শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অবনীন্দ্রনাথের অগ্রজ গগনেন্দ্রনাথ। ছেলেবেলা থেকেই ছবি আঁকায় তাঁর ঝোঁক। বাবা গুণেন্দ্রনাথ ভালো ছবি আঁকতেন। ছেলেও ছবি আঁকা শিখুক, শিল্পী হোক, চেয়েছিলেন তিনি। তখন ‘ছোট্টটি’ অবনীন্দ্রনাথ। বাড়িতে পড়াশোনার জন্য মাস্টারমশায় যেমন আসতেন, তেমনই আসতেন ছবি-আঁকা শেখানোর মাস্টারমশায়। অল্প বয়সেই রপ্ত করেছিলেন ছবি-আঁকা। সেন্ট জেভিয়ার্সে তখন পড়েন, বালক বলাই ভালো, সেই বয়সেই ছবি এঁকে পুরস্কার পেয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ।
অন্য কারও সঙ্গে মেলানো যায় না। একেবারে অন্যরকম। আলাপ-পরিচয়ের পর সকলেই হয়ে পড়তেন গগনেন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ। অমোঘ আকর্ষণ, তাঁর টানেই সবাই জোড়াসাঁকোয় ছুটে ছুটে আসতেন। পদস্থ সাহেবরা অনেকেই ছিলেন তাঁর বন্ধুজন। গগনেন্দ্রনাথ ভারি মজার মানুষ ছিলেন। কত কিছু তাঁর মাথায় আসত। রবীন্দ্রনাথকে আমরা যে পোশাকে চিনি, সেই জোব্বা-টুপির আইডিয়া তো তাঁরই মাথায় প্রথম এসেছিল। ফটোগ্রাফির চর্চা করতেন। পশুপাখিদের খুব ভালোবাসতেন। কুকুর পোশার শখ ছিল। জাপানি কুকুর ছিল খুব পছন্দের। জাপান থেকে কুকুরও আনিয়েছিলেন। একটা নয়, দুটো কুকুর। লোমওলা, কানঝোলা—সে কুকুর বেশিদিন বাঁচেনি। এরপর গগনেন্দ্রনাথ আর কুকুর পোষেননি।

গগনেন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী। সঙ্গে দুই বোন।

অত বড় নামজাদা শিল্পী। ভিতরে একটা ‘শিশু’ লুকিয়ে ছিল। শিশুর সারল্য দিয়ে অনেক কিছু বিচার করতে গিয়ে বিপাকেও পড়েছেন। ছোটদের মতো ঘুড়ি ওড়াতে খুব ভালোবাসতেন। শখ ছিল খেলনা কেনার। খেলনা কিনতেন নিজের জন্য, বাড়ির ছোটদের জন্য। নিজের ছেলেমেয়েদের, ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের সবাইকে দিতেন খেলনা-উপহার। বাড়ির ছেলে-মেয়ের সংখ্যা সব মিলিয়ে খুব কম ছিল না। একেকজনকে একেকরকম খেলনা নয়, সবাইকে দিতেন একই রকম খেলনা। একই খেলনা এতগুলো জোগাড় করা সহজ কাজ ছিল না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১১: মৃণালিনীর মৃত্যুর পর বিবাহ-প্রস্তাবের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৭: সুন্দরবনের পাখি — ফিঙে

গগনেন্দ্রনাথ কোথা থেকে একবার আনলেন খেলনা প্রজাপতি। দম দিলে ডানা মেলে প্রজাপতি উড়তে থাকে, ঘুরতে থাকে। উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে ওই বুঝি চলে যায় দূর-আকাশে। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা প্রত্যেকেই একটা করে প্রজাপতি পেয়েছিল। প্রজাপতি পেয়ে সবাই তা নিয়ে বাগানের দিকে দৌড় দিয়েছিল। একসঙ্গে অত প্রজাপতির ওড়াওড়ি। সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য।

শহরের নামিদামি খেলনার দোকানে গগনেন্দ্রনাথের যাতায়াত ছিল। চোখ জুড়োনো, মন ভরানো খেলনা। বিলেত থেকে নতুন ধরনের খেলনা এলেই দোকানদাররা গগনেন্দ্রনাথের কাছে খবর পৌঁছে দিত। তাদের জানাই ছিল, গগনেন্দ্রনাথ এলে নিশ্চিত পছন্দ হবে। একবার মনে ধরলে, যত দাম চাওয়া যাক না কেন, তিনি ঠিক কিনে ফেলবেন। দোকানে এসেছিল দুটো মডেল-এরোপ্লেন। দেখামাত্র গগনেন্দ্রনাথের পছন্দ হয়ে গেল। কিনে নিয়ে এলেন বাড়িতে।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাড়িতে আনার পর ছোটোদের সঙ্গে শামিল হয়ে গগনেন্দ্রনাথ হইহই করে সেই এরোপ্লেন উড়িয়ে দিলেন আকাশে। বাগানে প্রচুর গাছপালা। গাছপালার ছড়ানো ডালপালা ভেদ করে এরোপ্লেন উড়বে কী করে! ফলে ধাক্কা লাগল, ডানা ভেঙে পড়ল মাটিতে। ধাক্কাটা খুব জোরালো ছিল না। তাই ডানা ভাঙলেও এরোপ্লেনের ব্যাপক ক্ষতি হয়নি। গগনেন্দ্রনাথ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন শখের সাধের এই প্লেন আর মেরামত করা যাবে না। খুঁটিয়ে দেখে আশ্বস্ত হলেন, তেমন মারাত্মকভাবে ভেঙে নষ্ট হয়ে যায়নি। দুশ্চিন্তা ধুয়েমুছে ভাঙা এরোপ্লেন নিয়ে গগনেন্দ্রনাথ গেলেন দোকানে। অনেক আশা নিয়ে এসেছিলেন। দোকানে পৌঁছে সেই আশা ভঙ্গ হল। দোকানদার স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিল, তারা নাকি সারাতে জানে না। নতুন কিনতে বলল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০২: অন্ধকারে কে?

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা

দোকানদার যাই বলে বলুক না কেন, গগনেন্দ্রনাথ এত সহজে ছাড়বেন না। ভাঙা এরোপ্লেন দুটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি, খোলাখুলি, কত রকমের কাণ্ডই না চলল। এটা খোলেন, ওটা খোলেন, কীভাবে তৈরি হয়েছে, কী এর কারিগরি, সব বোঝার চেষ্টা করেন। নিজের মতো করে ব্যাপারটা বোঝার পর গগনেন্দ্রনাথ মেলা জিনিসপত্র জোগাড় করলেন,কিনে আনলেন। যেভাবেই হোক এরোপ্লেন দুটোকে মেরামত করতেই হবে!

কত কী জোগাড় করেছিলেন! বাজার ঢুঁড়ে দোকান ঘুরে হালকা কাঠের কাঠি, মজবুত তার, দড়ি, শিরীষের আঠা, পার্চমেন্ট কাগজ, ছুরি, কাঁচি, বাটালি, করাত—সাতসতেরো কত কী! অনেক মাথা খাটিয়ে, বুদ্ধি খরচ করে শেষে গগনেন্দ্রনাথ নিজেই এরোপ্লেন দুটিকে মেরামত করে ফেললেন। ঠিক আগের মতোই প্লেন দুটো ডানা মেলে বাগানে উড়ল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

নাড়াঘাটা করতে গিয়ে অন্য বুদ্ধিও মাথায় এলো। অন্যরকমভাবে এরোপ্লেন তৈরি করতে চাইলেন গগনেন্দ্রনাথ। আরও কাঠ, কাগজ কিনে আনা হল। শুরু হল নিজের মতো করে এরোপ্লেন বানানো। সবগুলো না উড়লেও অনেকগুলো উড়ল। আবার কোনোটা একটুখানি উড়েই গোত্তা খেয়ে নিচে পড়ে গেল। নিজের হাতে এরোপ্লেন বানাতে গিয়ে এক অন্য ধরনের প্লেনও আবিষ্কার করে ফেললেন গগনেন্দ্রনাথ। ইঞ্জিনবিহীন প্লেন, যাকে বলে গ্লাইডার। সে এক মজার খেলনা, কত কসরত, শেষে তৈরি হয়ে গেল। দম দিতে হয় না। ছুঁড়ে দিলেই উড়তে থাকে। হাওয়া দিলে তো আর কথাই নেই। বেপরোয়াভাবে উড়তে থাকে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭১: ধর্মকার্যের জন্য টাকা জোগাড় করা আর সাদা কাপড়ে ময়লা লাগিয়ে ধোয়া, দুই-ই সমান

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৬: জীবন নিয়ে কৌতুক আর ‘যৌতুক’

গগনেন্দ্রনাথের তৈরি করা এই এরোপ্লেনকে বলে ‘গ্লাইডার’। সদ্য তৈরি গ্লাইডার নিয়ে এক কাণ্ডও ঘটে গেল। একটা গ্লাইডার একদিন সন্ধের মুখে বাগানে গিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। তখনো সন্ধে ঠিক হয়নি, আলো অবশ্য কমে এসেছে। গ্লাইডার-প্লেন ওড়ানো মাত্র কোথা থেকে এলো দমকা বাতাস। দমকা বাতাসে পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে থাকে সেই গ্লাইডার-প্লেন। উড়তে থাকে, উঠতে থাকে। উঠতে উঠতে বাগানের আমগাছও প্রায় ছাড়িয়ে যায়। বসে গিয়ে একেবারে মগডালে। কী করে গাইডার-প্লেন নামানো যায়! গগনেন্দ্রনাথ পড়লেন মহাবিপাকে। বাড়ির কাজের লোকেরা লগি নিয়ে এলো। গাছে উঠে অনেকে চেষ্টাও করল। তাদের চেষ্টার বাড়াবাড়ি দেখে গগনেন্দ্রনাথ বারণ করলেন, ‘ওভাবে খোঁচা দিস নে। ছিঁড়ে যাবে।’

গগনেন্দ্রনাথের আঁকা ছবি।

ধীরে ধীরে আলো আরও কমে আসে। পাখির ঝাঁক ডাকতে ডাকতে মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। এক দঙ্গল পাখি কোথা থেকে উড়ে এলো এ বাগানে। উড়ে গিয়ে পাতার ফাঁকে কোথায় হারিয়ে গেল। ডালে ডালে ওদের বাসা আছে। সারাদিন ঘোরাঘুরির পর তাদের নিশ্চিন্ত বিশ্রাম।

গগনেন্দ্রনাথের মন খারাপ হয়ে গেল। কত কষ্ট করে নতুন রকমের এই গাইডার-প্লেন বানিয়েছিলেন। এইভাবে তা নষ্ট হয়ে গেল, ভাবতে গিয়ে তাঁর আরও মন খারাপ হয়ে যায়। ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ঝিঁঝি ডাকে, জোনাকি উড়ে যায়। গগনেন্দ্রনাথ ঘরে ফিরে নিজের কাজে মন বসাতে চেষ্টা করেন। মন কি আর বসে! এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে, আমগাছের মগডালে আটকে যাচ্ছে, দৃশ্যটি বারবার ঘুরেফিরে মনে পড়ে যায়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০১: অর্জুন প্রমাণ করলেন, রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের কোনও স্থান নেই

ভাসাবে দোঁহারে

সকাল হতেই গগনেন্দ্রনাথ পায়ে পায়ে এগিয়ে যান দক্ষিণের বারান্দার দিকে। প্রতিদিনই সকালবেলা দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে বসেন তিনি। এটা রোজের রুটিন। ফুরফুরে বাতাস দেয়। পাখিরা ডাকাডাকি করে। বড় মনোরম লাগে। বারান্দায় এসে রোজের মতো চেয়ারে বসলেন। ঠিক তখনই নজরে পড়ে, চেয়ারের পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে সেই গ্লাইডার- প্লেন।

গগনেন্দ্রনাথের আহ্লাদ আর ধরে না। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাড়ির সবাইকে নাম ধরে ধরে ডাকতে থাকেন। ছোটরা পড়িমরি তখনই ছুটে আসে। ছুটে এসে তারাও অবাক। গগনেন্দ্রনাথের মনে পড়ে যায় সেই জাপানি কুকুরছানার কথা। মনে হয়, সেই জাপানি কুকুর ছানাই পায়ের কাছে এভাবে শুয়ে আছে।

গগনেন্দ্রনাথের আঁকা ছবি।

সকলেই বুঝতে পারেন আসল ব্যাপারটা কী। সমবেত ছোটদের বুঝিয়ে বলেন গগনেন্দ্রনাথ। রাতে নিশ্চিত ঝড় উঠেছিল। সেই ঝড়-বাতাসের দাপটে গাছের মাথা থেকে আলগা হয়ে গ্লাইডার-প্লেন উড়ে এসে পড়েছে দক্ষিণের বারান্দায়, ঠিক গগনেন্দ্রনাথের চেয়ারের কাছে। দেখে মনে হতেই পারে, পায়ের কাছে শুয়ে রয়েছে ছোট্ট একটি কুকুরছানা। সেই হারানো জাপানি কুকুর। হ্যাঁ গগনেন্দ্রনাথের তেমনই মনে হয়েছিল। গ্লাইডার-প্লেন ফিরে পেয়ে গগনেন্দ্রনাথের ভীষণ আনন্দ হয়েছিল ঠিকই, আবার মরে যাওয়া কুকুরছানার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় কষ্টও পেয়েছিলেন খুব।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content