রবিবার ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মাতৃভাষা দিবস প্রতিবছর আসে যায়। যেমন দোল দুর্গাপুজো, পয়লা বৈশাখ, বড়দিন আসে, যায়। মেলা বসে, উঠে যায়। জন্মদিন আসে, ঝড় ওঠে, বৃষ্টি হয়, থেমে যায়। এসব হলে মানুষ আনন্দ করে বা বিচলিত হয়। আনন্দ হলে তাকে নিজের মতো করে প্রকাশ করে। কেউ খায়-দায়-গান গায়, কেউ নাচে, কেউ অন্যকে বিরক্ত করে, কেউ কেউ ঠিক বুঝতে পারে না যে করবে, বিহ্বল হয়ে কী কী যে করে তার ঠিক থাকে না। আবার বিচলিত হলে রাগ করে, ঈশ্বরকে দোষ দেয় নয়তো পাশের জনকে, ক্ষোভে প্রতিবাদ করে, দরকারে ভাঙে কিংবা বক্তৃতা দেয়। যা করে, ঠিক পরেই লাইনে অপেক্ষমান আনন্দের মাতামাতির জন্য যথেষ্ট সময় রেখে করে। এমনিতেই শোক বা খুশির মেয়াদ এখন অনেক কম, এককালের টেস্ট ক্রিকেট এখন টি টুয়েন্টি, কারণ সময় এখন কারও হাতেই বেশি নেই। তাই বাংলা ভালো কিংবা মন্দ হোক, কঠিন কিংবা তরল তাকে ছাড়াও অনেক অনেক কিছু ভাবার থাকে সারাবছর।
এছাড়াও সমস্যা আরও আছে। বাংলা ভাষা লোকাল ট্রেনের মতো। তাতে চড়ে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে বাধা আছে। বাধাটা মানসিক। বাংলায় সিরিয়াস ভালো কথা শুনতে আদিখ্যেতা মনে হয়, খিস্তি শুনলে কিন্তু রক্ত গরম হয়। বাংলায় গড়ে তোলা পরিভাষা শুনলে যারা মুখ টিপে হাসে, তারা ইংরেজি-মতে নাক সিঁটকোয়, হিন্দি মতে “কেন কি” ভেবে আকুল হয়, একদম পাক্কা হয়ে সব কিছু কনফার্ম করে, মস্তিতে বিন্দাস থাকে। কিন্তু বাংলায় হিসাব হিসেব হয়েছে, কায়দা, ফায়দা, পয়দা, কায়েম, চিড়িয়া, খাজনা, নজরানা ছিল, মন খুশ্ হতো, খুশি হতে কোনও সমস্যা ছিল না। যেটা ছিল না সেটা হল দৃষ্টিকটু বিকৃতি। এককালে জুজুতে যারা অভ্যস্থ ছিল, তারা এখন “জু”তে যায়। এই যাওয়া আসাতে জুজুটা জুড়িয়ে যাওয়া বর্গীহানার পাড়ায় বুলবুলি সেজে মস্তিতে মেতেছে। আর তা দেখে দিল জুড়োচ্ছে আম আদমির।
আরও পড়ুন:

আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৩: গ্রহের ফের

রেলস্টেশনে এখন ট্রেনের কামরাতে না উঠে ডিব্বাতে ওঠাই দস্তুর। এমনকী, দিব্যাঙ্গদের জন্য নির্দিষ্ট যে “দিব্যাং” কম্পার্টমেন্ট এসে দাঁড়াবে সেটা কী বস্তু তা বুঝতে গেলে অনেক কসরত্ করতেই হবে, পাক্কা। ভাষায় উচ্চারণ আর বানান এই দ্বিবিধ প্রকাশের ব্যাপারে উদাসীনতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে “কামরা” আর “কামড়া”র মধ্যে কীজাতীয় ব্যবধান আছে তা নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই। “গরগর” আর “গড়গড়” এক নয়, অথচ বলছে চারপাশের জনস্রোত। হয়তো ভুলটা বললেই একালে গুরুত্ব মেলে বেশি। মাতৃভাষাটা শিখিনি, শিখতে চাই না, মা-বাবারাই তাকে বিষবত্ ত্যাগ করতে চান এবং পুরো প্রক্রিয়াটাই বেশ শ্লাঘনীয়, উলঙ্গ রাজাও মনে করছিলেন মহার্ঘ্য বস্ত্রে তাঁর ক্যারিশ্মা বুঝি আর ধরছে না, কিন্তু হাওয়ায় দড়ি নড়লেই তা সাপ হয়ে ওঠে না।
আরও পড়ুন:

ঈশ্বর কী সাড়া দেন তামিলে, সংস্কৃতে?

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা/৫

লক্ষ্য করার মতো যে, এককালে অন্যভাষার স্বাভাবিক শব্দ বাংলায় তির্যক হয়ে প্রবেশ করেছে। “খুন” বাংলায় হলে অপঘাত, সামান্য হাত কাটলেই হিন্দি “খুন” ঝরে পড়বে। এছাড়া চুলের পরিচর্যা বললে যেমন বোঝাবে, হিন্দিভাষার সমার্থক শব্দটি এলেই ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটবে বাঙালির। অথচ, সেই একই শব্দে “বালক” বললে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, কিন্তু বাল-বাচ্চা নিয়ে গাড়িতে ওঠাটা যে সহযাত্রীর জন্য সুবিধার নয়, তার ভাবটুকু শব্দের গায়ে লেগে থাকে।

সামান্য প্রত্যয়, উপসর্গ, অনুসর্গ বদলে গেলে বক্তব্য বদলে যেতে পারে। বাংলায় গান গাওয়া যায়, অন্য ভাষায় নয়। বাংলার গান গাওয়া যায়, অন্য কোনো প্রদেশ বা জাতিসত্তার গান নয়। বাংলায় কথা বলা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ বাংলার, বাংলাভাষা কিংবা বঙ্গভূমির স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কথার পরিবেশন। এখানে একটি ভাষার সঙ্গে যুক্ত সমাজদর্শন ও রাজনীতি এক হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৬: এক সন্ধ্যায় মা সারদার বলা ভূতের গল্প

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’

মনে রেখো আর তবু মনে রেখোর মধ্যে যে বোধের সূক্ষ্মতা আছে তা নিয়ে ভেবে নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। অবশ্য, যে হাতে চায়ের কাপ কিংবা মোবাইল ফোন, সে হাতেই সময়কে ধরাতে চায় এ কেমন ভাষা? এমন ভাসা ভাসা ভাব নিয়ে বোঝা দায়। তাই বোঝা নামানোই ভালো। একারণেই অনেকদিন ধরে বাংলাটা ঠিক আসছে না। যাদের কাছে বিকল্প আছে বলে মনে হচ্ছে তাদের যেমন আসছে না, যাদের নেই তাদের-ও তাই। সমাজে যেন চারিয়ে গেছে বাংলা কোনও ভাষা নয়, যারা ভাবছিল এটা কীসে লাগে, খায় না মাথায় দেয়, তারা আজ একটা উত্তরে পৌঁছেছে। এটা আকারে প্রকারে তরল, এবং এটা খেতে হয়।

স্বাধীন দেশের ভাষাও মুক্ত। শব্দগুলো চৈত্রসেলে পাওয়া ছাড়ের আকর্ষণে ছুটছে কিংবা যেমন খুশি সাজো প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যে যেমন পারছে ই, ঈ, উ, ঊ-কে টেনে নিচ্ছে। স্কুল কলেজে পরীক্ষার খাতায় বাংলা ভাষার ব্যবচ্ছিন্ন শব পড়ে থাকে। নগরঢাকা বিজ্ঞাপনে টাঙানো থাকে বাংলা ভাষার জ্যান্ত লাশ। ইংরেজি-দীক্ষিত জনতা একে অপরকে ইং-বং টেক্সট করে জানতে চায় “কামান আছা”, কেমন আছো নাকি বিক্রির জন্য কামান আছে ভেবে দেখ মন! মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০২: ভরতের মতো একমুখী লক্ষ্যে এগিয়ে চলা কী সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ

আজকাল ভাষাশিক্ষার সঙ্গে বোধবুদ্ধির বিকাশের কোনও যোগ নেই। এখানে “লাভ ওঠানো” মুশকিল! তাই অন্যকিছুর শুরুয়াত্। তাছাড়া বাংলা ভাষায় আবার জানার শেখার আছেটা কী? বাঙালি মানেই বাংলা জানে। জানলেও জানে, না জানলেও জানে। গুগল ট্রান্সলেটারে ফেললেই কেমন বাংলা বেরিয়ে আসে গলগল করে। আরে বাবা! ওটাও ভাষা, যদি ডিজেওয়ালা ভাসান ভাবো ক্ষতি নেই, ফ্রি তে এর বেশি কী চাও? তাছাড়া, বাংলা বর্ণমালায় এতো এতো বর্ণের মধ্যে হাঁটু ভাঙা দ আর মকারের থেকে গুরুতর আর কিছু নেই। মাতৃভাষার শুরুতেই তো মকার। আর ভাষাটা দেখতে ওই দকারের মতো। দ শুধু মকারের আগে বসলে যদু মাস্টারের কথা মনে পড়ে। তাড়াতাড়ি ঝমাঝম রেলগাড়ি চড়ে শ্বশুরবাড়ি যেতে গিয়ে পা পিছলে আলুর দম। বাংলাটা ঠিক আসছে না আজকাল, আসার জন্য দরকারি দমটা পথ বদলে অন্যদিকে ছুটেছে। ফলে, দমটা পথের মাঝে উল্টে পড়ে বেবাক পাল্টে গেছে, বর্ণ দুটো পরস্পর স্থানবদল করে নিয়েছে। একেবারে, পাক্কা।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content