
ছবি: সংগৃহীত।
১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ সিলেট সফরে যান। সিলেটের মাছিমপুরে তিনি মণিপুরী নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন। অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন, “তিনি দেখলেন মণিপুরী নাচের ভঙ্গি, বিন্যাস ও ছন্দ তাঁর নিজের গানের মেজাজের সঙ্গে ভালো মেলে। রবীন্দ্রনাথ নাচের সময় কোমর দোলানো, ঘাড় বেঁকানো, চোখ ঘোরানো ইত্যাদি কামোদ্দীপক অঙ্গভঙ্গি পছন্দ করতেন না। মণিপুরী নাচে এসব নেই।…”
সিলেটে এই মণিপুরী নৃত্য দেখার পরেই কবি শান্তিনিকেতনের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৃত্যের প্রচলনের কথা চিন্তা করেন বলে গবেষকগণ উল্লেখ করেছেন। সফর শেষে শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে তিনি ত্রিপুরা থেকে একজন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক পাঠাবার জন্য ত্রিপুরার রাজদরবারে অনুরোধ জানান। ত্রিপুরার সিংহাসনে তখন বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য। কবির অনুরোধে মণিপুরী রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহকে তখন শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সিলেট সফরের আগেও রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় মণিপুরী নৃত্য গীত উপভোগ করেছিলেন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্যের রাজত্বকালে কবি যখন প্রথমবার আগরতলা সফরে আসেন তখন তাঁর সম্মানে মণিপুরী নৃত্যগীতের আয়োজন হয়েছিল। এই সম্পর্কে ‘রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা’ গ্রন্হে রয়েছে, “কবির শুভাগমন উপলক্ষ্যে শহরের উপকণ্ঠস্হ পুরানো কুঞ্জবনের শৈলশিরে কবির সম্মানে বসন্তোৎসবের ও মণিপুরী নৃত্যগীতাদির মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান আয়োজিত হইল।”
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৫: রবীন্দ্রনাথ, মণিপুরী নৃত্য ও ত্রিপুরা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৩: মা সারদার সঙ্গে সরলাদেবীর কাশীভ্রমণ
বন্ধু রাজার আমন্ত্রণে কবি যখন প্রথম আগরতলায় আসেন তখন শহরটি নামেই রাজধানী। এমনকি আজকের আগরতলার অলঙ্কার উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদও তখন গড়ে উঠেনি। এর নির্মাণ কাজ চলছে মাত্র। রাজবাড়িকে ঘিরে শহরে উল্লেখযোগ্য রাস্তা মাত্র দুটি।শহরে প্রায় সবই কাঁচা বাড়ি। রাজবাড়ির পেছনে মণিপুরী পল্লী রাধানগর। বাইরে থেকে আগরতলা আসারও একটিই পথ। আসতে হতো মোগরা রেল স্টেশন (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে। নৌকায়, হাতির পিঠে কিংবা পাল্কীতে পাঁচ মাইল পথ পেরিয়ে আসতে হতো রাজধানীতে। তখনও গড়ে উঠেনি আখাউড়া রেলস্টেশন। হয়নি আখাউড়া সড়কও।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৯: আধুনিক যুগে দাবানলের ফলে বনদহনের সঙ্গে খাণ্ডব বনদহনের সাদৃশ্য আছে কী?

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৫: ঝোপ টিকরা
সেবার আগরতলায় কবির থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল কর্ণেল মহিম ঠাকুরের বাস ভবনে। কবি সম্বর্ধনায় এক মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে আয়োজন হয়েছিল মণিপুরী নৃত্যগীতের। শিল্পীদের গায়ে ছিল বাসন্তী রঙের কাপড়,মাথায় পাগড়িও ছিল বাসন্তী রঙের। এমনকি দর্শক স্ত্রী পুরুষ সবারই বাসন্তী রঙের পোশাক। খোল-করতাল আর কীর্তনের সুরের সঙ্গে নৃত্যের ছন্দে সেদিন সৃষ্টি হয়েছিল এক মোহময় পরিবেশ। কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন তা উপভোগ করে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম আগরতলা সফরকালে মণিপুরী নৃত্যগীত উপভোগ করলেও তখন হয়তো তিনি নৃত্য নিয়ে তেমন কিছুই ভাবেননি। অর্থাৎ নৃত্য ভাবনা কবিকে তখনও আলোড়িত করেনি।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪৭: চায়ের দেশের বিনি-মিনির কথা

হ্যালো বাবু! পর্ব-৭৭: গুগলি/১২
নাচের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ থাকলেও সম্ভবত তা পূর্ণতা পায় ১৯১৯ সালে সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরী নৃত্য দেখার পর। রবীন্দ্রনাথ এই সম্পর্কে বলেছেন, “চৌদ্দ পোনের বছর আগে যখন সিলেটে যাই তখন দেখেছিলাম মণিপুরী নাচ। সে নাচ আমার মনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সুদূর কল্পলোকে, মনে জেগেছিল নৃত্যনাট্যের পরিকল্পনা, সে যেন আমার মনকে পেয়ে বসেছিল। শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছাত্রীদের মণিপুরী নাচ দেখাবার উদ্দেশ্যে ১৩২৬ সন থেকে ১৩৩৬ সন এই দশ বছরের মধ্যে তিন তিনবারে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে সবশুদ্ধ ছয় জন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষককে আনিয়েছি শান্তিনিকেতনে। সম্প্রতি আছেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক নবকুমার। ‘নটরাজ’ অভিনয়ে প্রথম সংযজনা করলাম একটু অদল বদল করে মণিপুরী নাচ। মণিপুরী নৃত্যকেই ভিত্তি করে নৃত্যনাট্য গুলোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।নৃত্যনাট্যে যে বিশেষ রস সৃষ্টি করতে চাই তার পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী হচ্ছে মণিপুরী নাচ।”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১০: অন্ধকারে, চুপিসারে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’
সিলেট ভ্রমণ শেষে ত্রিপুরার রাজা বীরেন্দ্র কিশোরের আমন্ত্রণে কবি আগরতলায় আসেন। আগরতলার রাজপরিবারে মণিপুরী সংস্কৃতির প্রচলন সম্পর্কে কবি অবহিত ছিলেন আগেই। তিনি ১৮৯৯ সালেই এখানে মণিপুরী নৃত্যগীত উপভোগও করেছিলেন। বলা যায়, সিলেটে দেখা মণিপুরী নাচ কবির নৃত্য ভাবনাকে উস্কে দিয়েছিল। তিনি ত্রিপুরার কাছেই মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক চাইলেন। ত্রিপুরা থেকে শান্তিনিকেতনে পাঠানো হল মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক বুদ্ধিমন্ত সিংহকে। এ সম্পর্কে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ”বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হইলে শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের মধ্যে মণিপুরী নৃত্যাভ্যাস প্রবর্তনের চেষ্টা হইয়াছিল। ত্রিপুরা হইতে বুদ্ধিমন্ত সিংহ নামে এক শিল্পীকে পাওয়া যায়।…বালকরা বুদ্ধিমন্তের খোলের বোলের সঙ্গে নৃত্য শিক্ষা শুরু করে।” —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।