
ছবি: প্রতীকী।
পঞ্চ পাণ্ডবের দাম্পত্যজীবনে একমাত্র ধর্মপত্নী দ্রৌপদী। পত্নীকে কেন্দ্র করে ভাইদের মধ্যে যাতে বিরোধ না হয় তাই, মহর্ষি নারদের নির্দেশে, তাঁরা স্থির করলেন, দ্রৌপদী এক বৎসর কাল এক একজন ভাইয়ের সঙ্গে বসবাস করবেন। সেই সময়ে অন্য কোন ভাই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন না। এ নিয়মের অন্যথা হলে, শাস্তি, বার বৎসরের ব্রহ্মচর্য ও বনবাস।
এই নিয়ম পারিবারিক জীবনে চলতে থাকল। পর্যায়ক্রমে পাঁচ স্বামীর সংসর্গে অসাধারণ তেজস্বিনী দ্রৌপদীর সময় অতিবাহিত হতে লাগল। পাঁচ ভাই যেমন দ্রৌপদীর সঙ্গসুখে আনন্দিত, তেমনই হস্তীসংসর্গে সরস্বতীনদীর মতো বীর স্বামীদের সঙ্গে পরমানন্দে রইলেন দ্রৌপদী। ধার্মিক মহান পাণ্ডবদের শাসনে কুরুদেশ দোষমুক্ত হয়ে ধনজনে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। দীর্ঘকাল পরে, এক ব্রাহ্মণের গোধন অপহরণ করল দস্যুরা।
ব্রাহ্মণ, পঞ্চ পাণ্ডবদের প্রতি ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি খাণ্ডবপ্রস্থে এসে তাঁর যত ক্ষোভ, উচ্চস্বরে ব্যক্ত করতে লাগলেন, ওহে পাণ্ডবগণ, কতগুলি অধম, নিষ্ঠুর, মূর্খ আপনাদের দেশ থেকে এসে বলপ্রয়োগ করে, গোধন হরণ করেছে। শমগুণান্বিত ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণের প্রদত্ত যজ্ঞের ঘৃতাদি হবি, কাক যদি নিয়ে যায় এবং শৃগাল, বাঘের শূন্য গুহায় উপদ্রব ঘটালে যেমন তাদের দুঃখ হয় তেমনই দুঃখ এই আমারও। দ্রব্যের ছয় ভাগ কর গ্রহণ করেন রাজা, অথচ তিনি রক্ষক নন, এমন রাজা সর্বলোকে পাপাচারী রাজারূপে অভিহিত হন। ধর্মকার্যের জন্যে রক্ষিত ব্রাহ্মণের ধন, চোর অপহরণ করে নষ্ট করছে। সুরক্ষাদানের জন্যে কাকুতি মিনতি করছি এই আমি, আপনি অস্ত্র ধারণ করুন।
এই নিয়ম পারিবারিক জীবনে চলতে থাকল। পর্যায়ক্রমে পাঁচ স্বামীর সংসর্গে অসাধারণ তেজস্বিনী দ্রৌপদীর সময় অতিবাহিত হতে লাগল। পাঁচ ভাই যেমন দ্রৌপদীর সঙ্গসুখে আনন্দিত, তেমনই হস্তীসংসর্গে সরস্বতীনদীর মতো বীর স্বামীদের সঙ্গে পরমানন্দে রইলেন দ্রৌপদী। ধার্মিক মহান পাণ্ডবদের শাসনে কুরুদেশ দোষমুক্ত হয়ে ধনজনে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। দীর্ঘকাল পরে, এক ব্রাহ্মণের গোধন অপহরণ করল দস্যুরা।
ব্রাহ্মণ, পঞ্চ পাণ্ডবদের প্রতি ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি খাণ্ডবপ্রস্থে এসে তাঁর যত ক্ষোভ, উচ্চস্বরে ব্যক্ত করতে লাগলেন, ওহে পাণ্ডবগণ, কতগুলি অধম, নিষ্ঠুর, মূর্খ আপনাদের দেশ থেকে এসে বলপ্রয়োগ করে, গোধন হরণ করেছে। শমগুণান্বিত ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণের প্রদত্ত যজ্ঞের ঘৃতাদি হবি, কাক যদি নিয়ে যায় এবং শৃগাল, বাঘের শূন্য গুহায় উপদ্রব ঘটালে যেমন তাদের দুঃখ হয় তেমনই দুঃখ এই আমারও। দ্রব্যের ছয় ভাগ কর গ্রহণ করেন রাজা, অথচ তিনি রক্ষক নন, এমন রাজা সর্বলোকে পাপাচারী রাজারূপে অভিহিত হন। ধর্মকার্যের জন্যে রক্ষিত ব্রাহ্মণের ধন, চোর অপহরণ করে নষ্ট করছে। সুরক্ষাদানের জন্যে কাকুতি মিনতি করছি এই আমি, আপনি অস্ত্র ধারণ করুন।
নিকটে ছিলেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন।মহাবীর অর্জুন,ব্রাহ্মণকে আশ্বস্ত করলেন, শ্রুত্বৈব চ মহাবাহুর্মা ভৈরিত্যাহ আপনি ভীত হবেন না। এদিকে, অস্ত্র অর্জুনের নাগালের বাইরে রয়েছে। অস্ত্রাগারে রয়েছেন দ্রৌপদী ও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। নিয়মানুসারে সেখানে অর্জুনের প্রবেশ ও প্রস্থানে নিষেধ রয়েছে। সেই আর্তের বার বার কাকুতিমিনতিতে, বিচলিত হলেন অর্জুন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে, দুঃখিত মনে চিন্তা করলেন। অর্জুন যুক্তি দিয়ে বিচার করলেন, দস্যুরা তপস্বী ব্রাহ্মণের ধন অপহরণ করছে। ব্রাহ্মণের অশ্রুজল মুছিয়ে দেওয়া যে আমাদের নিশ্চিতরূপে কর্তব্য। দ্বারে কাঁদছেন একজন অথচ তাঁর রক্ষণাবেক্ষণের কোনও উদ্যোগ নিচ্ছেন না রাজা। রাজারা যদি কর্তব্য উপেক্ষা করেন তবে সেটি মহা অধর্ম বলে পরিগণিত হয়। এই রক্ষা না করার ফলে পাণ্ডবরা নাস্তিক নামে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবেন এবং অধর্ম হবে। রাজাকে অগ্রাহ্য করে যদি অর্জুন সেই ঘরে প্রবেশ করেন তবে, নিঃসন্দেহে অজাতশত্রু রাজা যুধিষ্ঠির ও অর্জুনের একযোগে মিথ্যাচার করা হবে। রাজা যুধিষ্ঠিরের ঘরে প্রবেশ করলে অর্জুনের বনবাস নিশ্চিত। অর্জুন ভাবলেন, রাজার অবজ্ঞা ছাড়া আর সব কিছুই তাঁর কাছে তুচ্ছ। শেষ পর্যন্ত স্থির করলেন, রাজাকে অবজ্ঞাহেতু আমার মহা অধর্ম হতেই পারে,বনে মরণ বরং ভালো। অধর্ম্মো বৈ মহানন্তু বনে বা মরণং মম।শরীরস্য বিনাশের ধর্ম্ম এবং বিশিষ্ট তে।। শরীর বিনাশশীল, কিন্তু ধর্মের স্থান হল বিশিষ্ট। এই নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে, কৌন্তেয় ধনঞ্জয় অর্জুন সেই ঘরটিতে প্রবেশ করে রাজার অনুমতি নিলেন। সন্তুষ্টচিত্তে ধনুক নিয়ে ব্রাহ্মণকে বললেন, ব্রাহ্মণাগম্যতাং শীঘ্রং যাবৎ পরধনৈষিণঃ।। ন দূরে তে গতাঃ ক্ষুদ্রাস্তাবদ্গচ্ছাবহে সহ। যাবন্নিবর্ত্তয়াম্যদ্য চৌরহস্তাদ্ধনং তব।।
ব্রাহ্মণ আপনি দ্রুত আসুন। এতক্ষণ নিশ্চয়ই পরার্থলোভী, ছোটলোকগুলি বেশি দূর যায়নি, আমার দু’জনে একসঙ্গে যাই, ধেয়ে গিয়ে চোরের হাত থেকে আপনার ধন উদ্ধার করি। মহাবাহু,রথারূঢ়, অর্জুন, ধনু ও বর্ম ধারণ করে, তীর দিয়ে চোরগুলিকে উৎপীড়ন করে, ধন জয় করলেন এবং ব্রাহ্মণকে তাঁর ধন উপহার দিয়ে, যশ লাভ করলেন। অভিযান থেকে নগরে ফিরে পার্থ অর্জুন ব্রাহ্মণকে গোধন দান করলেন। সব্যসাচী, ধনঞ্জয় অর্জুন গুরুজনদের অভিবাদন করে অভিনন্দিত হলেন। অর্জুন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, হে প্রভু, আমার প্রায়শ্চিত্তের বিধিবিষয়ে আদেশ করুন। আপনার সঙ্গে অসময়ে সাক্ষাৎ করে, আমি (নারদকৃত) নিয়ম লঙ্ঘন করেছি। আমি বনবাসেই যাব। কারণ আমরা এমন নিয়মই করেছিলাম ধর্ম্মরাজমুবাচেদং ব্রতমাদিশ মে প্রভো!। সময়ঃ সমতিক্রান্তো ভবৎসন্দর্শনে ময়া।। বনবাসং গমিষ্যামি সময়ো হ্যেষ নঃ কৃতঃ।
ব্রাহ্মণ আপনি দ্রুত আসুন। এতক্ষণ নিশ্চয়ই পরার্থলোভী, ছোটলোকগুলি বেশি দূর যায়নি, আমার দু’জনে একসঙ্গে যাই, ধেয়ে গিয়ে চোরের হাত থেকে আপনার ধন উদ্ধার করি। মহাবাহু,রথারূঢ়, অর্জুন, ধনু ও বর্ম ধারণ করে, তীর দিয়ে চোরগুলিকে উৎপীড়ন করে, ধন জয় করলেন এবং ব্রাহ্মণকে তাঁর ধন উপহার দিয়ে, যশ লাভ করলেন। অভিযান থেকে নগরে ফিরে পার্থ অর্জুন ব্রাহ্মণকে গোধন দান করলেন। সব্যসাচী, ধনঞ্জয় অর্জুন গুরুজনদের অভিবাদন করে অভিনন্দিত হলেন। অর্জুন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, হে প্রভু, আমার প্রায়শ্চিত্তের বিধিবিষয়ে আদেশ করুন। আপনার সঙ্গে অসময়ে সাক্ষাৎ করে, আমি (নারদকৃত) নিয়ম লঙ্ঘন করেছি। আমি বনবাসেই যাব। কারণ আমরা এমন নিয়মই করেছিলাম ধর্ম্মরাজমুবাচেদং ব্রতমাদিশ মে প্রভো!। সময়ঃ সমতিক্রান্তো ভবৎসন্দর্শনে ময়া।। বনবাসং গমিষ্যামি সময়ো হ্যেষ নঃ কৃতঃ।
আরও পড়ুন:

পরানের কোথা সে বিরাজে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০০: সন্দেহের তীরবিদ্ধ ভরতদের আজও খুঁজে পাওয়া যায়
হঠাৎ এই অপ্রিয় কথা শুনে শোকার্ত, কাতর, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে, নিদ্রাজয়ী ধার্মিক ভাই অর্জুনকে বললেন, যদি অর্জুন, জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের বচনে মান্য করে প্রমাণরূপে গ্রহণ করেন, তবে, নিষ্পাপ অর্জুন, যুধিষ্ঠিরের বচনে যেন গুরুত্ব দেন। সেটি হল, যুধিষ্ঠিরের ঘরে অসময়ে প্রবেশ করে অর্জুন যে অপ্রিয় কাজটি করেছেন, সে সব যুধিষ্ঠির অবগত আছেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির,অন্তর থেকে সে কাজ, অপ্রিয়রূপে গ্রহণ করেননি। যুধিষ্ঠিরের মতে, গুরুজনের ঘরে কনিষ্ঠর প্রবেশে, নিয়মলঙ্ঘন হয় না।কনিষ্ঠের ঘরে জ্যেষ্ঠর প্রবেশে, নিয়ম লঙ্ঘিত হয়ে থাকে। গুরোরনুপ্রবেশো হি নোপঘাতো যবীয়সঃ। যবীয়সোঽনুপ্রবেশো জ্যেষ্ঠস্য বিধিলোপকঃ।। জ্যেষ্ঠর আকুতি, মহাবাহু অর্জুন ফিরে আসুন। তাঁর কথার মান রাখুন। এর ফলে অর্জুনের ধর্মলোপ হবে না, হবে না জ্যেষ্ঠর প্রতি অবজ্ঞাপ্রকাশও। অর্জুন বললেন, আপনার কাছেই শুনেছি, ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে ছলনার আশ্রয় নয়। অস্ত্র স্পর্শ করে বলছি, সত্য হতে বিচলিত হব না। ন ব্যাজেন চরেদ্ধর্ম্মমিতি মে ভবতঃ শ্রুতম্। ন সত্যাদ্বিচলিষ্যামি সত্যেনায়ুধমালভে।। যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে, ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত অর্জুন, দ্বাদশ বছরের জন্যে বনবাসে গমন করলেন।
অর্জুনের সঙ্গে চললেন, বেদবিদ ব্রাহ্মণরা। আরও কত বিদ্বজ্জন তাঁর অনুগমন করলেন। বেদ ও বেদাঙ্গবিদ,আধ্যাত্মিকতায় মননশীল ব্রহ্মবিদ, ভিক্ষুক, ভগবৎ চিন্তায় রত বৈষ্ণবগণ, সূত অর্থাৎ স্তুতি-পাঠক, পুরাণবিদেরা, কথক, শ্রমণগণ যাঁরা বিশেষ মতাবলম্বী সাধু, বনবাসী, দিব্য অলৌকিক আখ্যানের মধুর পাঠক ব্রাহ্মণবর্গ, কোমলভাষী এমন বহু সঙ্গীসহ অর্জুন যেন দেবগণ পরিবৃত ইন্দ্রের মতো গমন করলেন। অর্জুন রমণীয় বিচিত্র বন,সরোবর, নদী, সাগর, দেশ, পবিত্র তীর্থসমূহ দর্শন করে গঙ্গাদ্বারে আশ্রম স্থাপন করলেন। সেখানে পবিত্রহৃদয় পাণ্ডবদের মধ্যমণি অর্জুন বহু অদ্ভুত কাজ করেছিলেন। কুন্তীপুত্র অর্জুন সেখানে বসবাসকালীন, ব্রাহ্মণরা অগ্নিহোত্র যাগ শুরু করলেন। মন্ত্রপাঠ হতে লাগল, যজ্ঞাগ্নি জ্বলে উঠল, পুষ্পাহুতির ধূম অন্য তীরে পৌঁছে গেল। গঙ্গাতীরের শোভা হলেন সুস্নাত, বিদ্বান, সৎপথে স্থিত মহান ব্যক্তিত্বরা। সাধুগণ পরিব্যাপ্ত সেই আশ্রম। কুন্তীপুত্র গঙ্গাবক্ষে স্নানের জন্য অবতরণ করলেন। স্নান করে, পিতৃপুরুষের তর্পণ সমাপনান্তে অর্জুন অগ্নিকাণ্ড অর্থাৎ হোম করতে উদ্যোগী হলেন। এই সময়ে নাগরাজকন্যা উলূপী কামুক হয়ে মহাবীর অর্জুনকে জলের অভ্যন্তরে টেনে নিলেন। হোমের জন্যে মনঃসংযোগ করে, পাণ্ডব অর্জুন কৌরব্য নামের পরিচ্ছন্ন নাগভবনে যজ্ঞাগ্নি দেখতে পেলেন। সেখানেই যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন অর্জুন। নির্ভীক অর্জুনের আহুতিতে তুষ্ট হলেন অগ্নি। যাগ সমাপনান্তে কুন্তীপুত্র অর্জুন হাসিমুখে নাগরাজ-কন্যাকে বললেন, হে ভীরু, উত্তমাঙ্গনা, কেন এই দুঃসাহসিক কাজটি করলে? এই সুন্দর দেশটির নাম কী? তুমি কে? কার কন্যা তুমি? কিমিদং সাহসং ভীরু!কৃতবত্যসি ভাবিনি!। কশ্চায়ং সুভগো দেশঃ কা চ ত্বং কস্য বাত্মজা।।
অর্জুনের সঙ্গে চললেন, বেদবিদ ব্রাহ্মণরা। আরও কত বিদ্বজ্জন তাঁর অনুগমন করলেন। বেদ ও বেদাঙ্গবিদ,আধ্যাত্মিকতায় মননশীল ব্রহ্মবিদ, ভিক্ষুক, ভগবৎ চিন্তায় রত বৈষ্ণবগণ, সূত অর্থাৎ স্তুতি-পাঠক, পুরাণবিদেরা, কথক, শ্রমণগণ যাঁরা বিশেষ মতাবলম্বী সাধু, বনবাসী, দিব্য অলৌকিক আখ্যানের মধুর পাঠক ব্রাহ্মণবর্গ, কোমলভাষী এমন বহু সঙ্গীসহ অর্জুন যেন দেবগণ পরিবৃত ইন্দ্রের মতো গমন করলেন। অর্জুন রমণীয় বিচিত্র বন,সরোবর, নদী, সাগর, দেশ, পবিত্র তীর্থসমূহ দর্শন করে গঙ্গাদ্বারে আশ্রম স্থাপন করলেন। সেখানে পবিত্রহৃদয় পাণ্ডবদের মধ্যমণি অর্জুন বহু অদ্ভুত কাজ করেছিলেন। কুন্তীপুত্র অর্জুন সেখানে বসবাসকালীন, ব্রাহ্মণরা অগ্নিহোত্র যাগ শুরু করলেন। মন্ত্রপাঠ হতে লাগল, যজ্ঞাগ্নি জ্বলে উঠল, পুষ্পাহুতির ধূম অন্য তীরে পৌঁছে গেল। গঙ্গাতীরের শোভা হলেন সুস্নাত, বিদ্বান, সৎপথে স্থিত মহান ব্যক্তিত্বরা। সাধুগণ পরিব্যাপ্ত সেই আশ্রম। কুন্তীপুত্র গঙ্গাবক্ষে স্নানের জন্য অবতরণ করলেন। স্নান করে, পিতৃপুরুষের তর্পণ সমাপনান্তে অর্জুন অগ্নিকাণ্ড অর্থাৎ হোম করতে উদ্যোগী হলেন। এই সময়ে নাগরাজকন্যা উলূপী কামুক হয়ে মহাবীর অর্জুনকে জলের অভ্যন্তরে টেনে নিলেন। হোমের জন্যে মনঃসংযোগ করে, পাণ্ডব অর্জুন কৌরব্য নামের পরিচ্ছন্ন নাগভবনে যজ্ঞাগ্নি দেখতে পেলেন। সেখানেই যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন অর্জুন। নির্ভীক অর্জুনের আহুতিতে তুষ্ট হলেন অগ্নি। যাগ সমাপনান্তে কুন্তীপুত্র অর্জুন হাসিমুখে নাগরাজ-কন্যাকে বললেন, হে ভীরু, উত্তমাঙ্গনা, কেন এই দুঃসাহসিক কাজটি করলে? এই সুন্দর দেশটির নাম কী? তুমি কে? কার কন্যা তুমি? কিমিদং সাহসং ভীরু!কৃতবত্যসি ভাবিনি!। কশ্চায়ং সুভগো দেশঃ কা চ ত্বং কস্য বাত্মজা।।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১০: মানুষের পাশে, মানুষের কাছে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০১: সরষের মধ্যে ভূত
উলূপী আত্মপরিচয় দিলেন। তিনি ঐরাবত নামে নাগকুলজাত কৌরব্য নামে নাগের কন্যা। তাঁর নাম উলূপী। তিনি স্নানের জন্যে গঙ্গায় অবতীর্ন, অর্জুনকে দেখে, কামার্তা হয়েছেন। কামনার তারণায় অস্থির হয়ে হয়েছেন উলূপী। অর্জুন নির্জনে অবিবাহিতা, উলূপীকে, আত্মনিবেদন করে, আনন্দিত করুন। অর্জুন বললেন,ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির,আমার জন্যে বার বছর যাবৎ ব্রহ্মচর্য নির্ধারণ করেছেন, আমি স্বাধীন নই। ব্রহ্মচর্য্যমিদং ভদ্রে! মম দ্বাদশবার্ষিকম্। ধর্ম্মরাজেন নির্দ্দিষ্টং নাহমস্মি স্বয়ং বশঃ।। অর্জুন জানালেন, জলচারিণি উলূপীর, প্রিয়কাজটি সম্পন্ন করতে তিনিও ইচ্ছুক। কিন্তু অর্জুন আগে কোনওদিন কখনও কোনও মিথ্যা বলেননি যে।অর্জুন নাগকন্যার পরামর্শগ্রহণে ইচ্ছুক হয়ে বললেন, সেটি (নিয়মটি) মিথ্যা না হয়,ধর্মলঙ্ঘনজনিত কষ্ট যেন না হয় কিন্তু তোমার প্রিয় কাজটিও সম্পন্ন হয়, তেমন কিছু কর। কথঞ্চ নানৃতং তৎ স্যাত্তব চাপি প্রিয়ং ভবেৎ। ন চ পীড্যেত মে ধর্ম্মস্তথা কুরু ভুজঙ্গমে!।। উলূপী জানালেন, পাণ্ডুনন্দন যেমন পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের ব্রহ্মচর্যবিষয়ক আদেশ, সবকিছুই তিনি জানেন। দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে পাণ্ডবভাইদের মধ্যে বর্তমান যে নিয়মটি, যিনি দ্রৌপদীর ঘরে অন্য ভাইয়ের উপস্থিতিতে প্রবেশ করবেন, তিনি বার বছরের জন্য বনবাসী হয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করবেন।
এই নিয়ম, শুধু দ্রৌপদীবিষয়ক, দ্রৌপদীর জন্যই এই বার বছরের নির্বাসন, সেটি ধর্মের কারণে কৃত নিয়মমাত্র। কিন্তু এখানে (অন্য নারীর ক্ষেত্রে) এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়, এর জন্যে ধর্ম লঙ্ঘন হবে না। হে বিশালনয়ন অর্জুন আর্তের পরিত্রাণ, তোমার কর্তব্য। পরিত্রাণঞ্চ কর্তব্যমার্ত্তানাং পৃথুলোচন!। উলূপীর কষ্ট দূর করলে, অর্জুনের মোটেই ধর্ম নাশ হবে না। যদিও এর ফলে,ধর্মের সূক্ষ্ম লঙ্ঘন হলেও হতে পারে। উলূপীর কথার সারার্থ হল, নিয়মরক্ষা থেকেও প্রাণীদের জীবনরক্ষার গুরুত্ব বেশি। তাই নিয়মরক্ষারূপ অল্প ধর্মলঙ্ঘন দোষের নয়। উলূপীকে জীবন দান করলে,সেটাই ধর্ম পালন করা হবে। তিনি অর্জুনের ভক্ত তাঁকে ভজনা করুন অর্জুন। এটিই সজ্জনদের মত। ভক্তাঞ্চ ভজ মাং পার্থ! সতামেতন্মতং প্রভো!। এর অন্যথা হলে, তিনি মারা যাবেন,তাই তাঁকে জীবন দান করুন অর্জুন। এটিই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। প্রাণদানান্মহাবাহো! চর ধর্মম্মনুত্তমম্।
এই নিয়ম, শুধু দ্রৌপদীবিষয়ক, দ্রৌপদীর জন্যই এই বার বছরের নির্বাসন, সেটি ধর্মের কারণে কৃত নিয়মমাত্র। কিন্তু এখানে (অন্য নারীর ক্ষেত্রে) এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়, এর জন্যে ধর্ম লঙ্ঘন হবে না। হে বিশালনয়ন অর্জুন আর্তের পরিত্রাণ, তোমার কর্তব্য। পরিত্রাণঞ্চ কর্তব্যমার্ত্তানাং পৃথুলোচন!। উলূপীর কষ্ট দূর করলে, অর্জুনের মোটেই ধর্ম নাশ হবে না। যদিও এর ফলে,ধর্মের সূক্ষ্ম লঙ্ঘন হলেও হতে পারে। উলূপীর কথার সারার্থ হল, নিয়মরক্ষা থেকেও প্রাণীদের জীবনরক্ষার গুরুত্ব বেশি। তাই নিয়মরক্ষারূপ অল্প ধর্মলঙ্ঘন দোষের নয়। উলূপীকে জীবন দান করলে,সেটাই ধর্ম পালন করা হবে। তিনি অর্জুনের ভক্ত তাঁকে ভজনা করুন অর্জুন। এটিই সজ্জনদের মত। ভক্তাঞ্চ ভজ মাং পার্থ! সতামেতন্মতং প্রভো!। এর অন্যথা হলে, তিনি মারা যাবেন,তাই তাঁকে জীবন দান করুন অর্জুন। এটিই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। প্রাণদানান্মহাবাহো! চর ধর্মম্মনুত্তমম্।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৫: সুন্দরবনের পাখি — মাছরাঙা

যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১
পুরুষোত্তম অর্জুনের শরণাপন্ন হয়েছেন উলূপী। অর্জুন, দীনা অনাথাকে নিত্য রক্ষা করে থাকেন। উলূপীর সকাতর অনুরোধ, আমি আপনার শরণাগত। দুঃখাতুর হয়ে বার বার আপনার সঙ্গসুখ অর্রথাৎ রমণ, প্রার্থনা করছি। পরম কামুকী হয়ে আপনাকে চাইছি, আমার প্রিয় কাজটি করুন। আত্মনিবেদন করে আমার মনোবাসনা সফল করুন। সাহং শরণমভ্যেমি রোরবীমি চ দুঃখিতা। যাচে ত্বাঞ্চাভিকামাহং তস্মাৎ কুরু মম প্রিয়ম্। স ত্বমাত্মপ্রদানেন সকামাং কর্ত্তুমর্হসি।। অর্জুনের দ্বন্দ্ব দূর হল, ধর্মসঙ্গত উপায়ে, তিনি উলূপীর সঙ্গমেচ্ছা পূর্ণ করলেন। নাগভবনে সেই রাত অতিবাহিত হল। শৌর্যশালী অর্জুন, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কৌরব্যের প্রাসাদ থেকে গঙ্গাতীরে উপস্থিত হলেন। নিজ ভবনে, রেখে এলেন অন্য কোনও পুরুষের সান্নিধ্যহীনা সাধ্বী উলূপীকে। উলূপী, অর্জুনকে বর দিলেন, অর্জুন সর্বত্র জলে অজেয় থাকবেন, সংশয়হীনভাবে, সব জলচর প্রাণীরা অর্জুনের অনুগত থাকবে।
দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডব স্বামীদের দাম্পত্যের সূত্রে অর্জুনের জীবনে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, তাঁর সঙ্গে আধুনিক শাসনতন্ত্র ও সামাজিক পরিকাঠামোর নৈতিক ও সামাজিক সংযোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। নারদকৃত নিয়মানুসারে যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদীর একত্রে অস্ত্রাগারে অবস্থানের দরুণ, অর্জুনের সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এই নিয়ম যদি না মানা হয় তবে দীর্ঘ বার বছরের জন্য বনবাস নির্দিষ্ট। এর মধ্যে খাণ্ডবপ্রস্থে যে অশান্তির সূচনা হল, সেটি একটি অরাজকতার নামান্তর। পরম বীর রাজা ও তাঁর পারিপার্শ্বিকের শৌর্যশালী ভাইয়েরা ক্ষমতায় আছেন। এই অবস্থায় গোধন হারিয়ে ব্রাহ্মণ যে অভিযোগ করেছেন তার যৌক্তিকতা আছে। আয়কর, মহাভারতের যুগেও ছিল। রাজা কর গ্রহণ করেন, তার পরিবর্তে প্রজাদের সুরক্ষাদান তাঁর কর্তব্যের পর্যায়ভুক্ত। করগ্রাহক রাজা, যদি প্রজাদের প্রতি সুরক্ষাদানরূপ কর্তব্য পালন না করেন তবে তিনি পাপাচারী রাজা,জনগণের ধিক্কারের পাত্র সেই রাজা। আধুনিক শাসনতন্ত্রে শাসক, রাজা না হলেও, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি এই কর্তব্যপালনের দায়ভার বহন করে থাকেন। এর ব্যতিক্রম হলে শাসক জবাবদিহি করতে বাধ্য হন। আয়করগ্রহণের রীতি এখনও প্রচলিত, হয়তো এই ধারাবাহিকতা মহাকাব্যের যুগ থেকেই চলে আসছে।
দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডব স্বামীদের দাম্পত্যের সূত্রে অর্জুনের জীবনে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, তাঁর সঙ্গে আধুনিক শাসনতন্ত্র ও সামাজিক পরিকাঠামোর নৈতিক ও সামাজিক সংযোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। নারদকৃত নিয়মানুসারে যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদীর একত্রে অস্ত্রাগারে অবস্থানের দরুণ, অর্জুনের সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এই নিয়ম যদি না মানা হয় তবে দীর্ঘ বার বছরের জন্য বনবাস নির্দিষ্ট। এর মধ্যে খাণ্ডবপ্রস্থে যে অশান্তির সূচনা হল, সেটি একটি অরাজকতার নামান্তর। পরম বীর রাজা ও তাঁর পারিপার্শ্বিকের শৌর্যশালী ভাইয়েরা ক্ষমতায় আছেন। এই অবস্থায় গোধন হারিয়ে ব্রাহ্মণ যে অভিযোগ করেছেন তার যৌক্তিকতা আছে। আয়কর, মহাভারতের যুগেও ছিল। রাজা কর গ্রহণ করেন, তার পরিবর্তে প্রজাদের সুরক্ষাদান তাঁর কর্তব্যের পর্যায়ভুক্ত। করগ্রাহক রাজা, যদি প্রজাদের প্রতি সুরক্ষাদানরূপ কর্তব্য পালন না করেন তবে তিনি পাপাচারী রাজা,জনগণের ধিক্কারের পাত্র সেই রাজা। আধুনিক শাসনতন্ত্রে শাসক, রাজা না হলেও, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি এই কর্তব্যপালনের দায়ভার বহন করে থাকেন। এর ব্যতিক্রম হলে শাসক জবাবদিহি করতে বাধ্য হন। আয়করগ্রহণের রীতি এখনও প্রচলিত, হয়তো এই ধারাবাহিকতা মহাকাব্যের যুগ থেকেই চলে আসছে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০০: সন্দেহের তীরবিদ্ধ ভরতদের আজও খুঁজে পাওয়া যায়

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৩: রাগ অনুরাগের বন্ধন, ডিএইচ লরেন্স ও ফ্রিডা
অর্জুন শুধু রাজপ্রতিনিধি নন, তিনি আর্তের আকুতিতে সাড়া দিয়েছেন। তিনি প্রতিকারের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, তা মনুষ্যত্ববোধের আদর্শে বিশ্বাসী যে কোনও মানুষের মানবতাবোধের পরিচায়ক। পাণ্ডবদের বীরত্ব মানবিকতার পরিপন্থী নয়,শুধু ক্ষমতার স্থূল প্রদর্শন নয়, রাজকীয় ক্ষমতা আর্তের ত্রাণের জন্য। যথোচিত সময়ে, যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে, শাসকের সেটি রাজধর্মবিরোধী আচরণ। অর্জুনের রাজধর্ম পালন করেছেন। তিনি জ্যেষ্ঠর এই অখ্যাতি ও অধর্মাচরণের ক্লেদ দূর করতে চেয়েছেন। তিনি শাসকের প্রতিনিধি তাই তিনি মিথ্যাচারের পরিপন্থী। অর্জুনের এই আদর্শবোধ আধুনিক শাসকবর্গের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে কী?
দুই ভাইয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং দাম্পত্যের নিয়ম,পারিবারিকবৃত্তেই প্রযোজ্য। রাজধর্মের ক্ষেত্রে প্রজাস্বার্থরক্ষা যখন প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন তখন দ্রৌপদী, যুধিষ্ঠির ও অন্যান্য আত্মীয়তার সম্পর্ক গুরুত্ব হারিয়ে গৌণ হয়ে যায়।ব্রাহ্মণের ধন উদ্ধার করেছেন অর্জুন। এর ফলে যুধিষ্ঠিরের অবজ্ঞার পাত্র হতে পারেন,জেনেও, তুচ্ছ মনে করেছেন। অর্জুন দীর্ঘ বনবাস বরণ করেছেন স্বেচ্ছায়। জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের কাতর অনুরোধ, তাঁর ধর্মবোধে চিড় ধরাতে পারেনি।ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে, ছলনার আশ্রয় নেওয়া যায় না। একজন আদর্শ ধার্মিক রাজাকে যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে প্রকৃত ধর্ম কী? সেটি শিখিয়েছেন অর্জুন।
অর্জুন সেই রাজপ্রতিনিধি, শাসকের লুপ্ত বিবেকবোধ, যিনি রাজধর্মের ন্যয়দণ্ডটিকে উন্নত রেখেছেন। প্রকৃত শাসকের নৈতিকতা স্বজনপ্রীতির গণ্ডীবদ্ধতায় সীমাবদ্ধ নয়, ন্যায়ধর্মের স্থান পারিবারিক গণ্ডীর ঊর্ধ্বে এবং সেটি প্রকৃত রাজধর্ম—এটি প্রকারান্তরে মনে করিয়ে দিয়েছেন। নিয়মের শৃঙ্খলাবোধ, পারিবারিক ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করে তোলে। অর্জুন, নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন বৃহত্তর প্রজাস্বার্থরক্ষার কারণে। সেটি হয়তো মার্জনীয় ছিল। কারণ পারিবারিক জীবনে,এটি শৃঙ্খলাভঙ্গের উদাহরণ হয়ে হয়তো অন্যদের বিশ্বাসহানির কারণ হোত।তাই অর্জুনের বনবাসযাপনের সিদ্ধান্ত পারিবারিক দাম্পত্যসম্পর্কের ক্ষেত্রেও যেমন সঠিক, তেমনই রাজধর্মরক্ষার আদর্শ দৃষ্টান্ত।
দুই ভাইয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং দাম্পত্যের নিয়ম,পারিবারিকবৃত্তেই প্রযোজ্য। রাজধর্মের ক্ষেত্রে প্রজাস্বার্থরক্ষা যখন প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন তখন দ্রৌপদী, যুধিষ্ঠির ও অন্যান্য আত্মীয়তার সম্পর্ক গুরুত্ব হারিয়ে গৌণ হয়ে যায়।ব্রাহ্মণের ধন উদ্ধার করেছেন অর্জুন। এর ফলে যুধিষ্ঠিরের অবজ্ঞার পাত্র হতে পারেন,জেনেও, তুচ্ছ মনে করেছেন। অর্জুন দীর্ঘ বনবাস বরণ করেছেন স্বেচ্ছায়। জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের কাতর অনুরোধ, তাঁর ধর্মবোধে চিড় ধরাতে পারেনি।ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে, ছলনার আশ্রয় নেওয়া যায় না। একজন আদর্শ ধার্মিক রাজাকে যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে প্রকৃত ধর্ম কী? সেটি শিখিয়েছেন অর্জুন।
অর্জুন সেই রাজপ্রতিনিধি, শাসকের লুপ্ত বিবেকবোধ, যিনি রাজধর্মের ন্যয়দণ্ডটিকে উন্নত রেখেছেন। প্রকৃত শাসকের নৈতিকতা স্বজনপ্রীতির গণ্ডীবদ্ধতায় সীমাবদ্ধ নয়, ন্যায়ধর্মের স্থান পারিবারিক গণ্ডীর ঊর্ধ্বে এবং সেটি প্রকৃত রাজধর্ম—এটি প্রকারান্তরে মনে করিয়ে দিয়েছেন। নিয়মের শৃঙ্খলাবোধ, পারিবারিক ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করে তোলে। অর্জুন, নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন বৃহত্তর প্রজাস্বার্থরক্ষার কারণে। সেটি হয়তো মার্জনীয় ছিল। কারণ পারিবারিক জীবনে,এটি শৃঙ্খলাভঙ্গের উদাহরণ হয়ে হয়তো অন্যদের বিশ্বাসহানির কারণ হোত।তাই অর্জুনের বনবাসযাপনের সিদ্ধান্ত পারিবারিক দাম্পত্যসম্পর্কের ক্ষেত্রেও যেমন সঠিক, তেমনই রাজধর্মরক্ষার আদর্শ দৃষ্টান্ত।

ছবি: প্রতীকী।
শরণাগতকে পরিত্রাণ—এই ক্ষত্রধর্ম, নাগকন্যা উলূপীর সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্কের বিষয়ে অন্য মাত্রা পেয়েছে। ষড়রিপুর অন্যতম কামনার তারণায় অস্থির উলূপীর আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন অর্জুন। উলূপীর অবস্থান, পাণ্ডবদের পারিবারিক বৃত্তের বাইরে। তাঁর ক্ষেত্রে নারদকৃত নিয়ম প্রযোজ্য নয়। উলূপীর কামাতুর আর্তি স্বার্থকেন্দ্রিক। কামনার লালসাপূরণে রাজকীয় গরিমা নেই, আছে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়।তাই ব্রহ্মচারী নিঃসঙ্গ অর্জুনের এই আচরণে আছে, হয়তো সেই চিরন্তন জৈবিকপ্রবৃত্তির আকর্ষণ। স্বেচ্ছায় প্রিয়সান্নিধ্য ত্যাগ করে এসেছেন যে তরুণ তাঁর এই পদস্খলন, নৈতিক অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত হতে পারে কী?
রাজধর্ম স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে, নৈতিকতার শক্ত বুনিয়াদে প্রতিষ্ঠিত, বৃহত্তর মঙ্গলময় জনস্বার্থপূরণে লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ আদর্শ। অর্জুনের আত্মত্যাগ, সেটিই প্রমাণ করে। মহাভারতীয় স্বার্থত্যাগের এই আদর্শ, কবে উদ্বুদ্ধ করবে রাজনীতির অঙ্গনে ভ্রাম্যমান দিকভ্রষ্ট বিভ্রান্ত ভারতীয় রাজনীতিবিদ শাসকবর্গকে?—চলবে।
রাজধর্ম স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে, নৈতিকতার শক্ত বুনিয়াদে প্রতিষ্ঠিত, বৃহত্তর মঙ্গলময় জনস্বার্থপূরণে লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ আদর্শ। অর্জুনের আত্মত্যাগ, সেটিই প্রমাণ করে। মহাভারতীয় স্বার্থত্যাগের এই আদর্শ, কবে উদ্বুদ্ধ করবে রাজনীতির অঙ্গনে ভ্রাম্যমান দিকভ্রষ্ট বিভ্রান্ত ভারতীয় রাজনীতিবিদ শাসকবর্গকে?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।