
সারদা দেবী।
শ্রীমা তখন কাশীতে রয়েছেন। স্বামী শান্তানন্দ তাঁকে বললেন যে, তাঁর তো সাধন, ভজনের শক্তি নেই। শ্রীমার চরণাশ্রিত তিনি। তখন শ্রীমা বললেন, ‘তোমার ভয় কি? ঠাকুর তোমার সন্ন্যাস রক্ষা করুন। ঠাকুরের কাজ ঠাকুর করবে আর তোমার সাধনভজন করবে। কাশী তোমাদের স্থান। সাধন মানে তাঁর চরণে মন সর্বদা রেখে তাঁর চিন্তায় ডুবে থাকা। সাধনের সময় নানা প্রলোভনের জিনিস দেখে ঠাকুর জড়সড় হতেন আর সে সব চাইতেন না। একদিন তিনি পঞ্চবটীতে বসে হঠাৎ দেখলেন যে, একটি ছেলে তাঁর কাছে এল। তিনি ভাবলেন, এ আবার কি হল? তখন স্বয়ং জগজ্জননী বুঝিয়ে দিলেন যে মানসপুত্ররূপে ব্রজের রাখাল আসবে। যখন রাখাল এল, তখন তিনি বললেন, এই আমার সেই রাখাল এসেছে। তিনি রাখালের নাম কি জানতে চাইলেন আর নাম শুনে বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক। যেমন পঞ্চবটীতে দেখেছিলেন ঠিক তেমনই’।
ঠাকুরকে একবার হাজরা বলেছিল, ‘আপনি কেন নরেন্দ্র, রাখাল, এদের জন্যে এতো ভাবেন? সর্বদা ঈশ্বরের ভাবে থাকুন না’। ঠাকুর বললেন, ‘এই দ্যাখ, ঈশ্বরের ভাবে থাকি’। তখন তাঁর এমন সমাধি হল যে দাড়ি, চুল, লোম সব খাড়া হয়ে উঠল। সেই অবস্থাতে ঘণ্টাখানেক ছিলেন। তখন রামলাল নানা ঠাকুরের নাম শোনাতে লাগল। শুনতে শুনতে ঠাকুরের চেতনা ফিরে এল। তাঁর সমাধি ভাঙলে বললেন, ‘দেখলি, ঈশ্বরের ভাবে থাকতে গেলে এই অবস্থা। তাই নরেন, এদের নিয়ে মনকে নীচে নামিয়ে রাখি’।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৯: বুলবুলি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৬: এক সন্ধ্যায় মা সারদার বলা ভূতের গল্প
রামলাল বললে, ‘না, আপনি আপনার ভাবেই থাকুন’। তারপর মা সারদা শান্তানন্দকে বললেন, ‘শেষরাতে মনে মনে ভাবলুম, বাবা বিশ্বনাথকে আর বুঝি দর্শন করতে পারব না। বিশ্বনাথের ছোট লিঙ্গমূর্তি আর যা সব জল, বেলপাতায় ডুবিয়ে রাখে, বাবাকে আর দেখতে পাওয়া যায় না। এমন সময় হঠাৎ দেখি কি কালো কুচকুচে পাথরের শিবলিঙ্গ বিশ্বনাথ! দেখি নটীর মা শিবের মাথায় হাত বুলুচ্ছে। আমিও তাড়াতাড়ি গিয়ে বাবার মাথায় হাত দিলুম’। শান্তানন্দ বললেন যে, তাঁদের আর পাথরের শিবলিঙ্গ ভালো লাগে না। শ্রীমা বললেন, ‘সে কি বাবা, কত মহা মহা পাপী কাশীতে আসছে আর বাবা বিশ্বনাথকে স্পর্শ করে উদ্ধার হচ্ছে। তিনি সকলের পাপ নির্বিকার ভাবে গ্রহণ করছেন’।
আরও পড়ুন:

ঈশ্বর কী সাড়া দেন তামিলে, সংস্কৃতে?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৪: খরগোশ ও কচ্ছপ
শান্তানন্দ বলেন যে, তিনি যদি সকলের বাবা,মা, তবে কেন পাপ করান। শ্রীমা বলেন যে, তিনি জীবজন্তু সবই হয়েছেন, তবে সংস্কার আর কর্ম অনুসারে সকলে নিজ নিজ কর্মের ফল ভোগ করে। সূর্য এক, কিন্তু জায়গা ও বস্তুভেদে তার প্রকাশ নানারকমের। কাশীতে এক সকালে কিরণবাবুর বাড়িতে স্বামী অরূপানন্দ শ্রীমাকে বললেন যে, বিশ্বনাথকে রোজ সব লোকে ছোঁয়, তাই সন্ধ্যের পর অভিষেক হয়ে তবে আরতি ও ভোগ হয়। শ্রীমা বলেন, ‘পাণ্ডাগুলো টাকার জন্য ওরূপ ছুঁতে দেয়। কেন ছুঁতে দেওয়া? দূর থেকে দর্শন করলেই তো হয়। যত লোকের পাপ এসে লাগে। তিনি আরও বলেন যে এক একজন লোক এমন আছে যে ছুঁলে সব শরীর গরম হয়, জ্বালা করে। তাই হাত, পা ধুয়ে ফেলতে হয়। এখানে তবু লোকের ভিড় কলকাতার চেয়ে কম’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৬: এক সন্ধ্যায় মা সারদার বলা ভূতের গল্প

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’
অরূপানন্দ বললেন যে, এখানে ভিড় কমানোর জন্য মহারাজদের অনুমতি নিয়ে এলে তবে দর্শন হয়। শুনে শ্রীমা বলেন, ‘হ্যাঁ কে এতো সাত জায়গায় দরবার দিয়ে আসতে চায়?’ পাগলী মামী এখানে এসেও শ্রীমাকে জ্বালাতন করছেন আর সেকথা তুলে তিনি বললেন, ‘হয়তো কাঁটাসুদ্ধ বেলপাতা শিবের মাথায় দিয়েছি, তাই আমার এই কণ্টক হয়েছে’। শুনে অরূপানন্দ বলেন যে, না জেনে দিলে দোষ কিসের? শ্রীমা বলেন, ‘না, না, শিবপূজা বড় কঠিন। ওতেও দোষ হয়। কি জান, যাদের শেষ জন্ম, তাদের কর্মগুলো সেই জন্মেই ভোগ হয়ে যায়। আমি তো জন্মাবধি কোন পাপ করেছি বলে মনে পড়ে না। পাঁচবছর বয়সে তাঁকে ছুঁয়েছি। আমি তখন না হয়, না বুঝি, তিনিও তো ছুঁয়েছেন। আমার কেন এতো জ্বালা? তাঁকে ছুঁয়ে অন্যে মায়ামুক্ত হচ্ছে আর আমারই কি এতো মায়া? আমার মন যে রাতদিন উঁচুতে উঠে থাকতে চায়, জোর করে তা আমি নীচে নামিয়ে রাখি, এদের জন্য দয়ায় আর আমার এতো জ্বালাতন?’
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০২: ভরতের মতো একমুখী লক্ষ্যে এগিয়ে চলা কী সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ
অরূপানন্দ বললেন, ‘মা, যতই করুক না কেন, সহ্য করে যাবে। মানুষ হুঁশে থাকলে রাগে না’। শ্রীমা বললেন, ‘ঠিক কথা বাবা, সহ্যের চেয়ে কিছুই নেই। তবে কি জান, রক্তমাংসের শরীর, হয়তো রেগেমেগে কিছু বলে ফেললুম’। তারপর আপনমনে বললেন যে, “যে সময়ে বলে সে বান্ধব। অসময়ে ‘আহা’ করলে কি হয়?”—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।