শনিবার ১৫ মার্চ, ২০২৫


রবীন্দ্রনাথ।

‘রাজর্ষি’, ‘বিসর্জন’-এর পর এবার ‘মুকুট’-এর কথায় আসা যাক। ত্রিপুরার ইতিহাস অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’ অমর মাণিক্যের রাজত্বকালকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। কিন্তু ‘মুকুট’-এ ইতিহাস কতটুকু রক্ষিত হয়েছে?
১২৯২ বঙ্গাব্দের বৈশাখে ‘বালক’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথ ‘মুকুট’ লিখতে শুরু করেন। জৈষ্ঠে দ্বিতীয় সংখ্যাতে ‘মুকুট’ গল্প শেষ হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি এর নাট্যরূপ দেন। ‘রাজর্ষি’কে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন এ তাঁর ‘স্বপ্নলব্ধ গল্প’, ‘মুকুট’-এর ক্ষেত্রে সে রকম আমাদের কিছু জানা নেই। মূলত মহারাজা অমর মাণিক্যের পুত্রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ঘিরেই এই গল্প। অর্থাৎ এটি পুরোপুরিই ইতিহাস আশ্রিত। তাই ‘মুকুট’-এ বর্ণিত উপাখ্যানে ইতিহাস কতটা সঠিক ভাবে রক্ষিত হয়েছে তা নিয়ে কিছুটা আলোচনা প্রয়োজন।
১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অমর মাণিক্য ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন। রাজ্যভার গ্রহণের পরই তিনি সামন্তপ্রভুদের উপর আধিপত্য কায়েম করেন। যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে তিনি শ্রীহট্ট, তরফ, ভুলুয়া জয় করেন। রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে যেমন সিংহাসনে অভিষেক হয়েছিল, তেমনই অমরের রাজত্বকালের প্রায় পুরোটাই ছিল যুদ্ধের উত্তেজনা আর অশান্তিতে পরিপূর্ণ। পুত্রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, মগ নৃপতির ছলচাতুরি, শ্যালকের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের চক্রান্ত মূলক অভিযোগ ঘিরে তাঁর মৃত্যুদণ্ড-নানা ভাবে অমরের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছিল তাঁর রাজত্বের শেষ পর্যায়ে। শেষপর্যন্ত ত্রিপুরার এই মাণিক্য রাজা আত্মহত্যা করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫২: ঠাকুর পরিবারের বালকদের অভিনয়ের সূত্রেই সৃষ্টি হয় ‘বিসর্জন’

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৯: তমসো মা জ্যোতির্গময়: গ্রীষ্মকালে আলাস্কায় রোজদিন

অমরের চারপুত্র-রাজদুর্লভ, রাজধর, অমরদুর্লভ ও যুঝার সিংহ। জ্যেষ্ঠ রাজদুর্লভ অসুস্থ হয়ে মারা গেলে দ্বিতীয় পুত্র রাজধরকে অমর যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ‘মুকুট’-এ কনিষ্ঠ পুত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন রাজধরকে।কিন্তু কনিষ্ঠ পুত্র হলেন যুঝার সিংহ। ‘মুকুট’-এ রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র হলেন যুবরাজ চন্দ্র নারায়ণ, দ্বিতীয় হলেন ইন্দ্রকুমার। অবশ্য অমর মাণিক্যের তিন পুত্রের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে তীব্র দ্বন্দ্ব ছিল। আরাকানরাজের সঙ্গে অমর মাণিক্যের যুদ্ধের বিষয়ে ত্রিপুরার সংশ্লিষ্ট ইতিহাসে রয়েছে যে, যুদ্ধে প্রথমে ত্রিপুরা সাফল্য পেলেও শেষপর্যন্ত আরাকানরাজ মাংফুলার কূট চালে ত্রিপুরার পরাজয় ঘটে।অমরের কনিষ্ঠ পুত্র যুঝার সিংহ নিহত হন এবং বহু সৈন্যও প্রাণ হারান এই যুদ্ধে। পুত্রকে হারিয়ে মহারাজা অমর মাণিক্য নিজে যুদ্ধাভিযান করেন। কিন্তু তখনই ত্রিপুরার করুণ পরাজয় ঘটে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৫: বনবাসে অর্জুনের অসংযত জীবন, আশ্রয়দাতার বিশ্বাসভঙ্গ কি অনুসরণযোগ্য আচরণ?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৯: উদ্বোধনের ঠাকুরঘরে মা সারদার সঙ্গে স্বামী অরূপানন্দের কথোপকথন

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অমর মাণিক্য পালিয়ে এসেও রক্ষা পাননি। তাঁকে সপরিবারে রাজধানী ত্যাগ করে অরণ্যে আশ্রয় নিতে হয়। আরাকানের সঙ্গে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ‘মুকুট’-এ রয়েছে—”…আমরা যে সময়ের গল্প বলিতেছি সে আজ প্রায় তিনশো বৎসরের কথা। তখন ত্রিপুরা স্বাধীন ছিল এবং চট্টগ্রাম ত্রিপুরার অধীন ছিল। আরাকান চট্টগ্রামের সংলগ্ন। আরাকানপতি মাঝে মাঝে চট্টগ্রাম আক্রমণ করিতেন। এই জন্য আরাকানের সঙ্গে ত্রিপুরার মাঝে মাঝে বিবাদ বাধিত। অমর মাণিক্যের সহিত আরাকানপতির সম্প্রতি সেই রূপ একটি বিবাদ বাধিয়াছে। যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখিয়া ইন্দ্রকুমার যুদ্ধে যাইবার প্রস্তাব করিয়াছেন। রাজা অনেক বিবেচনা করিয়া অবশেষে সম্মতি দিলেন। তিন ভাইয়ে পাঁচ হাজার করিয়া পনেরো হাজার সৈন্য লইয়া চট্টগ্রাম-অভিমুখে চলিলেন। ঈশা খাঁ সৈন্যাধ্যক্ষ হইয়া গেলেন।”
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯১: গো-শালিক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৮: দুর্গম গিরি কান্তার ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’

‘মুকুট’-এ বর্ণিত যুদ্ধের এই প্রেক্ষাপট মোটামুটি ত্রিপুরার ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সেই যুগে চট্টগ্রাম নিয়ে ত্রিপুরার সঙ্গে আরাকান রাজার বিবাদ প্রায়ই লেগে থাকত বলা যায়। কখনও আরাকানরাজ চট্টগ্রাম জয় করে নিতেন, কখনও ত্রিপুরা আবার তা ছিনিয়ে আনত। তবে সেবার চট্টগ্রাম যুদ্ধে সেনাপতি ছিলেন অমরের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজধর। চট্টগ্রাম যুদ্ধে ঈশা খাঁ সেনাপতি ছিলেন ত্রিপুরার ইতিহাসে এ রকম কোনও উল্লেখ নেই।

‘মুকুট’ গল্পে রয়েছে—”…আরাকানরাজ পরাজয় স্বীকার করিয়া সন্ধিপত্র লিখিয়া দিলেন। একটি হস্তিদন্ত-নির্মিত মুকুট, পাঁচশত মণিপুরী ঘোড়া ও তিনটে বড়ো হাতি উপহার দিলেন।” ত্রিপুরার সংশ্লিষ্ট ইতিহাসে রয়েছে মূলত এই যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হয় ত্রিপুরা শিবিরে চতুর আরাকানরাজ প্রেরিত একটি মুকুটকে কেন্দ্র করে। মণিমুক্তা খচিত হস্তিদন্তের অপূর্ব মুকুটটি নিয়ে অমর মাণিক্যের পুত্রদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ে ত্রিপুরার সৈন্যদের মধ্যেও। প্রভুদের কাণ্ড দেখে হতোদ্যম হয়ে পড়ে সৈন্যদল। এই সুযোগে আরাকানের সৈন্যরা ত্রিপুরার বাহিনীকে আকস্মিক ভাবে আক্রমণ করে। এরপর আর ত্রিপুরার বাহিনী ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।পরাজয় আর পরাজয়। এ প্রসঙ্গে কৈলাসচন্দ্র সিংহ তাঁর ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ গ্রন্হে লিখেছেন—”…একতাশূন্য হইয়া কুমারগণ যে কেবল চট্টগ্রামাদি হারাইয়াছিলেন এমন নহে,তাহাতেই ত্রিপুরার সর্বনাশের সূত্রপাত হইল। কুমারেরা সকলেই মুকুট গ্রহণ করিবেন বলিয়া পরস্পর বিরোধ করিতে লাগিলেন। আরাকানপতি এই সংবাদ শ্রবণে উপযুক্ত সময় বুঝিয়া পরমাহ্লাদিত চিত্তে ত্রিপুর সৈন্য আক্রমণ করেন।…”
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৬: নীল রাত্রি, নীল অন্ধকার

ইতিহাসের সঙ্গে কিছু কিছু অসঙ্গতি থাকলেও ‘মুকুট’ গল্পের মূল বক্তব্য যে ইতিহাসাশ্রিত সে ব্যাপারে কোনও দ্বিমত নেই। বিশেষত আরাকানরাজ প্রেরিত মুকুট প্রসঙ্গটি। ইতিহাসের পাশাপাশি ত্রিপুরা সহ সন্নিহিত পাহাড়ি অঞ্চলের এক নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘মুকুট’-এর ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদে রয়েছে-“…যুদ্ধের ক্ষেত্র পর্বতময়। সমুখাসমুখী দুই পাহাড়ের উপর দুই পক্ষের সৈন্য স্হাপিত হইয়াছে। উভয় পক্ষ যদি যুদ্ধ করিতে অগ্রসর হয় তবে মাঝের উপত্যকায় দুই সৈন্যের সংঘর্ষ উপস্থিত হইতে পারে। পর্বতের চারিদিকে হরীতকী,আমলকী শাল ও গাম্ভারীর বন। মাঝে মাঝে গ্রামবাসীদের শূন্য গৃহ পড়িয়া রহিয়াছে। তাহারা ঘর ছাড়িয়া পলাইয়াছে।মাঝে মাঝে শস্যক্ষেত্র। পাহাড়েরা সেখানে ধান কার্পাস তরমুজ আলু একত্রে রোপণ করিয়া গিয়াছে। আবার এক এক জায়গায় জুমিয়া চাষারা এক- একটা পাহাড় সমস্ত দগ্ধ করিয়া রাখিয়াছে,বর্ষার পর সেখানে শস্য বপন হইবে। দক্ষিণে কর্ণফুলি-বামে দুর্গম পর্বত।…” পাহাড়, জুম চাষ, জুম চাষের পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ের যথাসম্ভব উল্লেখ রয়েছে গল্পে। গল্পের পরিশিষ্টে রয়েছে-“বিজয়ী মগ সৈন্যেরা সমস্ত চট্টগ্রাম ত্রিপুরার নিকট হইতে কাড়িয়া লইল। ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর পর্যন্ত লুণ্ঠন করিল। অমর মাণিক্য দেও ঘাটে পালাইয়া গিয়া অপমানে আত্মহত্যা করিয়া মরিলেন।…রাজধর রাজা হইয়া কেবল তিন বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন—তিনি গোমতীর জলে ডুবিয়া মরেন।…”গল্পের এই পরিশিষ্টাংশও ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content