যে বীরহৃদয় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছিল, মোহভার ও বৈকল্যের চোরা স্রোতে হতোদ্যম হয়েছিল, সেই বীরহৃদয়েই অনুরণিত হচ্ছে এক সঙ্গীত। সে সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা যেন তার শোণিতধারায় বহমান হয়ে তাকে উজ্জীবিত করছে, অন্তর্লোকে সঞ্চিত অজ্ঞানতমিস্রা দূর হয়ে যাচ্ছে শ্লোকে শ্লোকে। শোকোত্তীর্ণ, মোহোত্তীর্ণ জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘনায়মান অন্ধকারে স্নিগ্ধ সন্ধ্যাদীপের আলো জ্বলে উঠছে অজস্র, অগণ্য।
জীবনদেবতা সেই পথ দেখান, গীতোপনিষদের উত্সারিত জীবনগীত পার্থিব জীবনের সন্ধ্যার কূলে দিনের চিতাগ্নির অসহনীয় তাপ, নিশ্চেতন ঔজ্জ্বল্যের পাশে উপনীত ধ্বস্ত মৃত্যুশীতল মনুষ্যচেতনাকে জাগিয়ে তুলতে চায় তাই।
চারপাশের সফেন মৃত্যুকুটিল জীবনসমুদ্রের তরঙ্গ, ক্লান্ত বিহঙ্গহৃদয় সেই নিঃসীম স্তব্ধতায় অন্তর্লীন জীবনসঙ্গীতকেও সমাপ্ত কিংবা অবরুদ্ধ মনে করে বুঝি পক্ষ্মযুগল নিমীলিত করে নিদ্রিত হতে চায়। কিন্তু গীতা সেই আনত জীবনকে কালসমুদ্রে আলোর যাত্রী করবে।
চারপাশের সফেন মৃত্যুকুটিল জীবনসমুদ্রের তরঙ্গ, ক্লান্ত বিহঙ্গহৃদয় সেই নিঃসীম স্তব্ধতায় অন্তর্লীন জীবনসঙ্গীতকেও সমাপ্ত কিংবা অবরুদ্ধ মনে করে বুঝি পক্ষ্মযুগল নিমীলিত করে নিদ্রিত হতে চায়। কিন্তু গীতা সেই আনত জীবনকে কালসমুদ্রে আলোর যাত্রী করবে।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১০: মানুষের পাশে, মানুষের কাছে
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৭: প্রবল অজেয় বাণী তব
গীতা সেই ভঙ্গুর জীবনকে জানাবে তার সুখ দুঃখের কারণ। সেই জীবন যে সুখে উদ্বেল বিগলিত, যে দুঃখে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, যে আশায় সে বুক বাঁধে, যে হতাশায় নিশ্চেতন হয় তাদের প্রকৃত স্বরূপ ঠিক কীরকম। তা কি যথার্থ নাকি মনের ভ্রান্ত আকাঙ্ক্ষার মরীচিকামাত্র, তা কি ক্ষণকালের নাকি চিরকালীন, তার পুরুষার্থলাভে জাগতিক কর্তব্যকর্মের যথাযথ অনুষ্ঠান-ই মুখ্য নাকি মরজীবনের অবসানে যে অবিচ্ছিন্ন, অশেষ সত্যসম্ভাবনার প্রকল্প, যে পারত্রিক উদ্ঘাটন, তা-ই জীবের ও জীবনের অভীষ্ট, তার অনুসন্ধান দেবে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৫: সুন্দরবনের পাখি — মাছরাঙা
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০১: সরষের মধ্যে ভূত
গীতা তাই বলবে, যে সুখ বিষয় এবং ইন্দ্রিয়ের সংযোগ থেকে জাত, তা আপাত রমণীয় হলেও উত্পত্তি-বিনাশশীল, সেকারণেই সেই অনিত্য সুখ দুঃখের কারণ। ধীমান ব্যক্তি সেই সুখে উদ্বেল হবেন না, সেই মনোহর সুখে বিমোহিত হবেন না। নিষ্কাম কর্মযোগের প্রয়োগে যিনি আমরণ কাম ও ক্রোধের বেগকে উত্পত্তির কালেই সহ্য করতে সমর্থ হন, নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত সুখী ও যোগযুক্ত হন। এমন সুখী মানুষ স্বার্থনিষ্ঠ নন, কিন্তু আত্মদীপ হন, আত্মমগ্ন হন। সংযতচিত্ত এমন মানুষ সংশয়শূন্য হয়ে তত্ত্বদর্শী হন, তিনি ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির নিয়ন্ত্রণমুখী একাধিপত্যকে জয় করবেন, তিনি ইচ্ছা, ভয়, ক্রোধকে জয় করে নিয়ত আত্মমননশীল হয়ে জীবিতাবস্থাতেই মুক্ত হন।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৪: শিকারী ও ‘শিকার’
যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১
মন-ই জীবের মিত্রস্বরূপ, মন-ই জীবের শত্রু। চিত্তকে যিনি জয় করতে পারবেন তাঁর মন মিত্রবত্ হিতকারী। যিনি পারবেন না, সেই অজিতমনা মানুষের মনের থেকে বড় শত্রু বুঝি আর নেই! মন তাকে বিপন্ন করে পদে পদে। অতয়েব হে যোদ্ধা! মনকে দৃঢ় করো, যে জাগতিক বিপন্নতার আশঙ্কায়, অবসাদে কিংবা কল্পনায় তুমি মুহ্যমান তার যাথার্থ্যকে সম্যক্ জানো, যে মানসিক বাধা তোমার সামনে পর্বতপ্রমাণ হয়ে তোমার ভাবীকালকে মুহূর্তে তুচ্ছ, তোমার দীর্ঘ সাধনাকে নিমেষেই অনর্থক করে তুলতে চাইছে তার মোহজালে গ্রস্ত হয়ো না। যে পথকে তুমি অবলম্বন করেছো, তোমার অন্তরাত্মা সেই পথের মার্গদর্শক, রক্ষক ও বেত্তা।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০০: সন্দেহের তীরবিদ্ধ ভরতদের আজও খুঁজে পাওয়া যায়
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৩: রাগ অনুরাগের বন্ধন, ডিএইচ লরেন্স ও ফ্রিডা
এই পথের শেষেই মহাসত্যের উদয়। জন্মান্তর, পুনর্জন্ম কিংবা মহামুক্তি বা মোক্ষ-সংশ্লিষ্ট সেই জীবনপথে সম্পাদিত কর্ম, অর্জিত কর্মফল, অনুভূত বিষয় ও অর্জিত বোধ ও চেতনা নিবৃতচিত্ত যোগস্থ জীবকে ক্ষুদ্র স্বার্থদীর্ণ মরজগতের বল ও অবল, অনিবার্য পরিণতি ও অবশ্যকর্তব্যের সন্ধান দেয়। গীতা অমর্ত্যলোকের সুধাসিঞ্চিত গীতিময়ী বাণীর ছন্দোবন্ধনে মর্ত্যচারী জীবের নশ্বর পাদবিক্ষেপের অন্তরালে বহমান অধরা মাধুরীকে ধরতে চেয়েছে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।