রবিবার ২০ এপ্রিল, ২০২৫


মা সারদা।

শ্রীমার বাড়িতে সন্ধ্যের সময় ‘কাশীখণ্ড’ পাঠ হত। একবার পাঠের পর স্বামী অরূপানন্দ মা সারদার কাছে জানতে চান যে, কাশীতে মৃত্যু হলে সবারই কি মুক্তি হয়? শ্রীমা বলেন যে, শাস্ত্রে বলে ‘হয়’। অরূপানন্দ বলেন যে, ঠাকুর তো কাশীতে দেখেছিলেন, শিব তারকব্রহ্ম মন্ত্র দেন। তা শ্রীমা সেখানে কি দেখলেন। শুনে শ্রীমা বলেন, ‘কি জানি বাপু, আমি তো কিছু দেখিনি’।

অরূপানন্দ বললেন, ‘তোমার মুখে না শুনলে বিশ্বাস করি নে’। মা সারদা শুনে বললেন, ‘ঠাকুরকে বলব, ঠাকুর এ বিশ্বাস করতে চায় না, আমাকে কিছু দেখিয়ে দাও’। তখন অরূপানন্দ জানতে চান যে, মুসলমানরাজত্বে ভারতের নানা জায়গার মন্দির ধ্বংস হয়েছিল, এই যে এত অত্যাচার, তার তিনি কি করলেন? মা সারদা বললেন, ‘তাঁর অনন্ত ধৈর্য। এই যে তাঁর মাথায় ঘটি ঘটি জল ঢালছে দিনরাত, তাতেই বা তাঁর কি? আর শুকনো কাপড় দিয়ে ঢেকে পুজো কর, তাতেই বা তাঁর কি? তাঁর অসীম ধৈর্য’।
পরদিন সকালে খগেন মহারাজ শ্রীমাকে একই প্রশ্ন করলেন, ‘কাশীতে ঠাকুর এত সব দর্শন করেছিলেন, আপনি কি দেখলেন?’ তখন মা সারদা বললেন, ‘রাতে বিছানায় শুয়ে জেগে আছি, হঠাৎ দেখি যে বৃন্দাবনের শেঠের বাড়ির নারায়ণমূর্তি পাশে দাঁড়িয়ে। মূর্তির গলার ফুলের মালা পা পর্যন্ত ঝুলছে। আর ঠাকুর ওই মূর্তির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে। আমি মনে ভাবছি, ঠাকুর এখানে কি করে এলেন? বললুম, ও বিশ্বাস করতে চায় না। ঠাকুর বললেন, বিশ্বাস করবে বইকি, সব সত্য। অর্থাৎ কাশীতে মরণ হলে মুক্তি হয়। সেই নারায়ণমূর্তি আমাকে দুটি কথা বললেন। তার একটি এই যে, ঈশ্বরতত্ত্ব না করলে কি ত্ত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়? অপরটি মনে করতে পারছি না’।

খগেন মহারাজ জানতে চাইলেন যে, ঠাকুর কেন নারায়ণমূর্তির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে?। শ্রীমা বলেন যে, ও তাঁর ওইরকম ভাব ছিল, সকলের সামনে দীনতা। অরূপানন্দ সকালের পুজোর পর প্রসাদ আনতে গিয়ে আগের দিনের কথা মনে পড়ায় আবার শ্রীমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘বল, কাশীতে মলে মুক্তি হয় কিনা, কি দেখলে?’ শ্রীমা বললেন, ‘শাস্ত্রাদিতে আছে, আর এত লোক আসছে, মুক্তি হয়। তাঁর শরণাগত হলে যে তার মুক্তি হবে না তো হবে কি?’ অরূপানন্দ প্রশ্ন করেন যে, শরণাগত যে তার তো মুক্তি হবেই। যে শরণাগত নয়, ভক্ত নয়, বিধর্মী, এদের মুক্তি হবে কিনা? মা সারদা বললেন, ‘তাদেরও হবে। কাশী চৈতন্যময় স্থান। এখানে সব জীব চৈতন্যময়, পোকাটা, মাকড়টা পর্যন্ত। ভক্ত, অভক্ত, বিধর্মী, যে এখানে মরবে, কীটপতঙ্গ পর্যন্ত, তারই মুক্তি হবে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৩: মা সারদার সঙ্গে সরলাদেবীর কাশীভ্রমণ

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৯: আধুনিক যুগে দাবানলের ফলে বনদহনের সঙ্গে খাণ্ডব বনদহনের সাদৃশ্য আছে কী?

প্রসঙ্গত, কাশ্ ধাতু থেকে কাশী শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থই হল দীপ্তি, প্রকাশ। অরূপানন্দ শ্রীমার কথা শুনে বলেন, ‘সত্য বলছ?’ শ্রীমা বলেন যে, সত্য বইকি, নইলে আর স্থানমাহাত্ম্য কি? অরূপানন্দ তাঁর হাতে ধরা প্রসাদী মিষ্টির ওপর বসা মাছিটাকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই মাছিটারও?’ শ্রীমা বলেন, ‘হ্যাঁ, মাছিটারও হবে। এখানের সব চৈতন্যময় জীব। ভূদেব দুটো পায়রা নিতে চেয়েছিল, উপরে সিঁড়িতে কোথায় বাচ্চা হয়েছিল। আমি বললুম, ওরে না, না, এরা কাশীবাসী, এদের নিতে নেই’। তারপর, মা সারদা বলেন যে, বাঙালদেশের মেয়েছেলে সব দেখ গিয়ে বাঙালীটোলায়। এদের কি ঘরবাড়ি, আত্মীয়স্বজনের মায়া নেই? এরা সব কাশীলাভের জন্য এখানে এসেছে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৬: পরাগপাখি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১১: বিপদ যখন আসে

অরূপানন্দ জানতে চান যে, শ্রীমা বাঙালদের কেমন জ্ঞান দেখলেন। শ্রীমা বললেন যে, তাঁর দেশের লোকেদের জ্ঞান নেই। ‘এই রাধুর তাজপুরের শ্বশুরবাড়ির লোকদের এখানে বাড়ি আছে। তবু কাশীবাসের নামে ভয় পায়। মনে করে, বাড়িতে থাকলে যেন মরবে না’। অরূপানন্দ আবার সেই কাশীতে মুক্তির প্রশ্ন শ্রীমাকে করলে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আমি তোমার কাছে তেসত্য করতে পারব না। এক সত্যেই রক্ষে নেই, তা আবার তেসত্য, কাশীতে’। অরূপানন্দ শুনে হেসে শ্রীমাকে বলেন যে, দেখো, তার যেন কাশীতে মৃত্যু না হয়। ‘নাহলে আমিই বা কোথায়, আর তুমিই বা কোথায় থাকবে, দেখাই হবে না’। শ্রীমাও হেসে বলে ওঠেন, ‘কি বলে, আমার কাশী চাইনি’।

অরূপানন্দ তাঁকে বললেন যে, একটা প্রত্যক্ষ কিছু হলে তবে তো সত্য বিশ্বাস হয়? শুনে শ্রীমা বলেন, ‘তা মানুষ মহাজনদের কথা নেবে না তো কি করবে? মুনি ঋষিরা যা বলে গিয়েছেন, তা ছাড়া আর পথ কি?’ অরূপানন্দ তখন বললেন, ‘প্রত্যক্ষ যাঁরা করেছেন, তাঁদের কথা শুনব না তো কি করব? তাইতো তোমাকে জিজ্ঞাসা করি। তুমি বললে তবে তোমাকে ছাড়ব’। শ্রীমা বললেন যে, সে বিশ্বাস করলে বা না করলে তাতে তাঁর কি? শুকদেব তো ডেঁয়ো পিঁপড়ে। অনন্ত তিনি, তাঁর কি বুঝবে? তারপর বলেন, ‘ঠাকুর ছিলেন, তিনি একটি দেখা লোক, তিনি সব দেখেছেন, তিনি সব জানেন, তাঁর কথা বেদবাক্য। তাঁর কথা যদি বিশ্বাস না করবে তো কি করবে?’ অরূপানন্দ তখন বলেন যে, শাস্ত্রে তো নানা প্রকার কথা বলে। ‘এ বলছে এই, ও বলছে ওই, কার কথা নেব, তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করি’।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৬: সিলেটে দেখা মণিপুরী নাচ কবির নৃত্য ভাবনাকে উস্কে দিয়েছিল

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৪: গ্রীষ্মকালে আলাস্কা সত্যিই অচেনা এক দেশ

শ্রীমা শুনে বললেন, ‘তা বটে, পাঁজিতে বিশ আড়া জল লিখেছে, নেংরালে এক ফোঁটাও বেরোয় না। আর শাস্ত্রে অনেক বাজে কথাও ভরেছে। শাস্ত্রবিধি অত আর পারা যায় না। তিনি বলতেন যে, বৈধী ভক্তি, ভক্তিই নয়। কামারপুকুরে যখন ছিলুম, তখন সব লোকের ভয়ে হাতের বালা খুলে ফেললুম। এ ও বলছে, সে তা বলছে। আর ভাবতুম গঙ্গাহীন স্থানে কি করে থাকব, গঙ্গাস্নানে যাব মনে করলুম। আমার বরাবরই একটা গঙ্গাবাই ছিল। একদিন দেখি কি সামনের রাস্তা দিয়ে ঠাকুর আসছেন আগে আগে, ভূতির খালের দিক থেকে। পিছনে নরেন, বাবুরাম, রাখাল, সব ভক্তেরা, কত লোক। দেখি কি ঠাকুরের পা থেকে জলের ফোয়ারা ঢেউ খেলে আগে আগে আসছে এই জলের স্রোত। আমি ভাবলুম, দেখছি ইনিই তো সব, এঁর পাদপদ্ম থেকেই তো গঙ্গা। আমি তাড়াতাড়ি রঘুবীরের ঘরের পাশের জবাগাছ থেকে মুটো মুটো ফুল ছিঁড়ে এনে গঙ্গায় দিতে লাগলুম। তারপর ঠাকুর আমাকে বললেন, তুমি হাতের বালা ফেলো না। বৈষ্ণবতন্ত্র জান তো? আমি বললুম, বৈষ্ণবতন্ত্র কি? আমি তো কিছু জানি নে। তিনি বললেন, আজ বিকেলে গৌরমণি আসবে, তার কাছে শুনবে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৬: পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যাঁর জীবনের আকাশে কখনও শত্রুতার মেঘ জমেনি

সেদিনই বিকেলে গৌরদাসী এল। তার কাছে শুনলুম, ‘চিন্ময় স্বামী’। যোগেনমা কামারপুকুরে গেলে তাকে শ্রীমা এই ঘটনা বর্ণনা করে বলেছিলেন যে, ওই অশ্বত্থগাছের গোড়ায় ঠাকুর তখন দাঁড়িয়েছিলেন। শেষে দেখলেন, তিনি নরেনের দেহে মিলিয়ে গেলেন। তারপর তিনি যোগেনমাকে বললেন, ‘এইখানকার ধূলি নাও, প্রণাম কর’। এই কথা পরে স্বামীজীর কানে পৌঁছলে তিনি বলেছিলেন, ‘ঠাকুরের তাঁর দেহে প্রবেশের কথা তাঁকে বলা হয়নি’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content