহরা রান্ধিলেক অনেক প্রকার।’


সনকা সুন্দরীর পিঠে রাঁধার ইতিবৃত্ত যত প্রাচীনই হোক, মধ্যযুগের বাংলা কাব্য-সাহিত্যের আনাচকানাচ জুড়ে দ্বিজ বংশীদাসের মতো অনেক লেখকের আখ্যানেই বঙ্গরমণীর পিঠে গড়ার বৃত্তান্ত মধ্যযুগের দু-কূল ছাপিয়ে আধুনিক বঙ্গীয় সাহিত্যেও কিন্তু সমান গুরুত্বের সঙ্গেই আশ্রয় করে নিয়েছে। সুতরাং চাঁদ-পত্নীর এই বিশেষ রন্ধনশিল্পের নৈপুণ্য কিন্তু আজকের বাংলাকেও সমানভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম। পৌষ মাসের শেষদিন মকর সংক্রান্তি তিথি হিসাবে পরিচিত, পৌষের জমকালো শীতে ‘পৌষের ডাক’কে উপেক্ষা করার শক্তি কজন বাঙালিরই বা আছে? আর পৌষের ডাকের সঙ্গে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে সংক্রান্তির পিঠে-পার্বণ সেকথা আর আলাদা করে বলে দিতে হবে না। আজকের কর্পোরেট বাঙালির আর্বান সংস্কৃতিতে মিষ্টির দোকানে তৈরি রেডিমেড পিঠে যতই থাকুক বা স্বাস্থ্যসচেতনতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যতই বেকড পাটিসাপটা বা মাইক্রোওয়েভে তৈরি ওট মিল্কের পিঠের আবির্ভাব ঘটুক না কেন অবচেতনে কিন্তু কোথাও না কোথাও মা-দিদিমার হাতে কোটা নারকোল আর চালের গুঁড়োর মিশ্রণে তৈরি নারকেল পুরের দুধপুলি বা ভাপানো পাটিসাপটার স্বাদকে বাঙালি এখনও খুঁজে চলেছে। দিদিমার প্রাচীন অভ্যস্ত হাতে, বুড়ো হাড়ে পিঠে বানানোর সেই চিরন্তন চিত্রটি গত জন্মের ইতিহাস মনে হলেও সেই ইতিহাস আমাদেরই ইতিহাস, আমাদেরই গল্প। মনে পড়ে যায় ‘পথের পাঁচালী’র ইন্দির ঠাকরুনের কথা: ‘পৌষ-পার্বণের দিন ঐ ঢেঁকিশালে একমণ চাল কোটা হইত পৌষ-পিঠার জন্য। চোখ বুজিয়া ভাবিলে ইন্দির ঠাকুরণ সেসব দেখিতে পায় যে।’ এমন চিত্র যে আমাদের জীবনস্মৃতির পাতা ওলটালেও যথেষ্ট পাওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই, আর সেই পাতা ওলটানোর কাজ করতে গিয়েই কখনও কখনও মনে হয় নাকি যে বস্তুটিকে ঘিরে স্বাদে-আহ্লাদে এত স্মৃতি, এত আবেগ সেই বস্তুটির ইতিহাসটা ঠিক কেমন। আজ আমরা সেই কাজই মূলত করতে চলেছি। পিঠের স্বাদ তো সবারই অত্যন্ত পরিচিত কিন্তু পরিচয় আছে কি এই বস্তুটির ইতিহাসের সঙ্গে? কেমন করে এল এই পিঠে, কাদের হাত ধরেই বা বাঙালি অন্দরমহলে এত জনপ্রিয়তা লাভ করলেন ইনি?

চলতি কথায় যাকে আমরা বলে থাকি পিঠে সেই পিঠে কথাটি কিন্তু মূলত এসেছে ‘পিঠা’ এই শব্দটি থেকে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ বলছে চালের গুঁড়ো, নারকেলবাটা, গুড়, নারকেল সহযোগে তৈরি এই পিঠার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘পিষ্ট’ , যার থেকে থেকে এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘পিষ্টক ‘ এবং এই পিষ্টক থেকেই পিঠা বা পিঠের আগমন বাংলা শব্দকোষ ও বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে। ঠিক কোন সময় থেকে বাংলার খাদ্যসংস্কৃতিতে এর আগমন সন-তারিখ বিচার করে তা নির্দিষ্টভাবে বলা না গেলেও মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যগুলিতে এর বলে সবিস্তৃত উল্লেখ এবং ময়মনসিংহ গীতিকার মতো প্রসিদ্ধ কাব্যে এর নিদর্শন থেকে এইটুকু সন্দেহ থাকে না যে প্রাচীন মধ্যযুগের চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে বাংলায় পিঠের প্রচলন ছিল ব্যাপকভাবে। মোঘলদের সময়ে পিঠের মূল আবেদন কিন্তু ছিল স্বাদের থেকে বেশি নকশায়। কত ধরনের নকশার পিঠে হতে পারে এবং কত নিখুঁত হতে পারে সেই নকশা তার উপরেই নির্ধারিত হত ভালো পিঠের মূল্য। সুতরাং পিঠে যে কেবল রসনার তৃপ্তি নয়, শিল্পসত্তা প্রকাশেরও একটা বড় জায়গা তা ভালোই বোঝা যায় এই নিদর্শন থেকে। পিঠের ইতিহাসের সঙ্গে কিন্তু ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে লালমাটির গন্ধ। পুরুলিয়ার চাঁউড়ি বাঁউড়ি মকর আখানের দিনে তৈরি পিঠের স্বাদ এখনও সেই প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। পৌষ মাসের শেষ চারদিন হল পুরুলিয়ার পিঠা-পরবের দিন। টুসু পরবে প্রাচীন কুরামি’ জাতির কাছে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই পিঠে। কুরামিদের লোকজ সঙ্গীত অধিকাংশ কুরমালি সঙ্গীতেই পিঠের অনুষঙ্গ বারবার ফিরে আসে। বাঙালির অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পিঠে হল ‘পুলি পিঠা’ যে পিঠার নামকরণের পেছনে রয়েছে সংস্কৃত ‘পোলিকা’ শব্দের অবদান। এই পুলি পিঠে কিন্তু এসেছে ‘বাঁকা পিঠা’ বা ‘পুর পিঠা’ থেকে, যা বাঁউড়ির দিনে বাড়ির মহিলারা গোবরমাটি দিয়ে ঘর পরিষ্কার করে, ঢেঁকিতে চাল কুটে সেই অর্ধচন্দ্রাকার, ত্রিকোণাকার বা চতুষ্কোণ আকৃতিতে গড়ে তৈরি করে থাকেন। পাশাপাশি হাল ফ্যাশনের ‘চিকেন পাটিসাপটা’ও কিন্তু এই কুরমি জাতিরই দান। টুসু বিদায়ের দিন ওঁরা যে ‘মাস পিঠা’ বা ‘মাংস পিঠা’ বানিয়ে থাকেন তার থেকেই সম্ভবত আমাদের চিকেন পাটিসাপটা নব্যতর রূপ পরিগ্রহ করেছে।

পুলি পিঠের পাশাপাশি আরেকটি খুব পরিচিত পিঠের নাম হল ‘আশকে পিঠে’। রাঢ়ের পশ্চিমাঞ্চল যথা বাঁকুড়া, মানভূম, ব্যাঘ্রভূম অঞ্চলে জনপ্রিয় এই পিঠেকেই মনে করা হয় বাঙলার আদি পিঠে। সাধারণত চালের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি এই আশকে পিঠে এসেছে সংস্কৃত ‘আশিকা’ শব্দ থেকে। আশিকা অর্থাৎ বাঞ্ছিত, কীসের বাঞ্ছা বা কেনই বা এই বিশেষ পিঠের জন্য আকাঙ্ক্ষিত হয়ে থাকে মানুষ। লোকায়ত জনশ্রুতি অনুসারে নবান্নের ধান ওঠার পরে এই পিঠে দিয়েই প্রথম মকর সংক্রান্তির পিঠে রাঁধার কার্যকলাপ আরম্ভ হত তাই এই পিঠের সঙ্গে লক্ষ্মীর বা খাদ্যলক্ষ্মীর সম্পর্ক অচ্ছেদ্য হওয়ায় এই পিঠে সকলের বাঞ্ছিত। চ্যাটালো আকৃতির সরায় কুম্ভকারেরা এই পিঠে তৈরি করত বলে নদে জেলায় এবং বাংলার অন্যান্য স্থানে একে ‘সরা পিঠে’ও বলা হয়ে থাকে। আবার বাংলাদেশের জেলা ঢাকাতে একে বলা হয় ‘চিতুই পিঠে’।

বাঙালির নাড়ির সঙ্গে পিঠের যোগ অবিচ্ছেদ্য, তাই মানুষ এই যান্ত্রিক উন্নয়নের যুগে যতই ব্যস্ত হয়ে যাক না কেন পিঠের সঙ্গে তাদের প্রাণের বন্ধন চিরকাল অটুট থাকবে, চিরকালই তারা বলবেন—

‘আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর
গড়িতেছে পিঠে পুলি অশেষ প্রকার
বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ, কুটুমের মেলা
হায় হায় দেশাচার ধন্য তোর খেলা।’

Skip to content