বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী গিরিশচন্দ্র। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী গিরিশচন্দ্র ঘোষ-এর নাট্যজীবনের পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছেন অধ্যাপক অভিনেতা ড. শঙ্কর ঘোষ।
দিনটি ছিল ১৮৮৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর, রবিবার। এই দিনটি শুধু পেশাদারি রঙ্গমঞ্চ স্টার থিয়েটারের ইতিহাস নয়, সমগ্র পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছে। কারণ ওই দিনে স্টার থিয়েটারে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে এসেছেন প্রথমবার নাটক দেখতে। এই স্টার থিয়েটার হাতিবাগানের স্টার থিয়েটার নয়, এর ঠিকানা ছিল ৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিট। এর অস্তিত্ব এখন অবশ্য নেই। ঠাকুরের পায়ের ধুলোতে যেমন বঙ্গরঙ্গালয় চিরস্মরণীয় হয়ে উঠল, অপরদিকে সমাজজীবনে উপেক্ষিত অবহেলিত লাঞ্ছিত শিল্পীরা ঠাকুরের আশীর্বাদে ধন্য হয়েছিলেন। ঠাকুর প্রথম যে নাটকটি দেখছেন তার নাম চৈতন্যলীলা। নাটকটির রচয়িতা ও নির্দেশক গিরিশচন্দ্র ঘোষ। ঠাকুরের নাটক দেখতে আসার প্রথম দিনটির স্মৃতিচারণ করেছেন স্বয়ং গিরিশচন্দ্র; “স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলার অভিনয় হইতেছে আমি থিয়েটারে বাহিরের কম্পাউন্ডে বেড়াইতেছি। এমন সময় মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামক একজন ভক্ত আমায় বলিলেন পরমহংসদেব থিয়েটার দেখিতে আসিয়াছেন, তাহাকে বসিতে দাও ভালো নচেৎ টিকিট কিনিতেছি। আমি বলিলাম তাহার লাগিবে না কিন্তু অপরের টিকিট লাগিবে। এই বলিয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিতে অগ্রসর হইতেছি, দেখিলাম তিনি গাড়ি হইতে নামিয়া থিয়েটারের কম্পাউন্ড মধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন। আমি না নমস্কার করিতে করিতে তিনি অগ্রে নমস্কার করিলেন। আমি নমস্কার করিলাম। পুনর্বার তিনিও নমস্কার করিলেন। আমি আবার নমস্কার করিলাম। পুনর্বার তিনিও নমস্কার করিলেন। আমি ভাবিলাম এইরূপই তো দেখিতেছি চলিবে। আমি মনে মনে নমস্কার করিয়া তাহাকে উপরে লইয়া আসিয়া একটি বক্সে বসাইলাম ও একজন পাখাওয়ালা নিযুক্ত করিয়া দিয়া শরীরের অসুস্থতাবশত বাড়ি চলিয়া আসিলাম।”
বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে ঠাকুরের অভিনয় দেখার সময়সীমা মাত্র ৫ মাস ৫ দিনের। এইসব অভিনয়কে ক্রম অনুযায়ী সাজালে দাঁড়ায় ১৮৮৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর রবিবার প্রহ্লাদচরিত্র নাটক। ১৮৮৫ সালের ১০ জানুয়ারি শনিবার নিমাই সন্ন্যাস নাটক। ১৮৮৫ সালের ১৮ জানুয়ারি রবিবার দক্ষযজ্ঞ নাটক। ১৮৮৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দুটি নাটক বৃষকেতু আর বিবাহ বিভ্রাট। এর মধ্যে বিবাহ বিভ্রাট ছাড়া বাকি সব ক’টি নাটকের নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ। এইসব নাটকের মধ্যে ঠাকুর গিরিশচন্দ্রের অভিনয় দেখেছেন শুধুমাত্র একটি নাটকে, দক্ষযজ্ঞে। সেখানে গিরিশ অভিনয় করেছিলেন দক্ষের চরিত্রে।
গিরিশচন্দ্র রচিত নির্দেশিত নিমাই সন্ন্যাস অভিনয় রাতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। লাটু মহারাজের স্মৃতিকথা থেকে সে ঘটনার হদিশ পাওয়া যায়। মদ্যপ অবস্থায় গিরিশচন্দ্র ঠাকুরের কাছে আবদার করলেন, ‘তুমি আমার ছেলে হবে বল। এই জন্মে তো আর তোমার সেবা করতে পারলুম না, আমার ছেলে হলে তোমায় খুব সেবা করতে পারব। বল তুমি আমার ছেলে হবে?’ ঠাকুর বললে, ’আমি তোমার কেন ছেলে হতে যাবো গো?’ একথা শুনে গিরিশ উত্তেজিত হয়ে ঠাকুরকে অনেক গালিগালাজ করলেন। ঠাকুর যখন দক্ষিণেশ্বরে ফিরছেন তখন গিরিশ মাটিতে শুয়ে ঠাকুরকে বারবার প্রণাম করতে লাগলেন। গাড়িতে আসতে আসতে ঠাকুর বললেন, ‘মা ওর অপরাধ নিও না।’
আর একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল প্রহ্লাদচরিত্র নাটকের দিনেও। স্টার থিয়েটারে বক্সে ঠাকুর বসে আছেন। গিরিশের সঙ্গে কথা বলছেন ঠাকুর। বললেন, ‘বাহ তুমি বেশ লিখেছ৷’ গিরিশ উত্তরে বললেন, ‘মহাশয় ধারণা কই, শুধু লিখে গেছি।’ ঠাকুর বাধা দিয়ে বললেন, ‘না তোমার ধারণা আছে, সেই দিন তোমায় বললাম ভিতরে শক্তি না থাকলে চালচিত্র আঁকা যায় না।’ অভিনয় যে লোক শিক্ষার বাহন ঠাকুর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, এ ব্যাপারে তিনি গিরিশচন্দ্রকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। গিরিশ যখন ঠাকুরকে বলছেন, ‘মনে হয় থিয়েটারগুলো আর করা কেন’, ঠাকুর তখন বললেন, ‘না না ও থাক। ওতে লোকশিক্ষা হবে।’
একদিন নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গিরিশচন্দ্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ঠাকুর তার জবাবে বলেন, ‘ওর থাক আলাদা। যোগও আছে ভোগও আছে। যেমন রাবণের ভাব নাগকন্যা দেবকন্যা নেবে, রামচন্দ্রকেও লাভ করবে।’ ঠাকুরের অবতারত্বে বিশ্বাসী ছিলেন গিরিশচন্দ্র। সেকথা দৃঢ়তার সঙ্গে ভক্তদের কাছে প্রচার করে বেড়াতেন।
গিরিশচন্দ্রের বৃষকেতু নাট্যাভিনয়ের দিন ঠাকুর মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আচ্ছা গিরিশ ঘোষ যা বলছে তা কি সত্য ?’ মাস্টার জবাবে বললেন, ‘আজ্ঞা ঠিক কথা। না হলে সবার মনে লাগবে কেন?’ জনৈক ভক্ত মাতাল নট নাট্যকার গিরিশ সম্পর্কে ঠাকুরকে তির্যক মন্তব্য করে বলেন, ‘রসুন গোলা বাটি হাজার ধুলেও তার গন্ধ যায় না।’ কথাটা গিরিশের কানে গেল। ঠাকুরকে গিরিশ সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘রসুনের গন্ধ কি যাবে?’ ঠাকুর সস্নেহে বললেন, ‘যাবে।’ গিরিশ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘যাবে?’ ঠাকুর আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আগুন জ্বললে গন্ধ ফন্ধ সব পালিয়ে যায়। রসুনের বাটি পুড়িয়ে নিলে আর গন্ধ থাকে না। নতুন হাঁড়ি হয়ে যায়।’
ঠাকুরের এই আশীর্বাদ বিফলে যায়নি। তাই তো গিরিশচন্দ্র হয়ে উঠতে পেরেছিলেন নট, নাট্যকার, নির্দেশক, নাট্যমঞ্চের পরিপোষ্টা।…ক্রমশ
বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে ঠাকুরের অভিনয় দেখার সময়সীমা মাত্র ৫ মাস ৫ দিনের। এইসব অভিনয়কে ক্রম অনুযায়ী সাজালে দাঁড়ায় ১৮৮৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর রবিবার প্রহ্লাদচরিত্র নাটক। ১৮৮৫ সালের ১০ জানুয়ারি শনিবার নিমাই সন্ন্যাস নাটক। ১৮৮৫ সালের ১৮ জানুয়ারি রবিবার দক্ষযজ্ঞ নাটক। ১৮৮৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দুটি নাটক বৃষকেতু আর বিবাহ বিভ্রাট। এর মধ্যে বিবাহ বিভ্রাট ছাড়া বাকি সব ক’টি নাটকের নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ। এইসব নাটকের মধ্যে ঠাকুর গিরিশচন্দ্রের অভিনয় দেখেছেন শুধুমাত্র একটি নাটকে, দক্ষযজ্ঞে। সেখানে গিরিশ অভিনয় করেছিলেন দক্ষের চরিত্রে।
গিরিশচন্দ্র রচিত নির্দেশিত নিমাই সন্ন্যাস অভিনয় রাতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। লাটু মহারাজের স্মৃতিকথা থেকে সে ঘটনার হদিশ পাওয়া যায়। মদ্যপ অবস্থায় গিরিশচন্দ্র ঠাকুরের কাছে আবদার করলেন, ‘তুমি আমার ছেলে হবে বল। এই জন্মে তো আর তোমার সেবা করতে পারলুম না, আমার ছেলে হলে তোমায় খুব সেবা করতে পারব। বল তুমি আমার ছেলে হবে?’ ঠাকুর বললে, ’আমি তোমার কেন ছেলে হতে যাবো গো?’ একথা শুনে গিরিশ উত্তেজিত হয়ে ঠাকুরকে অনেক গালিগালাজ করলেন। ঠাকুর যখন দক্ষিণেশ্বরে ফিরছেন তখন গিরিশ মাটিতে শুয়ে ঠাকুরকে বারবার প্রণাম করতে লাগলেন। গাড়িতে আসতে আসতে ঠাকুর বললেন, ‘মা ওর অপরাধ নিও না।’
আর একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল প্রহ্লাদচরিত্র নাটকের দিনেও। স্টার থিয়েটারে বক্সে ঠাকুর বসে আছেন। গিরিশের সঙ্গে কথা বলছেন ঠাকুর। বললেন, ‘বাহ তুমি বেশ লিখেছ৷’ গিরিশ উত্তরে বললেন, ‘মহাশয় ধারণা কই, শুধু লিখে গেছি।’ ঠাকুর বাধা দিয়ে বললেন, ‘না তোমার ধারণা আছে, সেই দিন তোমায় বললাম ভিতরে শক্তি না থাকলে চালচিত্র আঁকা যায় না।’ অভিনয় যে লোক শিক্ষার বাহন ঠাকুর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, এ ব্যাপারে তিনি গিরিশচন্দ্রকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। গিরিশ যখন ঠাকুরকে বলছেন, ‘মনে হয় থিয়েটারগুলো আর করা কেন’, ঠাকুর তখন বললেন, ‘না না ও থাক। ওতে লোকশিক্ষা হবে।’
একদিন নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গিরিশচন্দ্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ঠাকুর তার জবাবে বলেন, ‘ওর থাক আলাদা। যোগও আছে ভোগও আছে। যেমন রাবণের ভাব নাগকন্যা দেবকন্যা নেবে, রামচন্দ্রকেও লাভ করবে।’ ঠাকুরের অবতারত্বে বিশ্বাসী ছিলেন গিরিশচন্দ্র। সেকথা দৃঢ়তার সঙ্গে ভক্তদের কাছে প্রচার করে বেড়াতেন।
গিরিশচন্দ্রের বৃষকেতু নাট্যাভিনয়ের দিন ঠাকুর মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আচ্ছা গিরিশ ঘোষ যা বলছে তা কি সত্য ?’ মাস্টার জবাবে বললেন, ‘আজ্ঞা ঠিক কথা। না হলে সবার মনে লাগবে কেন?’ জনৈক ভক্ত মাতাল নট নাট্যকার গিরিশ সম্পর্কে ঠাকুরকে তির্যক মন্তব্য করে বলেন, ‘রসুন গোলা বাটি হাজার ধুলেও তার গন্ধ যায় না।’ কথাটা গিরিশের কানে গেল। ঠাকুরকে গিরিশ সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘রসুনের গন্ধ কি যাবে?’ ঠাকুর সস্নেহে বললেন, ‘যাবে।’ গিরিশ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘যাবে?’ ঠাকুর আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আগুন জ্বললে গন্ধ ফন্ধ সব পালিয়ে যায়। রসুনের বাটি পুড়িয়ে নিলে আর গন্ধ থাকে না। নতুন হাঁড়ি হয়ে যায়।’
ঠাকুরের এই আশীর্বাদ বিফলে যায়নি। তাই তো গিরিশচন্দ্র হয়ে উঠতে পেরেছিলেন নট, নাট্যকার, নির্দেশক, নাট্যমঞ্চের পরিপোষ্টা।…ক্রমশ