
নচিকেতা অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছিল ব্যাপারটা। ছোট ছেলে, কিন্ত কী টনটনে জ্ঞান তার। অনুভূতির সূক্ষতায় বুঝে নিয়েছিল, এটা ভালো দেখায় না। ঋগ্বেদে দানের প্রশংসা করে এত কথা বলেছে, আর এখানে কী না এই! কী অন্যায় কথা। বুড়ো-হাবড়া কিছু বলদ আর গরু জুটিয়ে এনে দান করা হচ্ছে। ভিখারীকে অচল টাকা দেওয়ার মত। অথচ দেখ, এই গরু কেনার জন্য তো একটা অর্থের সংস্থান আছে। সেখান থেকে পয়সা বাঁচিয়ে শীর্ণকায় হাড় জিরজিরে তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা পশুগুলোকে দান করার অসহ্য একটা নাটক হবে এর পরে। গাছতলায় ওই যে দরিদ্র ব্রাহ্মণ দূর থেকে এসেছেন একটা দুগ্ধবতী গাভীর আশায়, এরকম আরও তো অনেকে আছেন। এটা তাদের সঙ্গে তঞ্চকতা ছাড়া আর কি? ওই ব্রাহ্মণ তাঁর অসুস্থ পুত্রের পথ্যের জন্য এই দান স্বীকার করতে এসেছেন। কবিরাজ বলে গিয়েছেন, যক্ষ্মা। মন্ত্র পড়ে বিশেষ কিছু হবে না। দু’বেলা খাঁটি দুধ খাওয়াতে হবে। ছেলেটা হয়ত তারই বয়সী বা….
বাজশ্রবা সেদিন খুব ব্যস্ত। রাশভারী লোক। সকলে তাঁর কথায় তটস্থ। শুধু ঠ্যাঁটা ছেলেটার কোনও ভয়ডর নেই। জ্বালিয়ে খেল আর কী। শিশু মনস্তত্ত্ব তিনিও খানিক বোঝেন। একেই আজ বিশ্বজিৎ যাগের শেষে দানানুষ্ঠান সম্পন্ন করার তাড়া, তার ওপর হতচ্ছাড়া ছেলেটা বলে কি, “আমায় কাকে দিচ্ছ?” ইচ্ছা করে দিই দু’ঘা, ইয়ার্কি হচ্ছে। আজকালকার ছেলেদের গুরুলঘু জ্ঞান নেই, এত বিরাট যজ্ঞ আর দান সম্পন্ন হচ্ছে, কে কী করছে কখন তার খেয়াল রাখতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত, আশ্রমের সকলে তাঁর কথা শোনে না সে তিনি বেশ বোঝেন। কলিযুগ আসন্ন আর কী। তার ওপর এই নচিকেতা সকাল থেকে ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছে। এর মধ্যেই দু দুবার বলেছে… “আমায় তবে কাকে দিচ্ছ গো?”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭১: ধর্মকার্যের জন্য টাকা জোগাড় করা আর সাদা কাপড়ে ময়লা লাগিয়ে ধোয়া, দুই-ই সমান

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৬: জীবন নিয়ে কৌতুক আর ‘যৌতুক’
একটা শীর্ণ গাভীর দড়ি খুলে হাতছানি দিয়ে ব্রাহ্মণকে ডাকা হল। বয়স হয়েছে মানুষটার। বিশ্বজিৎ যাগে ইনি প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। আশ্রমের সব ঋষি এসব করতে জানেন না। তাই আউটসোর্সিং করতে হয়। না হলে দানসামগ্রী আশ্রমেই থেকে যেত। এখন ঠ্যালা সামলাও। এতগুলো লোক বাইরে থেকে ডেকে এনে গচ্চা দেওয়া। বাজশ্রবা মুখে হাসি ধরে রেখে ব্রাহ্মণকে বললেন… “ভোঃ ব্রাহ্মণ! এই দান পরিগ্রহ করে আমাদের কৃতার্থ করুন।” বাজশ্রবা ঋষিসুলভ প্রশান্তি আর মুখে মিষ্টি হাসি ধরে রেখেছেন। হঠাৎ কোথা থেকে হতভাগা নচিকেতা এসে বলল…. “পিতা! আমাকে তাহলে কাকে দিচ্ছেন?” ওইটুকু ছোট ছেলের গলায় শ্লেষের সুরটুকু ধরতে পারলেন না প্রবাদপ্রতিম ঋষি। আবার? বারবার তিনবার। মাথায় আগুন জ্বলে উঠল তাঁর। বলে উঠলেন, “হতভাগা! তোকে যম কে দিলাম।”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০২: অন্ধকারে কে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১১: মৃণালিনীর মৃত্যুর পর বিবাহ-প্রস্তাবের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ
সূর্য কি নিবে এল? হাওয়ার গতি বাড়ল বুঝি খুব। প্রলয় আসবে নাকি? কখন মরণ আসে কে জানে, কালিদহের আকস্মিক ঝড়ের মতো…
সিদ্ধার্থ তাড়াতাড়ি পা চালালেন। বেলা ফুরিয়ে গিয়ে রাত নেমেছে অনেকক্ষণ, রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর এখন। দিনগুলো যেন জন্মের পর মরণ, পুনর্জন্ম, নিরবচ্ছিন্ন একেকটা দিবারাত্রির কাব্য। বেদ-বেদাঙ্গ দর্শন আর শাস্ত্র তিনি বহু পড়লেন এই বয়সেই। এই যজ্ঞকেন্দ্রিকতা আর নিঃশ্রেয়সের, আত্মসমর্পণের দার্শনিক উদ্ভাস মানুষকে কোন্ আত্মাহূতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে? কঠোপনিষদের নচিকেতার কাহিনি তো যজ্ঞের বিরুদ্ধেই যেন এক প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ। দান পূর্ণ, যথার্থ ও সফল না হলে তো যজ্ঞের ফল অধরা থেকে যায়? এই আড়ম্বরপূর্ণতার বাইরে বেরোতেই হবে, বাহ্যিক ও আন্তরিকভাবে। জীবনবোধকে করতে হবে সরল, জীবনাচরণ হবে আড়ম্বরবিহীন। পিতা শুদ্ধোদন এই সেদিনই এক বহুব্যয়সাধ্য যজ্ঞ সম্পাদন করলেন। এই অর্থ যদি মানবকল্যাণে ব্যয়িত হয় তা কি যথার্থ হয় না?
সিদ্ধার্থ তাড়াতাড়ি পা চালালেন। বেলা ফুরিয়ে গিয়ে রাত নেমেছে অনেকক্ষণ, রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর এখন। দিনগুলো যেন জন্মের পর মরণ, পুনর্জন্ম, নিরবচ্ছিন্ন একেকটা দিবারাত্রির কাব্য। বেদ-বেদাঙ্গ দর্শন আর শাস্ত্র তিনি বহু পড়লেন এই বয়সেই। এই যজ্ঞকেন্দ্রিকতা আর নিঃশ্রেয়সের, আত্মসমর্পণের দার্শনিক উদ্ভাস মানুষকে কোন্ আত্মাহূতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে? কঠোপনিষদের নচিকেতার কাহিনি তো যজ্ঞের বিরুদ্ধেই যেন এক প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ। দান পূর্ণ, যথার্থ ও সফল না হলে তো যজ্ঞের ফল অধরা থেকে যায়? এই আড়ম্বরপূর্ণতার বাইরে বেরোতেই হবে, বাহ্যিক ও আন্তরিকভাবে। জীবনবোধকে করতে হবে সরল, জীবনাচরণ হবে আড়ম্বরবিহীন। পিতা শুদ্ধোদন এই সেদিনই এক বহুব্যয়সাধ্য যজ্ঞ সম্পাদন করলেন। এই অর্থ যদি মানবকল্যাণে ব্যয়িত হয় তা কি যথার্থ হয় না?
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৭: সুন্দরবনের পাখি — ফিঙে

আকাশ এখনও মেঘলা/৪
সিদ্ধার্থের চোখে ঘোর লাগে। তাকে গৃহপাশে আর মোহে বদ্ধ করতে পিতা কী আপ্রাণ প্রয়াস করেছেন। জননী অষ্টপ্রহর শঙ্কিত থাকেন। কিন্তু এ ছেলে তো সংসারী নয় মোটেই। সিদ্ধার্থ বুঝতে পারেন না কেন জরাগ্রস্ত মানুষ আর মৃতদেহ তার চোখে সেদিন অলৌকিকভাবে ধরা দিল। তিনি তো জানেন পিতা কী তৎপরতায় তাঁর উপবনে যাওয়ার পথকে নিষ্কণ্টক করেছিলেন সেদিন। কিন্তু এভাবে কি জরা, ব্যাধি আর মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে? এমন কোনও গৃহ আছে যেখানে কোনওদিন মৃত্যুর পদপাত ঘটেনি?
সিদ্ধার্থ একবার ফিরে চাইলেন। ছন্দক, প্রাণপ্রিয় ছন্দক দৃষ্টিপথের বাইরে বিন্দুবত্ হতে হতে দিকচক্রবালে মিশে গেছে। যশোধরা… রাহুল… সিদ্ধার্থ মন শক্ত করলেন। একটা সত্যবোধ কিছুদিন তাঁর সত্তা ও ভবিষ্যৎকে গ্রাস করছে। অনিবার্য হয়ে উঠছে ক্রমে ক্রমে। জগত্ চিরদুঃখময়। জগৎ জুড়ে আনন্দপ্রবাহ অনুভূত হয় বটে, উপনিষদ বার্তা বহন করছে চির আনন্দের, কিন্তু জন্ম-মরণের নিরন্তর চক্রকে ছিন্ন করতে পারছে সাধারণ মানুষ? মুমুক্ষার বোধ কি এতই অনায়াসবোধ্য? বাস্তবের দুঃখরাজি, অন্নের প্রয়োজন, অন্নাভাবের হাহাকার, শোক ব্যাধি জরাই তো সারসত্য হয়ে ওঠে। বেদের ছত্রে ছত্রে তো অন্নের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা, জাগতিক ধনলাভের অভিপ্রায়, তাকে তুচ্ছ করে কোন পরমধনের ব্যঞ্জনা? জগত দুঃখময়, দুঃখের কারণ আছে…. কামনা আর মোহপাশ। দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায়? আছে। তার জন্য কিছু অনুশাসন অনুসরণ করতে হবে, করতে হবে অনুশীলন।
সিদ্ধার্থ একবার ফিরে চাইলেন। ছন্দক, প্রাণপ্রিয় ছন্দক দৃষ্টিপথের বাইরে বিন্দুবত্ হতে হতে দিকচক্রবালে মিশে গেছে। যশোধরা… রাহুল… সিদ্ধার্থ মন শক্ত করলেন। একটা সত্যবোধ কিছুদিন তাঁর সত্তা ও ভবিষ্যৎকে গ্রাস করছে। অনিবার্য হয়ে উঠছে ক্রমে ক্রমে। জগত্ চিরদুঃখময়। জগৎ জুড়ে আনন্দপ্রবাহ অনুভূত হয় বটে, উপনিষদ বার্তা বহন করছে চির আনন্দের, কিন্তু জন্ম-মরণের নিরন্তর চক্রকে ছিন্ন করতে পারছে সাধারণ মানুষ? মুমুক্ষার বোধ কি এতই অনায়াসবোধ্য? বাস্তবের দুঃখরাজি, অন্নের প্রয়োজন, অন্নাভাবের হাহাকার, শোক ব্যাধি জরাই তো সারসত্য হয়ে ওঠে। বেদের ছত্রে ছত্রে তো অন্নের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা, জাগতিক ধনলাভের অভিপ্রায়, তাকে তুচ্ছ করে কোন পরমধনের ব্যঞ্জনা? জগত দুঃখময়, দুঃখের কারণ আছে…. কামনা আর মোহপাশ। দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায়? আছে। তার জন্য কিছু অনুশাসন অনুসরণ করতে হবে, করতে হবে অনুশীলন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০১: অর্জুন প্রমাণ করলেন, রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের কোনও স্থান নেই

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৪: ‘…জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’, লরেন্স ও ফ্রিডা/২
সিদ্ধার্থ অনন্তে পা বাড়ালেন। জগতের আনন্দযজ্ঞে তাঁর ডাক এসেছে। যখন বৃহতের আহ্বান আসে, ক্ষুদ্র খড়কুটোর মত ভেসে যায়। মৃত্যুঞ্জয়ী নচিকেতা অন্ধ তমিস্রা ভেদ করে আলোকবৃত্তে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পশ্চাতে দূরবিসারী দিগন্ত, পূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্রালোক জগতকে পরিপ্লুত করছে। অমিতাভের অমিতবিত্ত নির্মল জ্যোতিতে জগত্ হয়েছিল প্লাবিত। নচিকেতার কিংবা সিদ্ধার্থের অমর কাহিনি যুগে যুগে কালসমুদ্রে আলোকযাত্রীদের বিশ্বলোক ও বৃহত্তর সত্যের সন্ধান দিয়েছে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।