
মা সারদা।
আজ দুর্গাষ্টমী। শ্রীমায়ের চরণপুজোর জন্য তাঁর পায়ে ভক্তদের দেওয়া ফুলবেলপাতার স্তূপাকার হয়েছে। এমন সময়ে বহুদূর থেকে তাঁর কাছে তিনজন গরীব পুরুষ আর মহিলারা দর্শন করতে এসেছেন। তারা একবস্ত্রে ভিক্ষা করে টাকা জোগাড় করে পথের খরচ চালিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে একজন পুরুষভক্ত শ্রীমার সঙ্গে গোপনে কথা বলেই চলেছেন। এদিকে ঠাকুরের মধ্যাহ্ন ভোজনের বেলা বয়ে যাচ্ছে দেখে মা সারদার ভক্ত ছেলেরা বিরক্ত হচ্ছেন। একজন স্পষ্ট করে বলেই দিলেন যে, তার যা বলার আছে নিচে মহারাজদের কাছে গিয়ে বলতে।
শ্রীমা তখন দৃঢ়ভাবে বলেন যে, বেলা হলে কি হবে, ওদের কথাও শুনতে হবে। তিনি ধৈর্য ধরে শুনে পুরুষভক্তটির স্ত্রীকেও ডাকলেন। তারপর ধীরে ধীরে তাদের করণীয় আদেশ দিলেন। যা শুনে অনুমানে বোঝা গেল যে, ওরা স্বপ্নে মন্ত্র পেয়েছেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে তারা প্রসাদ নিয়ে গেলেন। শ্রীমা শুধু বললেন যে, আহা, বড় গরীব, কত কষ্ট করে এসেছে। তারপর ঠাকুরের বৈকালী ভোগ হলে সকলে প্রসাদ পেলেন। তখন চারটে বেজেছে। রাসবিহারী মহারাজ এসে জানালেন যে, একজন মেম এসেছেন শ্রীমার দর্শন করতে। তিনি নিচে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯১: গরীব-দুঃখী মানুষদের প্রতি শ্রীমার ছিল অসীম করুণা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৭: সুভদ্রাপুত্র অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র, কে বা কারা রইলেন পাদপ্রদীপের আলোয়?
শ্রীমা আসতে বলায় মেম এসে তাঁকে প্রণাম করতেই তিনি ‘এস’ বলে মেমের হাত ধরলেন, ঠিক যেন হ্যাণ্ডশেক করার মতন। শ্রীমা যে বলেন, যেখানে যেমন, সেখানে তেমন, সেটি সকলে আজ দেখতে পেলেন। এরপর মেয়েটির মুখে হাত বুলিয়ে আদর করলেন। মেম ভালোই বাংলা জানেন। তিনি বললেন, ‘আমি তো আসিয়া আপনার কোন অসুবিধা করি নাই? আমি অনেকক্ষণ হইল আসিয়াছি। আমি বড় কাতর হইয়াছি। আমার একটি মেয়ের কঠিন পীড়া হইয়াছে। তাই তো, আপনার করুণা ভিক্ষা করিতে আসিয়াছি। আপনি দয়া করিবেন, মেয়েটি যেন ভাল হয়। সে বড় ভালো মেয়ে, কারণ আমাদের মধ্যে স্ত্রীলোক বড়ই দুষ্ট। এ আমি সত্য বলিতেছি। এ মেয়েটি সেরূপ নহে। আপনি কৃপা করিবেন?’
আরও পড়ুন:

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা, পর্ব-৯: আকাশ এখনও মেঘলা

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-২৩: তিত্তিরজাতক: পাপ ও আত্মজিজ্ঞাসা
শ্রীমা বললেন, ‘আমি প্রার্থনা করব তোমার মেয়ের জন্যে, ভাল হবে‘। মেমটি শ্রীমার মুখে একথা শুনে এতোটাই আশ্বস্ত হলেন যে, বললেন, ‘আপনি যখন বলিতেছেন, তখন ভাল হইবেই, নিশ্চয়, নিশ্চয়, নিশ্চয়’। শ্রীমা তাঁর বিশ্বাস দেখে গোলাপমাকে বলেন যে, ঠাকুরের একটি ফুল তাকে দিতে, একটি পদ্ম দিতে। বেলপাতার সঙ্গে একটি পদ্ম এনে গোলাপমা শ্রীমার হাতে দিলে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৭: লুকাবো বলি, লুকাবো কোথায়?

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৩: সাত-সহেলি
শ্রীমা ফুলটি নিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে পরে ঠাকুরের ছবিতে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন। তারপর ফুলটি মেমের হাতে দিয়ে বলেন, ‘তোমার মেয়ের মাখায় বুলিয়ে দিও’। মেম হাতজোড় করে জানতে চান যে, এরপর কি করবেন। গোলাপমা তাঁকে বলেন যে, শুকিয়ে গেলে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে। মেমটি বলে উঠলেন, ‘না, না, এ ভগবানের জিনিস ফেলিয়া দিব! একটা নতুন কাপড়ের থলে বানিয়ে তাতে রেখে থলেটি মেয়ের মাথায়, গায়ে রোজ বুলাইয়া দিব’। শ্রীমা বললেন, ‘হ্যাঁ তাই করো’। এরপর মেম শ্রীমাকে তাঁর অনুভূতির কথা জানাল। তিনি বলেন যে, ঈশ্বর সত্য, তিনি আছেন। কিছুদিন আগে তাঁর একটি শিশুর জ্বর হওয়ায় ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫১: রোজই দেখি আলাস্কা পর্বতশৃঙ্গের বাঁ দিকের চূড়া থেকে সূর্য উঠতে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৭০: বিচারক
একদিন একটি রুমাল পেতে কাঁদতে কাঁদতে বলে বসেন, ‘হে ঈশ্বর, তুমি যে আছ তা তো বুঝিতে পারি, কিন্তু আমাকে প্রত্যক্ষ কিছু দাও। অনেকক্ষণ পরে দেখি সেই রুমালের ভাঁজের মধ্যে তিনটে কাঠি রয়েছে। অবাক হয়ে সেই কাঠি তিনটে লইয়া উঠিয়া আসিয়া শিশুটির গায়ে পরপর তিনবার বুলাইয়া দিলাম। সেইক্ষণে তাহার জ্বর ছাড়িয়া গেল’। একথা শ্রীমাকে বলতেই তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। এরপর তিনি বলেন, ‘আপনার অনেক সময় নষ্ট করিলাম, আমাকে মাফ করিবেন’। শ্রীমা বললেন, ‘না, না, তোমার সঙ্গে কথা বলে আমি ভারি খুশি, তুমি একদিন মঙ্গলবারে এস’। মেমটি শ্রীমাকে প্রণাম করে বিদায় নিলেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।